ধর্মের আলোকে মেডিটেশন

published : ৩১ আগস্ট ২০১৫

ধর্মাচার ভিন্ন হলেও সব ধর্মের মূলবাণী একই। আর তা হলো অনৈতিকতা ও পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হয়ে আদর্শ জীবন গঠন। আত্মপর্যালোচনা এবং আত্মউপলব্ধির মাধ্যমে নিজের পরিবর্তন।

আর এই উপলব্ধির প্রক্রিয়ায় ধ্যান বা মেডিটেশনকে পৃথিবীর সব ধর্মেই বিবেচনা করা হয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে।

ধ্যান একটি সার্বজনীন প্রক্রিয়া। বিভিন্ন ধর্ম আর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এর প্রয়োগ ভিন্নরূপে হলেও ধ্যানের নির্যাস সকল মানুষের জন্যে একই। যুগে যুগে দেশে দেশে সাধকরা আত্ম উপলব্ধির জন্যে এ প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করেছেন।

সনাতন ধর্মে ধ্যান

মহাভারত, বেদ ও উপনিষদে বলা হয়েছে, ধ্যানে মগ্ন হলে একজন মানুষ আত্মার সন্ধান পেতে পারে নিজের মাঝেই। ভগবতগীতায় ধ্যানযোগের ওপর রয়েছে বিশেষ অধ্যায়। আর পতাঞ্জলির সময় থেকে যোগসাধনায় সংযুক্ত হয়েছে ধ্যান, যার পরিণতি সমাধির স্তরে।

বৈদিক হিন্দুধর্মের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র হলো গায়ত্রী মন্ত্র। এ মন্ত্রকে বলা হয় সমস্ত মন্ত্রের জননী। পন্ডিত সত্যকাম বিদ্যালংকারের অনুবাদ দি The Holy Vedas এ রয়েছে —

O Supreme Lord

Thou art ever existent, ever conscious, ever blissful. We meditate on Thy most adorable glory. Mayest Thou guide and inspire our intellect on the path of highest divinity! May we be able to discriminate between truth and falsehood. (Rig.3.62.10)

সদাসর্বত্র বিরাজমান তন্দ্রা-নিদ্রাহীন সদা সজাগ প্রতিনিয়ত করুণা বর্ষণকারী সর্বশক্তিমান হে প্রভু! আমরা শুধু তোমারই মহিমার ধ্যান করি, প্রভু হে! তুমি আমাদের সর্বোত্তম আলোকিত পথে পরিচালিত করো। [ঋগ্বেদ : ৩.৬২.১০]

রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী স্থিরাত্মানন্দজী মহারাজ। ২০০৯ সালে কোয়ান্টাম মুক্ত আলোচনার এক বিশেষ সেশনে তিনি সনাতন ধর্মে ধ্যান বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। 

বৌদ্ধ ধর্মে ধ্যান

বৌদ্ধ ধর্মমতে ধ্যান বা মেডিটেশনই হলো নির্বাণপ্রাপ্তির উপায়। দুঃখসংক্রান্ত চতুরার্থ সত্য উপলব্ধির পর মহামতি বুদ্ধ এর প্রতিকারের জন্যে যে দুই ধর্মচক্রের কথা বলেন, তার প্রথম হলো মধ্যপন্থা অনুসরণ অর্থাৎ জীবনে অতি সুখ-বিলাস-ব্যসন যেমন পরিত্যাজ্য, তেমনি অতি সংযম ও কৃচ্ছ্রসাধনও অপ্রয়োজনীয়। আর ২য় ধর্মচক্রে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গে তিনি আটটি সৎপথের কথা বলেন। আর তা হলো, সৎদৃষ্টি, সৎসংকল্প, সৎবাক্য, সৎকর্ম, সৎজীবিকা, সৎপ্রচেষ্টা, সৎস্মৃতি এবং সৎসমাধি। আর এর যথার্থ উপলব্ধির জন্যে একজন মানুষকে মেডিটেশন বা ধ্যানে আত্মমগ্ন হতে হবে।

বুদ্ধের মতে মেডিটেশনের প্রাপ্তি হলো দুটি–এক, সমাধি বা স্থিরতা যা মনকে কেন্দ্রীভূত করে; দুই, বিপাসন বা প্রজ্ঞা, যা পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বাইরেও উপলব্ধির চেতনাকে জাগ্রত করে। ফলে একজন মানুষ তার স্থান-কালের সীমা অতিক্রম করে ত্রিকাল দর্শনের অভিজ্ঞতা লাভ করেন।

অর্থাৎ মহামতি বুদ্ধ ধ্যানের পথে বোধি লাভ করেছেন। ধ্যানের মাধ্যমেই নির্বাণ লাভের পন্থা শিখিয়েছেন অনুসারীদের।

২০০৯ সালে কোয়ান্টাম মুক্ত আলোচনার এক বিশেষ সেশনে 'মহামতি বুদ্ধের জীবন ও শিক্ষা' বিষয়ক এক বিশেষ আলোচনায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বৌদ্ধব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশ বৌদ্ধকৃষ্টি প্রচার সঙ্ঘের সভাপতি ও ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহারের অধ্যক্ষ মহামান্য শুদ্ধানন্দ মহাথের এ বক্তব্যই তুলে ধরেন।

খ্রিষ্ট ধর্মে ধ্যান

যিশুখ্রিষ্টের জীবনে ধ্যান এবং প্রার্থনা হয়ে গিয়েছিল একাকার।

যিশুর শক্তির উৎস ছিল তাঁর ধ্যান, তাঁর প্রার্থনা—যে ধ্যানে তিনি ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতেন। যে প্রার্থনা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, প্রার্থনায় যা-কিছু তোমরা চাও, বিশ্বাস করবে তা পেয়েছ, তাহলে তা-ই পাবে। সারাদিন ধরে ভক্ত-শিষ্য-অভ্যাগতদের সাথে সময় কাটানোর পর সন্ধ্যাবেলা খানিকটা নির্জনে গিয়ে তিনি প্রার্থনায় নিমগ্ন হতেন, ভুলে যেতেন সমস্ত ক্ষুধা-ক্লান্তি-অবসাদ। অন্যদেরকেও তিনি বলতেন, অনেক কাজ করেছ, এখন ধ্যান করো। নিজেকে পর্যালোচনা করো, ভুলগুলো খুঁজে বের করো, মনের পর্দায় নিজেকে দাঁড় করাও, জীবন পরিবর্তন করো।

যিশুখ্রিষ্টের এ আদর্শের অনুসরণে যারা অনুপ্রাণিত, তারা চর্চা করেন খ্রিষ্টীয় মেডিটেশন। স্রষ্টার মহিমা ও বাণী নিয়ে বিশেষ প্রার্থনা। খ্রিষ্টীয় মেডিটেশনের একজন একনিষ্ঠ প্রবক্তা সেইন্ট পিয়েত্রিলসিনা। তিনি বলেন, বাইবেল পড়ে একজন মানুষ স্রষ্টাকে খোঁজে, আর মেডিটেশনের মধ্য দিয়ে সে স্রষ্টাকে পায়।

যিশুখ্রিষ্টের জীবনে ধ্যান বিষয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা করেন ফাদার পৌলিনুস কস্তা। ঢাকার আর্চবিশপ পৌলিনুস কস্তা বাংলাদেশে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ।

ইসলাম ধর্মে ধ্যান

ইসলামে ধ্যান বা মেডিটেশনকে একটি উচ্চস্তরের ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়। মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র গ্রন্থ কোরআনের বহু জায়গায় সরাসরি মেডিটেশনের কথা বলা হয়েছে। কোরআনে যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তা হচ্ছে তাফাক্কুর। এর অর্থ হচ্ছে কনটেমপ্লেশন, মেডিটেশন বা ধ্যান। সূরা আলে ইমরানের ১৯০-৯১ আয়াতে আল্লাহ জ্ঞানীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলেছেন, ‘তারা আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিরহস্য নিয়ে গভীর ধ্যানে (তাফাক্কুর) নিমগ্ন হয়’।

আল কোরআনের সূরা আনআমে আল্লাহ বলেন, হে নবী! ওদের জিজ্ঞেস করো, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি কখনো সমান হতে পারে? তোমরা কি এরপরও (কোরআনের শিক্ষা অনুধাবনে) গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হবে না (বা তোমাদের সহজাত বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করবে না)? (আনআম: ৫০ )

সূরা সাদে আল্লাহ বলেন, হে নবী! আমি তোমার ওপর এই কল্যাণময় কিতাব নাজিল করেছি, যাতে মানুষ এই কোরআনের বাণী নিয়ে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হয়! (সেইসাথে সহজাত বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে) এর শিক্ষা অনুসরণ করে।

একইভাবে সূরা মুহাম্মদের ২২, ২৩, ২৪ আয়াতে আল্লাহ বলেন, (হে নবী! ওদের জিজ্ঞেস করো) তোমরা যদি (আল্লাহর আনুগত্য থেকে বেরিয়ে পুরনো ধ্যানধারণায়) ফিরে যাও, তবে কি তোমরা দুনিয়ার বুকে পুনরায় বিপর্যয় সৃষ্টি করবে? বন্ধন ছিন্ন করে পরস্পর বিবাদ-বিসংবাদে লিপ্ত হবে? এদেরকেই আল্লাহ তার রহমত থেকে বঞ্চিত করেন, (সত্যের ব্যাপারে) বধির ও অন্ধ করেন। এরপরও কি ওরা কোরআন নিয়ে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে তা অন্তরে ধারণ করবে না? নাকি মনের দরজা বন্ধই করে রাখবে?

আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভী বর্তমান বিশ্বের একজন সর্বজনমান্য ইসলামি চিন্তাবিদ। তিনি ১৯৭৩ সালে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উসূল আদ-দ্বীন অনুষদ হতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি মিশর সরকারের বোর্ড অফ রিলিজিয়াস এফেয়ার্স-এর সদস্যপদসহ আন্তর্জাতিক বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর ফতোয়া এন্ড রিসার্চ-এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেছেন, মেডিটেশন বা ধ্যান হচ্ছে উচ্চস্তরের ইবাদত।

বিশিষ্ট গবেষক ও মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক মালিক বাদরি’র মেডিটেশন বিষয়ক গ্রন্থ 'Contemplation : An Islamic Psycho-Spiritual study' -এর ভূমিকায় ইউসুফ আল কারযাভী বলেন, ‘গ্রন্থকার তার গ্রন্থে ধ্যান ও প্রশান্ত মনে সৎচিন্তার আলোকে বিচার করার ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশনাকে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন’।

হাদীসেও ধ্যানের গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, এক ঘণ্টার ধ্যান সারা বছরের নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম। এছাড়া হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত আছে, নবীজী (স) বলেছেন, সৃষ্টি সম্পর্কে এক ঘণ্টার ধ্যান ৭০ বছরের নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম (মেশকাত)।

বছরের পর বছর হেরা গুহায় যে তিনি ধ্যানে কাটিয়েছেন, তা তো সবাই জানেন। তিনি যে মেডিটেশন করতেন তা বোঝা যায় বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ড. তারিক রামাদানের The Messenger : The meanings of the life of Muhammad বই থেকে। সেখানে তিনি বলেছেন, He did not demand of his companions the worship, fasting and meditation that he exacted of himself. অর্থাৎ রসুলুল্লাহ (স) যেভাবে ইবাদত করতেন, রোজা রাখতেন এবং মেডিটেশন করতেন, তিনি তাঁর অনুসারীদের ওপর সে কঠোরতাকে চাপিয়ে দিতে চান নি। অনেক কিছু তিনি নিজে করেছেন কিন্তু অন্যদের জন্যে বলেছেন, তোমরা করলেও করতে পারো।

দেশে-বিদেশে কোয়ান্টাম মেথড মেডিটেশনের হাজার হাজার চর্চাকারীদের মধ্যে রয়েছেন সব ধর্মের অনুসারীরাই। কারণ কোয়ান্টাম বিশ্বাস করে সকল ধর্মের মূল শিক্ষা এক। স্থান কাল ভাষা পরিবেশ অনুসারে ধর্মাচারে পার্থক্য রয়েছে। স্বধর্ম পালন ও অন্যের ধর্মপালনের অধিকার নিশ্চিত করাই ধর্মের শিক্ষা। কোরআন কণিকার পাশাপাশি বেদ ও গীতা কণিকা, বাইবেল ও ধম্মপদ কণিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে সকল ধর্মের প্রতি কোয়ান্টামের শ্রদ্ধাবোধেরই প্রকাশ ঘটেছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু তিনটি প্রধান ধর্মের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বরাও সাদরে আমন্ত্রিত হয়েছেন কোয়ান্টামে, আলোচনা করেছেন ধ্যান, ধর্ম আর নৈতিকতা নিয়ে।