published : ৩ জুলাই ২০২৫
বন্ধুর ছলে কেউ যদি আপনার পিঠে ছুরি বসায়, কেমন লোক মনে করবেন তাকে? নিষ্ঠুর, ধূর্ত, দূরভিসন্ধিপূর্ণ- এমনই তো! বাস্তবতা হলো, অনেকটা এই কাজ হরহামেশাই করছি ভালো মানুষ এই আমরাও! শুনতে অদ্ভুত লাগলেও গীবতের মাধ্যমে আসলে আমরা অন্যের পিঠে ছোরা-ই বসাই!
গীবত বা পরনিন্দা এমন একটি সামাজিক ব্যাধি, যা ব্যক্তিগত পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ইসলামে তাই গীবতকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে; পবিত্র কোরআনে একে তুলনা করা হয়েছে মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণের সাথে।
গীবত আরবি শব্দ, যার অর্থ কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষ-ত্রুটি আলোচনা করা। তা হতে পারে শারীরিক, বাহ্যিক বেশ ভূষায়, আচরণগত, পেশাগত বা যে-কোনো কিছুই। রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, "গীবত হলো তোমার ভাইয়ের এমন দোষ আলোচনা করা, যা সে অপছন্দ করে”।
অনেকেই বলবেন, আমি আরেকজনের ব্যাপারে যা বলছি তা তো মিথ্যা না! আসলে আরেকজনের দোষত্রুটির কথা যদি সত্যি হয়ও, কথাটা তার অসাক্ষাতে বললে সেটা গীবত হবে। আর যদি কথাটি মিথ্যা হয় তাহলে সেটা হবে অপবাদ।
একদিন নবীজীর (স) সাথে আলাপচারিতার সময় হযরত আয়েশা (রা) একজন মহিলার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছিলেন, “… বেটে মহিলাটি”; নবীজী (স) তাকে সাবধান করে বললেন, “হে আয়েশা! তুমি কি জানো, যে কথাটি তুমি বললে সেটা কতটা খারাপ? এই কথাটিকে যদি সমুদ্রে ফেলা হয় তাহলে সমুদ্রের পুরো পানি কলুষিত/অপবিত্র হয়ে যাবে”।
অতএব, বুঝতেই পারছেন কত অনায়াসেই আমরা গীবত করে ফেলি!
১. ধর্মীয় ও আত্মিক ক্ষতি
ধর্মে গীবতকে একটি গুরুতর পাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) বলেছেন, গীবত (পরনিন্দা) ব্যভিচারের চেয়েও জঘন্য। ব্যভিচারী তওবা করলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন। কিন্তু গীবতকারী তওবা করলেও আল্লাহ (সরাসরি) ক্ষমা করেন না। যার গীবত করা হয়েছে, সে ক্ষমা করলেই আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন।(—আবু সাঈদ খুদরী (রা), জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা); বায়হাকি, মেশকাত)।
গীবত এতটাই গর্হিত যে গীবত করলে পুনরায় নামাজ আদায় ও পরে কাজা রোজা রাখার কথা বলা হয়েছে হাদীসে।
খ্রিস্টধর্মও গসিপ ও নিন্দাকে নিরুৎসাহিত করে, এবং বিশ্বাসীদের সদয় ও সততার সাথে কথা বলার পরামর্শ দেয় (ইফিসীয় ৪:২৯)।
২. মানসিক ও আবেগিক ক্ষতি
গীবত গীবতকারীরও ক্ষতি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত গসিপিং ও নেতিবাচক কথা বলার অভ্যাস স্ট্রেস, উদ্বেগ এবং নেতিবাচক চিন্তার প্রবণতা বাড়ায়।
অন্যদিকে, গীবতের শিকার হওয়া মানুষদের এটি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মক্ষেত্রে নেতিবাচক গসিপ কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। যখন কেউ জানতে পারে যে তাকে নিয়ে কুৎসা রটানো হয়েছে, তখন তার আত্মবিশ্বাস কমে যায়, হতাশার সৃষ্টি হয়।
৩. শারীরিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি
অতিরিক্ত গীবত করার ফলে কর্টিসল নামে স্ট্রেস হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যায়। উচ্চ কর্টিসল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে, রক্তচাপ বাড়ায়, হৃদরোগের ঝুঁকি সৃষ্টি করে এবং হজমের সমস্যার কারণ হতে পারে।
খাবারের টেবিলে গীবত যেন একটু বেশিই হয়। অনেকেই যে হজমের সমস্যায় ভোগেন তার একটি কারণ খেতে খেতে গীবত করা বা শোনা।
৪. ব্যক্তিত্ব ও আত্মোন্নয়নের ক্ষতি
যিনি অন্যের গীবত করে বেড়ায় তার সামাজিক বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যায়। কারণ আজ যে আপনার কাছে গীবত করে, কাল হয়ত আপনার গীবত সে করবে আরেকজনের কাছে- এই বোধটুকুই যথেষ্ট মানুষের কাছে গীবতকারীর আস্থা কমাতে।
৫. সম্পর্ক ও সামাজিক জীবনের ক্ষতি
সামাজিক সম্প্রীতি নাশের জন্যে যতগুলো কারণ দায়ী তার মধ্যে তালিকার শীর্ষে থাকবে গীবত। সামাজিক অশান্তি, অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতার জন্ম দেয় এটি। আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক করে বিনষ্ট। কারণ গীবতকারী বুঝে করুক বা না বুঝে, সবসময় অন্যের সেই খারাপ দিকটির কথাই গীবতের মাধ্যমে বলা যায়, যা গীবতের শিকার ব্যক্তির জন্যে অস্বস্তিকর।
Frontiers in Psychology জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, কর্মক্ষেত্রে গসিপ ও সমালোচনা টিমের মনোবল ও সহযোগিতা কমিয়ে দেয়, যাতে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়।
আগেই বলা হয়েছে, গীবতের গুনাহ আল্লাহ সরাসরি ক্ষমা করেন না। তবে ভুলক্রমে গীবত হয়ে গেলে প্রতিকার আছে-
১. যার গীবত করেছেন তার কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চেয়ে নিন ও ভবিষ্যতে পুনরায় গীবত করা থেকে বিরত থাকুন।
২. সরাসরি ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ না থাকলে কাফফারা আদায় করুন। পাপ কাজের পর তওবা কবুলের উদ্দেশ্যে আর্থিক বা শারীরিক ক্ষতিপূরণ আদায়ের নামই কাফফারা।
নবীজী (স) বলেছেন, গীবতের কাফফারা হচ্ছে যার গীবত করা হয়েছে তার মাগফেরাত কামনা—‘হে আল্লাহ! আমাকে ও তাকে ক্ষমা করো’ বলে তার জন্যে দোয়া করা।—(আনাস ইবনে মালেক (রা); বায়হাকি, মেশকাত)।