ভার্চুয়াল প্রেমের ফাঁদপাতা ভুবনে

ঘটনা-১

১৪ বছরের কিশোরী নাসিমা (ছদ্মনাম)। পড়ে ক্লাস টেনে। ফেসবুকের মাধ্যমে এক যুবকের সাথে পরিচয়। সেখান থেকে প্রেম। এক পর্যায়ে দুজন দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয়। নির্দিষ্ট দিন নির্দিষ্ট জায়গায় ছেলেটির সাথে দেখা করতে যায় নাসিমা। অতপর ঘোরাঘুরি, কিছুক্ষণ কথা বলার পর একসময় নাসিমাকে নিয়ে ছেলেটি একটি বাসায় যায়। সেখানেই তাকে ধর্ষণ করে ছেলেটি এবং রক্তাক্ত অবস্থায় একটি হাসপাতালে ফেলে পালিয়ে যায়। পরে তার পরিবারের লোকজন এসে নাসিমাকে উদ্ধার করে।

ঘটনা-২

ঢাকার একটি জেলাশহরে বসবাসরত প্রতিষ্ঠিত একজন ব্যাংক কর্মকর্তার ১৮ বছরের তরুণী কন্যা ঐশী। ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয় ঐ শহরেরই জনৈক সিকিউরিটি গার্ডের যুবক ছেলের সাথে। এরপর থেকে ফোনে কথা হতো। একদিন দেখা করে তারা। পরদিনই ঐশীকে শহরের একটি আবাসিক হোটেলে আসতে বলে ঐ তরুণ। ঐশী গেলে তাকে হোটেলের একটি কক্ষে নিয়ে ধর্ষণ করে যুবক। এরপর ছিনিয়ে নেয় তার দামি মোবাইল ফোন, স্বর্ণের গয়না ও টাকাপয়সা। ছেলেটি চলে গেলে কক্ষের ভেতর সিলিং ফ্যানের সাথে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে ঐশী। নিজের সম্মানহানি, পিতামাতার সম্মানহানি এসব ভেবেই সে আত্মহত্যায় বাধ্য হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে পরে জানা যায়, ঐশী ছাড়াও ঐ যুবক আরো ১২টি তরুণীর সাথেও একই কায়দায় প্রেমের ভান করে ফুসলিয়ে তাদেরকে ধর্ষণের পর তাদের টাকাপয়সা ছিনিয়ে নিয়েছে।

ঘটনা-৩

বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ বখতিয়ার। দেখতে শুনতে বেশ স্মার্ট এই যুবকটির বাবা একজন শ্রমিক। এখন প্যারালাইজড হয়ে ঘরে বসে আছেন। বড় ভাই তাই নিজের লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে গাজীপুরে একটি পোশাক কারখানায় ছোট একটা চাকরি করে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবাবদ প্রতিমাসে যে বিপুল পরিমাণ টাকা তার লাগবে, তা যোগাড়ের জন্যে বখতিয়ার এক অভিনব প্রতারণার ফাঁদ পেতে বসল। ফেসবুকের মাধ্যমে প্রেমের সম্পর্ক গড়ল ১৫ বছরের কিশোরী রিতার সাথে। সরলবিশ্বাসী তরুণীটি তাকে প্রেমিকের মতোই দেখতো। কিন্তু বখতিয়ার সবসময় বলতো, আমি তো গরীবঘরের সন্তান। যে-কোনো সময় তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে। শুনে মেয়েটি তাকে নানাভাবে বোঝাতে চাইত। কিন্তু বখতিয়ার সবসময় এই এক কথা তুলেই মেয়েটিকে মানসিক চাপে রাখত। একদিন বখতিয়ার মেয়েটিকে বলে, তুমি যদি সত্যিই আমাকে ভালবাস, তাহলে তোমার একটি নগ্ন ছবি আমাকে পাঠাও। সরল বিশ্বাসে মেয়েটি তার ছবি তুলে ফেসবুকের মাধ্যমে পাঠায় বখতিয়ারকে।

এরপর থেকে বদলে যায় বখতিয়ারের রূপ। ঐ নগ্ন ছবিটিই ছাত্রীটির ফেসবুকের ইনবক্সে পাঠিয়ে বখতিয়ার জানায়, ‘আমার সেমিস্টার ফির জন্য ২ লাখ টাকা লাগবে। তোমার এই ছবিটাও তো আমার কাছে আছে। এখন আমি কি করব?’ ছাত্রীটি ব্ল্যাকমেইলের বিষয়টি বুঝতে পেরে বখতিয়ারকে জানায়, ‘আমি এত টাকা কোথায় পাব! তোমাকে মাসে ১০ হাজার টাকা করে দেব।’ কিন্তু এতে রাজি না হয়ে বখতিয়ার ছাত্রীটিকে পরামর্শ দেয়, বাসা থেকে সোনার গহনা এনে দেবার জন্য, না হলে এই ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়া হবে। তার বাবা-মাকে জানানো হবে। ভীত হয়ে ছাত্রীটি তখন তার বাসা থেকে মায়ের ১২ ভরি সোনার গহনা চুরি করে তুলে দেয় বখতিয়ারের হাতে। কাতার থেকে আনা এই খাঁটি সোনার গহনা বখতিয়ার দুই দফায় ২ লাখ ৯১ হাজার টাকায় বিক্রি করে। এদিকে, বাসায় সোনার অলঙ্কার না পেয়ে ছাত্রীটির বাবা-মায়ের মধ্যে দাম্পত্য কলহ চরম আকার ধারণ করে। এ রকম পরিস্থিতিতে মেয়েটি একপর্যায়ে সবকিছু খুলে বলে বাবা-মাকে। এরপর তারা বিষয়টি জানায় আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষকে।

পুলিশ বলে বখতিয়ার ওই নগ্ন ছবি নিজের জিমেইল ও ইয়াহু একাউন্টে সংরক্ষণ করে রেখেছে। তাই কোনোভাবেই ওই ছবি সম্পূর্ণ মুছে ফেলা সম্ভব নয়। তার ল্যাপটপ থেকে আরেকটি মেয়ের বেশ কিছু নগ্ন ছবি উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ-ছাড়া তার আরো ৫/৬টি মেয়ে বান্ধবীর ঘনিষ্ঠ ছবিও উদ্ধার করা হয়েছে। বখতিয়ার স্বীকার করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার ফির টাকা সংগ্রহের জন্য সে এই কাজটি করেছে।

সোশাল মিডিয়াকেন্দ্রিক এখনকার সমাজজীবনের এক নৈমিত্তিক ঘটনা এখন এই প্রেম প্রতারণাগুলো। যারা এই ফাঁদে পড়ছে তাদের প্রায় সবাই কমবয়সী কিশোরী বা তরুণী। তারা ভাবছে, বিষয়টা শুধু আবেগিক বা মানসিক। আসলে পুরো বিষয়টিই জৈবিক, শারীরিক।

বিজ্ঞানীদের এখন এ নিয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই। ইউনিভার্সিটি অব নিউ মেক্সিকোর মনোবিজ্ঞানী জেফ্রি মিলার এ নিয়ে এক গবেষণা চালান। গবেষণার জন্যে তিনি বেছে নেন ১৮ জন পেশাদার ল্যাপ ডান্সারকে, নিউ মেক্সিকোর বিভিন্ন বার ও স্ট্রিপ ক্লাবে যারা ল্যাপ ডান্স দেখিয়ে উপার্জন করতো। এই মেয়েদের একেকজন একেকরাতে একেকরকম উপার্জন করতো। যেমন কেউ হয়তো একরাতে ৮০০ ডলার আয় করল, কিন্তু সে-ই হয়তো আরেকদিন ১৫০ ডলার পেল।

মিলার আসলে দেখতে চাচ্ছিলেন, একটি মেয়ে তার ঋতুকালীন সময়ে বেশি আয় করছে না অন্য সময়ে বেশি আয় করছে। কারণ আমরা জানি, ঋতুহীন বাদে অন্য সময়টাতেই একটি মেয়ে গর্ভধারণের জন্যে সবচেয়ে অনুকূল অবস্থায় থাকে। কারণ এসময় তার দেহে এস্ট্রোজেন নামে এক ধরনের হরমোন বেশি নিঃসরিত হয় যা তার ত্বককে কোমল করে, কাঠামোকে সুগঠিত করে এবং কোমর ও নিতম্বের চওড়া বাড়িয়ে তাকে আকর্ষণীয় করে তোলে।

মিলার দেখলেন যে, একজন ল্যাপ ডান্সার তার ঋতুকালীন সময়ে যা আয় করে তার অন্তত দুইগুণ আয় করে যখন যে ঋতুমুক্ত থাকে। কারণ সেসময় সে বেশি আকর্ষণীয় দেখায়। এখন প্রশ্ন হলো যে পুরুষরা তার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে, তারা তো তার ঋতু বা ঋতুমুক্ত কোনো অবস্থার কথাই জানে না। বা জানার কথাও নয়। তাহলে এটা কীভাবে ঘটছে?

এটা পুরোটাই ঘটছে আসলে মস্তিষ্কের জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। আবেগ বা মানসিকতার কোনো ভূমিকা এখানে নেই।

এমনকি সঙ্গী নির্বাচনের পর পরস্পরের প্রতি যে আকর্ষণ, সেটাও নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্কের এই জৈব রসায়নের মাধ্যমে। আর এ-ক্ষেত্রে যে হরমোনটি কাজ করছে, তার নাম অক্সিটোসিন। প্রেমে পড়েছেন এমন একদল পুরুষের দেহে বিজ্ঞানীরা এই হরমোনটি প্রয়োগ করে দেখেছেন যে, এর ফলে নিজ নিজ সঙ্গীনীর প্রতি তাদের আকর্ষণ বেড়েছে শুধু নয়, অন্য নারীদের প্রতি তাদের আকর্ষণ কমেছে, এমনকি কথা বলা বা স্বাভাবিক প্রয়োজনে অন্য নারীদের সাথে যোগাযোগ করতে হলেও সচেতনভাবেই তারা বেশি পরিমাণ শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখছেন।  

প্রশ্ন হলো, প্রকৃতি কেন এই কাজটি করছে? উত্তর হলো- সন্তানের কল্যাণের জন্যে। আসলে সন্তান সুষ্ঠুভাবে লালনের জন্যে মায়ের ভূমিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, বাবার ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রকৃতিও তা-ই মনে করে বলে সঙ্গী এবং সঙ্গীনীর মস্তিষ্কে বিশেষ এই হরমোন উৎপাদন করে পরস্পরের প্রতি তাদের আকর্ষণকে জিইয়ে রাখে।

কিন্তু সোশাল মিডিয়া এবং এ জাতীয় বায়বীয় জগতের বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী সব উপকরণের কারণে, এক কথায় যাকে ভার্চুয়াল ভাইরাসের সংক্রমণ বলা যায়, সেসবের কারণে প্রাকৃতিক এই সূত্রও বোধ হয় ব্যর্থ হবার পথে......