স্রষ্টার চাকরি

অবশেষে প্রতিষ্ঠানটা ছেড়েই দিলাম। অনেকেই বলছিলেন, নিয়মিত স্টাফ হতে শুরু করে শিক্ষার্থী, এমনকি যারা নিয়মিত ক্লাস নেন তারাও। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকলে কোনো লাভ নেই, কোনো সুযোগ সুবিধা নেই, বেতন কম, সময় দিতে হয় বেশি, দিন শেষে কোনো ভুল হলে যেন ‘যত দোষ, নন্দ ঘোষ’, কোনো সম্মান নেই। শিক্ষার্থীরা একটু আধটু সম্মান করে বটে কিন্তু তাও ক্লাসে। ক্লাস ছেড়ে বেড়িয়ে গেলে শিক্ষকের শব্দ উচ্চারণ থেকে শুরু করে শার্টের আস্তিন গোটানোও যেন হয়ে ওঠে আলোচনার বিষয়। আর ধমক দিলে তো কথাই নেই, নালিশ চলে যাবে এস.আর.ও (স্টুডেন্ট রিলেশনশিপ অফিসার) হয়ে সোজা রেজিস্ট্রারের কাছে। তিনি ডেকে তো ঝাড়বেনই, সাথে ডিপার্টমেন্টাল হেডকেও শুনিয়ে দেবেন কড়া কথা। এর মাঝেও হাসিমুখে করে যাচ্ছিলাম নিজের কাজটুকু। হাজার হলেও গুরুজী বলেছেন বিতর্কে না জড়াতে, অন্যের সাথে খারাপ ব্যবহার না করতে, কোন প্রতিদান প্রত্যাশা না করতে, রাগ-ক্ষোভ এড়িয়ে চলতে, আর ‘বস ইজ অলওয়েজ রাইট’ এই কথাটি মনে রাখতে। তাই প্রতিদিন সকালে গিয়ে কেউ যাক কি না যাক ঠিকই গিয়ে রেজিস্ট্রারকে সালাম জানিয়ে কুশল বিনিময় করে আসতাম। এটা হয়ে গিয়েছিল নিত্যদিনের অভ্যাস।

এরই মাঝে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারপারসন ম্যাডাম বললেন রিসার্চ করতে হবে। কম্পিউটার নেই, ইন্টারনেট নেই, ডিপার্টমেন্টের সকল শিক্ষক বললেন এভাবে কি চলে? শুরুতে নিজ উদ্যোগে কিছু কাজ এগোনোর পরেও দেখলাম কারো কোনো আগ্রহ নেই। তখন থেকে নেতিবাচকতা যেন মনের অগোচরেই দানা বাঁধা শুরু করল। মনে হলো আর নয়, এবার অন্য কোথাও। শুরু হলো খোঁজ। ভাবলাম রমজানের প্রথম দিনটিতে একান্তে কাটাব স্রষ্টার ছায়াতলে। এরই মাঝে অনেক সুযোগ-সুবিধা বেতন-সম্মানসহ সুযোগ পেয়ে গেলাম আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। পূরণ হলো স্বপ্ন, একই সাথে রমজানে লামায় যাবার এক অনন্য সুযোগ স্রষ্টা তৈরি করে দিলেন।

লামায় গিয়ে ধ্যানে বসে আছি, আধো রোদ আধো মেঘের সাথে চমৎকার ঝিরঝিরে বাতাস। প্রশান্ত মনে তখনও যেন চলছে চিন্তার সুনামি। জীবনের লক্ষ্য নিয়ে ভেবেছি বহুবার, জানি কী করতে হবে। গুরুজী বহুবার বিভিন্ন আলোচনায় বলেছেন জীবন একটাই, জীবন হচ্ছে একটা দায়িত্বের নাম। লক্ষ্য নিয়ে ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ কোত্থেকে যেন উদয় হলো চাকুরির ব্যাপার। আরে এই তো জীবনটা হলো এক চাকুরি, স্রষ্টার চাকুরি। নিজের মনে প্রশ্ন জাগল স্রষ্টা আমাদের অনেক ভালো রেখেছেন এবং অনেক কিছুই দিয়েছেন। যা দিয়েছেন তা কী ভোগ করার জন্য? নাকি কাজ করার জন্য?

কোনো প্রতিষ্ঠানে কারো যদি বেতন-সুযোগ-সুবিধাদি বাড়ানো হয় তা কীসের জন্য? সেই সুবিধাতে গা ভাসানোর জন্য নাকি তাকে দিয়ে বেশি ও বিভিন্ন প্রকৃতির কাজ করানোর জন্য?

কাজের ধরণ দেখলে দেখা যায়, কোনো ম্যানেজারের বেতন হয়তো প্রতি মাসে ১০ লক্ষ টাকা। কিন্তু তার কাজের পরিমাণ কতটুকু? বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সিইও দের বেতন অনেক, কিন্তু কাজ কী কম? একজন সাধারণ বেতনভোগী হিসাবরক্ষক হয়তো ৫ কোটি লিখতে গিয়ে একটি শূন্য কম দিয়েছেন। জবাবদিহিতা কিন্তু আসবে এই সিইও এর ওপর। যতদিন তিনি তার দায়িত্ব সুন্দরভাবে পালন করবেন ঠিক ততদিনই তিনি দায়িত্বে থাকবেন। আর যদি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন তাহলে এক মূহুর্তের জন্যও চাকুরি থাকবে না।

আর স্রষ্টা? তিনি তো আমাদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে। তিনি তো আমাদের কাজও দিয়ে পাঠিয়েছেন। কর্মপদ্ধতি ভালোভাবে বোঝার জন্য দিয়েছেন পবিত্র কোরআন। এই পদ্ধতি যে আসলেই কাজে লাগানো যায় তা প্রমাণ করে দেখানোর জন্য পাঠিয়েছেন মহানবী (স)-কে। তার কাজ অর্থাৎ চাকুরির ভাষায় জব ডেসক্রিপশনও কিন্তু নির্দিষ্ট–প্রথমত, তাঁর শুকরিয়া আদায় করো; দ্বিতীয়ত, তাঁর সৃষ্টির রক্ষণাবেক্ষণ করো। এই কাজের উপরের লেভেলে কিছু মানুষ থাকেন, মাঝের লেভেলে থাকেন কিছু মানুষ আর নিচের লেভেলে থাকেন কিছু মানুষ। যারা ভালোভাবে কাজটি করতে পারেন তাদের স্রষ্টা প্রমোশন দেন আরো বেশি সম্পদ দেন। কিন্তু তিনি অতি দয়াময় যার ফলে ঠিকমতো যারা কাজ করতে পারেন না তাদের সাথে সাথে ডিমোশন দেন না। বিভিন্ন সংকেত দিয়ে তাদের বোঝাতে চান যে কাজ করা প্রয়োজন। ভালো কাজ করলে তার ফল তিনি দেন, খারাপ কাজ করলেও তার ফল তিনি দেন। কোনো প্রতিষ্ঠানের যেমন মালিক থাকেন তিনিও যেন এই মহাবিশ্বের মালিক। আমরা সবাই তার কর্মচারী।