published : ২৭ আগস্ট ২০২০
জঙ্গলে হারিয়ে গেছেন এক শিকারি। হরিণের পেছনে ছুটতে গিয়ে দিক হারিয়ে ফেলেছেন। কোনোভাবেই কোনো দিশা দেখতে পারছেন না। চারিদিকে বিশাল বৃক্ষরাজি, গভীর ঘন অরণ্যে তিনি একা। দুপুর গড়িয়ে বিকাল সন্ধ্যা এবং রাত।
পরদিনও শিকারি প্রাণপণ খুঁজতে লাগলেন জঙ্গল থেকে বেরোনোর উপায়। কিন্তু পেলেন না। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় তিনি ক্লান্ত বিধ্বস্ত। ক্রমেই দুপুর গড়িয়ে বিকাল সন্ধ্যা এবং রাত। অবসন্ন শিকারি ক্ষুধার জ্বালায় এতটাই দুর্বল হয়ে গেছেন যে আর পথ চলতে পারলেন না। ঘুমিয়ে পড়লেন।
তৃতীয়দিন তিনি কোনোমতে সাহস সঞ্চয় করে দুর্বল শরীরে চলতে লাগলেন। কিন্তু অরণ্যে কোথাও কোনো খাবার নেই, পানি নেই। তিনদিন অভুক্ত থেকে শিকারি তার সমস্ত শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছেন।
ক্ষুধার্ত ভীতসন্ত্রস্ত শিকারি হঠাৎ দেখতে পেলেন, একটু সামনেই একটা আপেল গাছ। এবং গাছ ভরা আপেল। ছুটে গেলেন গাছটার কাছে। ১৫/২০টা আপেল পেরে ফেললেন। এবং প্রথম আপেলে কামড় দিলেন। আনন্দে খুশিতে তার মন প্রাণ ভরে উঠল। তিনি প্রভুকে ধন্যবাদ দিতে লাগলেন। জীবনকে ধন্যবাদ দিতে লাগলেন। শুকরিয়ায় ভরে উঠল তার অন্তর।
কিন্তু তিনি যখন দ্বিতীয় আপেলটায় কামড় দিলেন এবার তার কৃতজ্ঞতা প্রথম আপেলটার চেয়ে খানিকটা কম। তিনি দ্বিতীয় আপেলটাও খেলেন।
এভাবে শিকারি যখন পঞ্চম আপেলটা খাচ্ছেন তখন তার কৃতজ্ঞতা বা শুকরিয়া বোধ অনেকটাই কমে এসেছে।
দশম আপেলটা তিনি আর খেতে পারলেন না। থু করে মুখ থেকে ফেলে দিলেন। আপেল খেতে তার আর ভালো লাগছিল না। আপেল তার কাছে বিস্বাদ আকর্ষণহীন ঠেকল।
গবেষকরা এটাকে বলছেন, The tenth apple effect. বা দশম আপেল ঘটনা। প্রথম আপেলটা যেমন সুমিষ্ট ছিল, দশম আপেলটাও একইরকম সুমিষ্ট। তবুও শিকারির সেটি ভালো লাগল না খেতে। কারণটা আপেল নয়; কারণটা শিকারির দৃষ্টিভঙ্গি বা মনোভাব।
অর্থনীতির ভাষায় বলে, law of diminishing marginal product. বা বস্তুর ক্রমহ্রাসমান আবেদন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের অনেকের অবস্থাও এরকম। আপনি সুস্থ আছেন, ভালো আছেন তবুও শুকরিয়ার অভাব কৃতজ্ঞতার অভাব। দশম আপেলের মতো জীবনও স্বাদহীন লাগছে কারো কারো কাছে।
অথচ একবার যদি চারপাশটা আমরা পর্যবেক্ষণ করি তাহলেও কি এই কৃতজ্ঞতাহীনতা থাকে?
এই চলমান স্থবিরতায় কত মানুষজন যে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন; দৈনন্দিন জীবনে এসেছে কত মানুষের অপ্রত্যাশিত অবরোধ তাদের তুলনায় আমরা কি ভালো নেই? এই যে বেঁচে আছি তার মানে সীমাহীন সম্ভাবনা এখনো আমাদের ঘিরে রয়েছে। যে-কোনো সময়ই সেই সম্ভাবনার বিকাশ ঘটতে পারে আমাদের জীবনে।
বেঁচে আছি মানেই হলো নতুন একটা উপলব্ধির স্তরে পৌঁছতে পারি যে-কোনো সময়। বদলে যেতে পারে জীবন যে-কোনো মুহুর্তে। তবু কত কম শুকরিয়া আমাদের!
ইতালির ৭৪ বছর বয়সী একজন বৃদ্ধ কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হার্ট হাসপাতালে ভর্তি হলেন। এবং কিছুদিন পর সুস্থ হলেন।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার সময় তিনি হঠাৎ করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। সবাই ভাবলেন, হাসপাতালের ভেন্টিলেটারে পাঁচ হাজার ইউরো বিল দেখে তিনি ভেঙে পড়েছেন।
কিন্তু তিনি বললেন, না! পাঁচ হাজার ইউরোর অনেক বেশি দেওয়ার সামর্থ্য আমার আছে। আমি ভাবছি, এই ৭৪ বছর বয়স পর্যন্ত আমি প্রত্যেক মুহুর্তে সৃষ্টিকর্তার দেয়া অক্সিজেন গ্রহণ করেছি বিনামূল্যে। কিন্তু কখনো ধন্যবাদ দেই নি। শুকরিয়া করি নি।
প্রভুর এই করুণাকে নিজের নির্ধারিত প্রাপ্য বলে পাত্তাই দিই নি। অথচ আজ মাত্র দুদিন ভেন্টিলেটারে কৃত্রিমভাবে শ্বাস নেবার জন্যে আমাকে পাঁচ হাজার ইউরো দিতে হচ্ছে। প্রভু হে! ক্ষমা করো। কত অকৃতজ্ঞ আমি!
এই যে আমার নির্ধারিত প্রাপ্য বা আমারই তো মানসিকতা এই আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতা আমাদেরকে অসুখী করে, একা করে, ব্যর্থ করে, অসুস্থ করে।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মানুষ যত কৃতজ্ঞচিত্ত হয় তত সে সুস্থ থাকে। তার সুস্থ থাকার ক্ষমতা দ্রুত বেড়ে যেতে থাকে যদি শুকরিয়া বোধ তার ভেতরে জাগ্রত থাকে।
অপরপক্ষে তার অসুস্থতা বেড়ে যায় যদি সে থ্যাংকফুল বা কৃতজ্ঞ না হয়। কারণ অকৃতজ্ঞতা মানুষের ভেতরে ভেতরে স্ট্রেস সৃষ্টি করে। এই চাপা স্ট্রেস তার ইমিউন শক্তি বা রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। তাই আসুন কৃতজ্ঞ হই।
ভেন্টিলেটার ছাড়া শ্বাস নিতে পারছি শুকরিয়া করি। ভাইরাস আক্রমণ করেছে বা করে নি সুস্থ আছি তো! শুকরিয়া করি। ঘরে বসে আছি, গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হই। সম্ভাবনাগুলোকে অনুধাবন করি। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।
যত বেশি শুকরিয়া করব তত সুস্থ থাকব ভালো থাকব আনন্দে থাকব।
যখন শুকরিয়া করব, শুকরিয়া করার কারণও তখন বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ জীবনে প্রাপ্তিও তখন বেশি বেশি ঘটবে।
এখন সময় নবোউদ্যমে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি। সামনে খুব ভালো সময় আসছে। সময়টাকে সফলভাবে কাজে লাগাতে হবে। আর তাই তাই আসুন শুকরিয়া করে মন প্রশান্ত করি। প্রভুকে বলি, তুমি যা দিয়েছ প্রভু তার জন্যে শুকরিয়া। যা দাওনি তার জন্যে আরো বেশি শুকরিয়া।
সুস্থতা, আনন্দ, সাফল্য আমাদের আলিঙ্গন করবে ইনশাল্লাহ।