কাজীর গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই!

একবার গিয়েছি এক আত্মীয়ার বাসায়। কথা প্রসঙ্গে ভদ্রমহিলা বললেন তার মেয়ের কথা। কথা তো না, কষ্ট-সংগ্রামের কাহিনী। কী রকম? স্বামীর বাসায় মেয়েকে নাকি অনেক কাজ করতে হয়। নতুন বৌ হয়েও তাকে নাকি রান্নাবান্না করতে হয়, ঘরদোর সাফ করতে হয়, আবার ভোরবেলা শ্বশুরমশাইয়ের জন্যে চা-ও বানাতে হয়! ভদ্রমহিলার আফসোস—তার মেয়েকে সাহায্য করার জন্যে বাড়তি একটা কাজের লোক কেন রাখা হলো না!

এখন, আমি অবাক হলাম, এই যে কথা হচ্ছে এর মধ্যে উনার ছেলের বউ আমাদের চা-নাস্তা দিল, ঘর ঝাড় দিল, কাপড় ধুয়ে বারান্দায় শুকাতে দিল, তারপর রান্না বসানোয় দেরি করার জন্যে তার শাশুড়ির, মানে ঐ ভদ্রমহিলার বকাও শুনল। সামনে বসে আমি বিব্রত হলাম, সেই সাথে আশ্চর্য হলাম ভেবে যে, যে মহিলা নিজের মেয়ের আরামের জন্যে বাড়তি কাজের লোক খোঁজ করছেন, তিনিই আবার “বাসায় তেমন কোনো কাজ নেই” এই বাহানায় কাজের লোক রাখছেন না এবং সবকিছু করার পরও ছেলের বউয়ের ‘অলসতা’ আর ‘আহ্লাদীপনা’য় ত্যক্তবিরক্ত হচ্ছেন! এটা ছিল ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’ অর্থাৎ নিজের মেয়ের জন্যে এক নিয়ম আর ছেলের বউয়ের জন্যে আরেক নিয়ম–এর নমুনা।

আবার আরেক রকম লোক আছেন যারা মুখে বড় বড় বুলি আওড়ান কিন্তু বাস্তবে তা মান্য করেন না। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না যে অনেক বড় বড় ব্যক্তিও আছেন এই দলে। যেমন, ধূমপান প্রতিরোধের উপর বিশাল বক্তৃতা দিয়ে এক বুদ্ধিজীবী নিজেই দুপুরে খাওয়ার পর সিগারেট ধরালেন! কেন? কারণ তার ধারণা হলো তিনি যেহেতু সাধারণ মানুষের ‘বুদ্ধির অতীত’, অতএব সাধারণ নিয়মকানুন তার বেলায় খাটে না। আবার এমন লোকও আছেন, যার আন্তরিক ব্যবহার আর বিনয়ে সবাই মুগ্ধ, “মেডিটেশন করার পর আমি কখনও রাগি না”–এই বলে তিনি কোয়ান্টামে ভীষণ জনপ্রিয়; অথচ তিনিই নাকি বাসায় স্ত্রীর গায়ে হাত তোলেন।

এরকম উদাহরণ আরও বহু আছে। আমরা নিজেরা খুব কমই যা বলি তা মান্য করে চলি। বেশিরভাগেরই মুখে একরকম আর বাস্তবে আরেকরকম। কাউন্সেলিংয়ের বেলায় দেখি অনেক বাবা-মা অভিযোগ করেন ছেলেমেয়ে কথা শুনে না। এক মহিলা বললেন তার মেয়ে মারাত্মক অলস- “পড়ালেখার নাম নেই, শুয়ে/ বসে সারাদিন কাটায়”। এখন মেয়েকে যখন আলাদা করে জিজ্ঞেস করলাম,“মা, এরকম কেন কর?” তো সে বলে যে, “আমি যেহেতু বড় হয়ে ‘হাউসওয়াইফ’ হবো, অতএব আমার এত পরিশ্রম করার কী দরকার?”

তো, হাউসওয়াইফদের যে পরিশ্রম করতে হয় না–এ ধারণা তার কেন হলো? কারণ সে দেখে যে, কাজের লোকদের সাথে চিৎকার করা ছাড়া তার মার নাকি কোনো কাজ নাই। তার মা দুপুরে ৩/ ৪ ঘন্টা ঘুমান, সন্ধ্যায় ওপরতলার ফ্ল্যাটে গল্প করতে যান এবং রাতে ৭টা থেকে ১১টা পর্যন্ত হিন্দি সিরিয়াল দেখেন। এই করে যেহেতু তার মা বেশ সুখে আছে কাজেই জীবনে পরিশ্রম করার কোনো প্রয়োজন আছে কী? এখন এই মেয়েকে আমি কী পরামর্শ দেবো? এটা তো ঐরকম হলো যে, ছেলে কথায় কথায় মুখ খারাপ করে দেখে বাবা বকছে, “অই শালা .. বাচ্চা, তোরে না কইছি গালাগালি করবি না? ..কথা কানে যায় না?”

কাজেই যেটা বলব সেটা মান্য করতে হবে। আমাদের নবীজী এক বৃদ্ধার তরুণ পুত্রকে ‘মিষ্টি কম খাওয়া’র নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনদিন ধরে ডেকে আনার পর, তৃতীয়দিনের দিন। কেন? কারণ আগে তিনি নিজে সেটা অনুসরণ করেছিলেন। এজন্যে তার কথায় মানুষ বদলেছে। নইলে মুখে যতই বলি, বাস্তবে গোয়ালে না থাকলে ঐ “কেতাবের গরু”র কোনো মূল্য নেই। কারণ মানুষ সবসময় আপনি ‘কী বলেন’ সেটা না, ‘কী করেন’ সেটা অনুসরণ করে।

সেজন্যে “আমার কথাকে কেউ পাত্তা দেয় না” –এমন অভিযোগ করার আগে যাচাই করে নিবেন আপনি সেটা মান্য করছেন কিনা। যদি না করে থাকেন তাহলে একটা না একটা সময় এই ভন্ডামির মুখোশ কিন্তু উন্মোচিত হবে, আপনিও অপমানিত হবেন। আর সেই রাখাল বালকের মতন যেটা সত্যি সত্যি বলেছিলেন সেটাকেও সবাই অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে দেখবে।