যে যায় লংকায়, সেই হয় রাবণ!

বাবা যে আমার কোনো আদর-আহ্লাদকে প্রশ্রয় দেন না তা না। কিন্তু প্রতিবারই তার হাজারটা প্রশ্ন থাকে। ‘খাতা কিনব ৪০ টাকা দাও’- এ বলে কখনও সাথে সাথে টাকা পাই নি। কীসের খাতা, কী করব, এত টাকা কেন—এগুলোও তার জানা চাই। এগুলো হচ্ছে অভ্যাসের প্রশ্ন, কারণ ৫০ হোক আর ৫০০ হোক অথবা টাকা ছাড়া অন্য কিছুই হোক এগুলো সব সময়ই তার মুখে থাকে। যখন মন ভালো থাকে আমি ধৈর্য ধরে উত্তর দেই, নইলে বিরক্ত হই; উঠে চলে আসি। বাবা কিন্তু ঠিকই টাকা দেন। আমি উল্টোপাল্টা কিছু করব না জেনেও তিনি সারাক্ষণ আমাকে প্রশ্নের উপর রাখেন। যদি খারাপ হওয়ার হতো তাইলে কী এতগুলো বছর বসে থাকতাম? স্কুল গেল, কলেজ গেল—এখন কী ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে আমি খারাপ হবো? তাই বাবাকে খাওয়ার টেবিলে বলি, “আমি বাবা হলে দেখো ‘বাবা’ কীভাবে হতে হয়। তোমার মত অহেতুক সন্দেহপ্রবণ আর হিটলারি-মেজাজের কখনও হবো না”। আমার বাবা হেসে বলেন, “আমিও তাই ভাবতাম”!

তা-ই তো, যা ভাবি তা কী করা হয়? ঐ যে গুরুজী বলেন না, তরুণ বয়সে সবার মনেই অবিশ্বাস আসে। এ অবিশ্বাস সমাজের প্রথার বিরুদ্ধে, শ্রেণীকরণের বিরুদ্ধে, ভুল-অনাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে। সবাই চায় সমাজকে বদলে দিতে, অনেক বড় কিছু করতে, মানুষকে সাহায্য করতে। কিন্তু কয়জন তা পারে? তারুণ্যের অবিশ্বাস আস্তে আস্তে পরিণত হয় লোভ আর স্বার্থপরতায়। শুনতে খারাপ লাগে, কিন্তু সত্যি তো সেটাই। যত বয়স বাড়তে থাকে তত চাওয়া বাড়ে। পাই-পাই-চাই-চাই করতে করতে ‘অনেক বড় কিছু’ করে আর ‘সমাজকে বদলে দেয়া’ হয় না। চিন্তা তখন কেবলই গাড়ি-বাড়ি-বাচ্চার স্কুল নিয়ে ঘুরপাক খায়। অথচ তরুণ বয়সে মনে হয় সবাই ওরকম হলেও আমি হবো না।

সেটাই কিন্তু সবক্ষেত্রে হয়। আমরা ভাবি যেটা সবার জন্যে হয়েছে সেটা আমার বেলায় হবে না। ফেসবুকের ব্যাপারে যখন নিষেধ করা হলো তখনও অনেকে ভেবেছি-আরে, আমি কী আর অত ফেসবুকিং করি? আমার অ্যাকাউন্ট আছে- থাকুক! কিন্তু সেই ‘কিছু না’ করতে করতেও এখন ঘন্টার পর ঘন্টা পেরিয়ে যায়—আমাদের ফেসবুকিং শেষ হয় না; বন্ধু তালিকা ৬০০ পেরিয়ে যায়—তবুও ‘রিকোয়েস্ট’ শেষ হয় না!

একটা গান আছে না, “ইতনা শোর হ্যায় কিউ, ইতনা হাঙ্গামা হ্যায় কিউ-থোরা সা জো পি লিয়া”। আরে ‘থোরা-থোরা’ করতে করতে কখন যে ‘বহুত-বহুত’ হয়ে যায়—সেই ঠিকানা থাকলে কী আর আমাদের পা পিছলায়? ভালো-ভালো বন্ধুদের দেখলাম, একসময় যারা আমাদের বাসায় উদাহরণ ছিল, তারাও আজ দিনে ১০/ ১২টা বিড়ি টানে। ঐ যে- ‘আমি কী আর ধূমপায়ী হবো? একটু জাস্ট টেস্ট করে দেখি-’ এই আশায় ‘দোস্তে’র সাথে একদিন একটুখানি চেখেছিল। এরপর আদ্ধেকটা তারপর পুরোটা হতে হতে এখন তারা অ্যাডিক্ট।

একবার এক আত্মীয়ের বিয়ের ব্যাপারে কথা হচ্ছে। তো মেয়ের বাবা একটু পরপর জিজ্ঞেস করছেন ছেলের পরিবারে নানা/ দাদা বা চাচা/ মামা পুলিশে আছে কিনা। এই অতিরিক্ত জেরার কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, তিন পুরুষের মধ্যে পুলিশে কেউ থাকলে তিনি মেয়ে বিয়ে দিবেন না। কারণ একজনও যদি থাকে তাহলে নাকি ঐ পরিবারের সবাই খারাপ হয়। শুনে অবাক হলাম, হয়তো তার ব্যক্তিগত কোনো বেদনাদায়ক স্মৃতি আছে–এজন্যে এই বিতৃষ্ণা। কিন্তু তার ব্যাখ্যাটা বেশ চমৎকার। তিনি বললেন যে, বাসায় যখন একবার ঘুষের টাকা আসতে থাকে তখন ঐ পরিবারের সবার কাছেই ব্যাপারটা ‘স্বাভাবিক’ মনে হয়। এজন্যে ওরা যে কাজটা করে যায়–শুধু তাই না, এ কাজটা তারা খুব সহজভাবেই করে যায়। তখন আর এটাকে কোনো ‘ব্যাপার’ বলেই মনে হয় না। এজন্যে দুই পুরুষ আগেও যদি একজন অসৎ পয়সা কামায় তাহলে সেটাও পুরো পরিবারের মূল্যবোধের উপর প্রভাব ফেলে। আসলে উনার মত পুলিশ-পেশাটার উপর আমার কোনো ব্যক্তিগত ক্ষোভ নেই; আমার এক জিগরি-বন্ধুর বাবা আছেন এ পেশায়। তাকে দেখেছি রাত দেড়টায়ও যদি কল আসে—উনার কোনো অভিযোগ নাই। হাসিমুখে বাসা থেকে বেরোবেন এবং ছেলের মাথায় হাত দিয়ে ‘খোদা হাফেজ’ বলে যাবেন। তবে বিয়েবাড়ির ঐ ভদ্রলোকের চিন্তার সাথে আমি একমত। প্রথমদিকে সবাই ‘না-না’ করলেও একসময় অধিকাংশই সততার সাঁকো পার করে অন্য পারে চলে যান।

আবার ধরুন, খুব ছোটখাটো ঘটনায়ও আমরা কিন্তু আলাদাভাবে ভাবতে পারি না, অন্য সবার মতো হুবহু একই আচরণ করি। যখন নিজে শ্রোতা থাকি তখন ঝুরি ঝুরি ভালো কথা বেরোয়—মাথা ঠান্ডা রাখলেই হতো, এত রাগারাগির কী ছিল! কিন্তু নিজে যখন ঘটনার শিকার হই তখন কিন্তু আর ঐসব বুলি মাথায় থাকে না। তখন ঠিকই মুখ খারাপ করি, জিনিস ভাঙচুর করি, ‘গরম’ দেখাই।

কেন করি এমন? কেন খারাপ জেনেও সবাই আমরা একভাবেই আচরণ করি? ‘আমি অমন করব না’ ভেবেও শেষমেষ গড্ডালিকা প্রবাহে কি ঠিকই গা ভাসাই না? এই যে এতগুলো ঘটনার কথা শুনলাম তার মধ্যে এটাই তো মিল। পরিস্থিতির শিকার আমরা সবাই। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে পরিবেশের যে শেকল, সেই বেড়ি নিজেরা সাধ করে গলায় পরি। কারণ সবাই মুখে মুখে ‘আমি অন্যদের চেয়ে আলাদা’ বললেও, ‘আলাদা’ হওয়ার কোনো চেষ্টা বাস্তবে করি না। এজন্যে ৯৮% লোক থাকে একপাশে আর একজন-দুইজন থাকেন আলাদা—যারা মাথা ঠান্ডা রাখেন, সারাক্ষণ একসাথে থেকেও হাঁসের পানি ঝাড়ার মত সঙ্গদোষকে ঝেড়ে ফেলতে পারেন, পরিবারে সহনশীল হন, আর নিজের পেশাটাকে স্বেচ্ছাচার না ভেবে ‘দায়িত্ব’ মনে করে করে যান। প্রশ্ন হলো, আমিও কি যে-কোনো পরিস্থিতিতে নিজের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, নাকি “লংকায় গিয়ে রাবণের মুখোশই মাথায় চড়াই”?