রক্তঋণ। রক্ত দিন।

published : ৮ অক্টোবর ২০১২

নয় বার রক্ত দিয়েছি। নিয়মিত। দশ বারের বার এসে অ্যালার্জি এটাক এর কারণে দিতে পারছি না প্রায় এক বছর ধরে। আল্লাহকে বলেছি আমাকে সুস্থ করে দিলে তো রক্ত দিতে পারব। তিনি শুনেছেন। সুস্থ হচ্ছি। কল্পনাতীত গতিতে। পুরাপুরি হই নি। নিজে দিতে পারছি না, কিন্তু আপনাকে তো বলতে পারছি। আপনি যদি দেন, আমার কথা শুনে, আমি হয়তো কিছুটা পরিত্রাণ পেতে পারি, আমার দায়বদ্ধতা  থেকে।

মনে পড়ছে মায়ের কথা। যে বুকে আগলে রেখেছিল, যার বুকের দুধ আমার রক্ত হয়েছে, যার ঋণ আমি শোধ করতে পারি না। শুধু যদি দুধের কথাই ধরি, যা কিনা তার রক্তকণা উজাড় করে আমার রক্ত গড়েছে, এর প্রতিদান কী হতে পারে! রক্ত ছাড়া!

বাবার রক্ত ঘাম হয়ে ঝরেছে আমাকে মানুষ করতে। আমার শিক্ষক থেকে শুরু করে দারোয়ান, গৃহকর্মী, রিকশাওয়ালা—সবার শ্রম, ঘাম, রক্ত, আমাকে এত দূর এনেছে। কতটুকু রক্ত আমার আছে তাদেরকে দেবার?

একটি শিশু। সজল দিঘির চোখ, মায়াবি সরল চাহনি, আধো আধো বোল, তার কোমল স্পর্শ—কত সুন্দর, কত পবিত্র সে! কাছে যখন সে ছুটে আসে, আদর করে গলা জড়িয়ে ধরে, চুমো খায়—স্বর্গসাধ মিটে যায়। এই থ্যালাসিমিক দেবশিশু মিনতি করে, তার রক্তস্রোত যেটা আমি আটকে রেখেছি, সেটা ছেড়ে দেবার জন্যে। তার মিনতি স্বর ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসে। তার সব পবিত্রতা নিয়ে সে আবার স্বর্গে ফিরে যায়। শুধু আমার স্বার্থপরতার জন্যে। পারি কীভাবে এভাবে বেহেশতের ফুল মেরে ফেলতে? কি জবাব দেবো স্রষ্টার কাছে? বিবেকের কাছে? স্বর্গের হাওয়া কি আমার সইবে?

আমার যে ভাইদের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আর স্বাধীনতার রক্ত ঝরানো দিনগুলি—তারা কি একজনের পর একজন, বার বার, এতবার, কানে কানে বলে যায় নি, “শিখে নাও, তোমারও সময় আসবে রক্ত দেবার”? যে শপথ ছিল ভাইয়ের কাছে, সেটা যে কত বড় ঋণ, শোধ না করা পর্যন্ত শান্তি পাই কোথায়?

আমার যে এত মানুষের কাছে রক্ত ঋণ রয়ে গেছে সেটার কথা যদি বাদও দেই, প্রকৃতির কাছে যে ঋণ তার কণাও কি শোধ করতে পারি? স্রষ্টা মহান। তাই তিনি কিছু প্রতিদানের সুযোগ আমাদের এমনিতেই করে দিয়েছেন। খাবার ফিরে যাচ্ছে মাটিতে মল মূত্র হয়ে। শ্বাসপ্রশ্বাস হয়ে আবার গাছের খাবার হচ্ছে।
 
আসলে এতে শুধুই তাঁর মহত্ত্ব। কিন্তু রক্তঋণ শোধ করাটা আমার ইচ্ছার অধীন করে আমাকেই মহৎ হবার সুযোগ করে দিয়েছেন। কি অবস্থাই না হতো যদি এই ঋণশোধ আমার উপর বাধ্যতামূলক করা হতো আর হাত কেটে সেটা রক্তধারায় পরিশোধ করতে হতো? অথবা যদি দেবতা দেবদূত পাঠাতেন আর সে ছুরি নিয়ে এসে বলত, “দিয়ে দে”, কী যে হতো!

কিন্তু স্রষ্টা সেটা কখনই করবেন না। তিনি আমাকে দায়িত্ব দেবার সাথে সাথে স্বাধীনতাও দিয়ে দিয়েছেন। এটা নিয়ে তিনি ঐ দিনই বিচার করবেন যে, “আমি রক্ত চেয়েছিলাম, তুমি দাও নি”।
 
ভগবান রক্ত পরিসঞ্চালনের চমৎকার ব্যবস্থাও শিখিয়েছেন। আমার পরম সৌভাগ্য যে রক্ত পরিসঞ্চালন এখন দাতা ও গ্রহীতা উভয়ের জন্যেই অনেক নিরাপদ। কোনো ভয় নেই। আর ভয় পেলেও কিছু করার নেই। ঋণ তো!

অনেক আগে একটা গল্প শুনেছিলাম। সত্য মিথ্যা জানি না। গল্পটা হলো এইরকম। এক দুরাচারী ক্ষমতাধর রাজা। পুরো বিশ্ব তার রাজত্ব। দম্ভে সে একদিন খোদাকেও শেষ করে দিতে বিশেষ রকম ফানুসে চড়ে উঠল আসমানে। তীর ছুঁড়ল দেবতার আসন লক্ষ্য করে। তিনি সেটা ধরে তাতে রক্ত লাগিয়ে দিতে বললেন। ধরা হলো। দেবদূত ছুটলেন রক্ত আনতে। পশুপাখি কেউ রক্ত দিবে না। এমন কি শক্তিশালী রক্তখেকো বাঘও রক্ত দিতে ভয় পায়। তখন জলের মাছ এগিয়ে এল। সে রক্ত দিল। দেবদূত সেটা তীরের ফলায় লাগিয়ে ফেরত পাঠালেন। রাজা তো রক্তমাখা তীর পেয়ে মহাখুশি। সে দেবতা কে শেষ করে দিয়েছে। এখন সে-ই দুনিয়ার ভগবান। আসলে স্রষ্টা যদি চান কাউকে তিনি মরীচিকার পেছনে রাখবেন, সে তাতেই থাকবে। কেউ ফেরাতে পারবে না। তো তা-ই হল। রাজাও ভ্রমের পেছন ঘুরতে ঘুরতে সব অহঙ্কার নিয়ে একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। এইদিকে, তখন, মাছ যেহেতু রক্ত দিয়েছে, দেবতার আদেশ পালন করেছে, দেবতা তাকে মহৎ করে দিলেন। বললেন, “তুমি মরে গেলেও পবিত্র। অন্য জীবজন্তু জীবিত থাকা পর্যন্তই মানুষের ঘর পর্যন্ত যেতে পারবে। মরে গেলে শেষ। মৃত জন্তু কেউ খাবে না। কিন্তু তুমি মাছ, যে কিনা একমাত্র যে মরে গেলেও পবিত্র খাদ্য হিসাবে সম্মানিত হবে”।
 
সামান্য মাছ যদি তুচ্ছ রাজার প্রলোভন হয়ে গিয়ে মৃত্যুকে মহিমান্বিত করতে পারে, আমি তো মানুষ, সৃষ্টির সেরা, আমি যদি মহামূল্যবান জীবন বাঁচাই, আমি তো রক্ত দিয়ে অমরত্ব আর অমরা দুটোই কিনে নিতে পারব অনায়াসে।

উঠে দাঁড়ান। শার্টের হাতা গুটিয়ে নিন। ব্লাড ল্যাবে চলে আসুন। হাত নয়, বুক পেতে দিন, সুখ আলিঙ্গন করুন।

রক্তঋণ। রক্ত দিন।