কৃষক-মজুর-মজলুমের বন্ধু শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক

published : ২৬ অক্টোবর ২০২৪

শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নাম শোনেন নি বাংলাদেশে এমন মানুষ বিরল। তিনি ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তবে মূলত কৃষক-মজুর-বঞ্চিতের প্রতি মমতার কারণেই তিনি সাধারণ জ্ঞানের বই থেকে উঠে এসে স্থান করে নিয়েছেন বাংলার মানুষের হৃদয়ে। 

‘শেরেবাংলা’ অর্থ বাংলার বাঘ; দৃঢ় ব্যক্তিত্ববোধ আর জ্বালাময়ী বাগ্মীতার কারণে এই উপাধী পান বাংলার সিংহপুরুষ আবুল কাশেম ফজলুল হক। উপাধী যে কখনো কখনো নামের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি।

ছিলেন তুখোড় মেধাবী 

ফজলুল হককে বলা হয় ফটোগ্রাফিক মেমোরির অধিকারী। কারণ একবার যা পড়তেন, দেখতেন বা শুনতেন তা কখনও ভুলতেন না। শিশু ফজলুল হক নাকি এক বই দুইবার পড়তেন না, যে বই পড়া হয়ে যেত তা ছিঁড়ে ফেলতেন!

তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় (মানে এখনকার মাধ্যমিক) তৎকালীন ঢাকা বিভাগে মুসলমানদের মধ্যে প্রথম স্থান দখল করেন। 

স্নাতকে গণিতশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা ও রসায়নশাস্ত্র এই তিনটি বিষয় নিয়ে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। এমএ-তে প্রথমে ভর্তি হন ইংরেজিতে।

ফজলুল হক এমএ ক্লাসে প্রথমে ভর্তি হয়েছিলেন ইংরেজি ভাষায়। পরীক্ষার মাত্র ছয় মাস আগে তাকে এক বন্ধু ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন যে, মুসলমান ছাত্ররা অঙ্ক নিয়ে পড়ে না, কারণ তারা মেধাবী নয়। এই কথা শুনে এ কে ফজলুল হকের জেদ চড়ে যায়। তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে, অঙ্ক শাস্ত্রেই পরীক্ষা দেবেন। এরপর মাত্র ছয় মাস অঙ্ক পড়েই তিনি প্রথম শ্রেণি লাভ করেন! 

শ্রুতিমধুর বক্তব্যের জন্যে বিচারপতিরাও ছিলেন মুগ্ধ 

১৮৯৭ সালে তিনি সিটি ল’কলেজ থেকে ডিস্টিংশন নিয়ে আইন পাস করেন। প্রখর মেধার কারণে ছাত্রজীবনে গভীর স্নেহ লাভ করেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের। 

তার আইন পেশার হাতেখড়ি হয় স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের শিক্ষানবিশ হিসেবেই। দুই বছর কাজ করার পর ১৯০০ সালে তিনি সরাসরি আইন পেশা শুরু করেন।

হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করলে খুব তাড়াতাড়ি চারদিকে নাম ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে তার উপস্থিত বুদ্ধি এবং কথাবলার ধরনটাই ছিল একটু অন্য রকম। বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে দেশীয় শব্দ ব্যবহার করে, আন্তরিকতা নিয়ে, ধৈর্যের সাথে এমনভাবে উপস্থাপন করতেন যে সাধারণ মানুষ তো হতোই— বিচারপতিরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতেন।

বিলাসিতা তাকে আটকাতে পারে নি

প্রথম জীবনে ফজলুল হকের চলাফেরা ছিল তৎকালীন ধনীদের সাথেই। নবাব সলিমুল্লাহর অন্তঃপুর পর্যন্ত তার অবাধ যাতায়াত ছিল। এসব অভিজাত সংস্পর্শই তাকে ১৯০৬ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদান করার ক্ষেত্রে বড় সমর্থন জোগায়। 

কিন্তু শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এই আভিজাত্য ক্ষমতা চাকচিক্যের মধ্যে আটকে থাকেন নি। তার রাজনৈতিক জীবনের গতিবিধিই বলে দেয়, তিনি সবসময়ই ছুটে গেছেন পূর্ব বাংলার সেই গরিব মানুষটির ঘরের দিকেই। 

সাধারণ কৃষকের স্বার্থরক্ষায় তিনি যা করেছেন তা অনবদ্য

অসহায় কৃষকদের ভালবেসেছিলেন ফজলুল হক। ১৯২৯ সালের তিনি কৃষক প্রজা পার্টি গঠন করেন। বাংলার হিন্দু ও মুসলমান উভয় কৃষকদের স্বার্থের পক্ষেই প্রশ্ন করতেন এই দলের মাধ্যমে। 

তবে তিনি এও জানতেন, সেমিনার বক্তৃতায় আগুন ঝরা বক্তব্য দিয়ে সাধারণ মানুষের শোষণ-নিপীড়ন নির্যাতন শেষ হবে না। কাজে নামতে হবে।

তৎকালীন সময়ে যে কৃষকরা হাড়ভাঙা খাটুনিতে ফসল ফলাত তাদের ওপরই জমিদাররা খাজনা বাড়াত, খাজনা দিতে না পারলে জমি থেকে উৎখাত করত। আতঙ্কিত কৃষকরা মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হতো। ঋণের চাপে তাদের জীবন হতো অতিষ্ঠ।  

তাই ফজলুল হক ও তার কৃষক প্রজা পার্টি কৃষকদের এই বন্দিত্ব দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে কিছু কিছু সংস্কার কাজে হাত দেন। 

বাংলার মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে তিনি দরিদ্র কৃষক এবং প্রজাদের স্বার্থরক্ষায় কৃষি ঋণ আইন এবং প্রজাস্বত্ব (সংশোধনী) আইনসহ বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেন। জমিদাররা রায়তদের ওপর যে আবওয়াব ও সেলামি ধার্য করতেন, তিনি তা বিলোপ সাধন করেন।

তবে দরিদ্র কৃষকদের সবচেয়ে বড় স্বস্তি দিয়েছিলেন ঋণ মওকুফ করা। ঋণ সালিশী বোর্ড গঠন করে বাংলার কৃষককে মহাজনী ঋণের অভিশাপ থেকে বাঁচিয়েছিলেন তিনি।

মজলুমের প্রতি তার সহানুভূতি নিয়ে একটি মজার ঘটনা  

একবার ফজলুল হক দেখলেন একটি ছেলে পেঁপে হাতে কাঁদতে কাঁদতে আসছে। কান্নার কারণ জানতে চাইলে ছেলেটি বলল, তার মা তাকে দুটো পাকা পেঁপে দিয়ে বাজারে পাঠিয়েছিলেন বিক্রি করতে। স্থানীয় দারোগা বাবু বড় পেঁপেটি নিয়ে গেছে। বলেছে, ছোট পেঁপেটি যে দামে বিক্রি হবে বড় পেঁপের জন্যেও তাকে সেই দাম দেয়া হবে।

এই পেঁপেটি তুমি কত দামে বিক্রি করবে- ফজলুল হক জানতে চাইলেন। ছেলেটি বলল, ১ টাকা। ফজলুল হক বললেন, না! এটার দাম ২৫০ টাকা! শুধু বলেই ক্ষান্ত হলেন না, তাকে নগদ ২৫০ টাকা দিয়ে পেঁপেটি কিনে নিলেন। এরপর তাকে নিয়ে চললেন থানায়। গিয়ে দারোগ বাবুকে বললেন, আপনি ওর কাছ থেকে নেয়া পেঁপের জন্যে কত দাম দিতে চেয়েছেন?

দারোগা বাবু বললেন, ছোটটার জন্যে যে দাম, সেটা। ফজলুল হক এবার ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি পেঁপেটা কত টাকায় বেচেছ। ছেলেটি বলল, ২৫০ টাকা! শুনে দারোগা বাবু ক্ষেপে গেলেন। ফজলুল হক তাকে থামিয়ে বললেন, দেখুন! আপনি ওয়াদা করেছিলেন অন্য পেঁপেটার দাম সেটা ওকে দেবেন। আমি পেঁপেটা ২৫০ টাকায় কিনেছি। এবার আপনি প্রতিশ্রুতিমাফিক ২৫০ টাকা দিয়ে দিন!

ততক্ষণে দারোগা বাবু খবর পেয়েছেন ইনি যেনতেন লোক নন; ইনি হলেন শেরে বাংলা! দামটা বেতনের চেয়ে বেশি হলেও এর ওর থেকে নিয়ে পুরো টাকাই ছেলেটিকে দিয়ে দিলেন।

ফজলুল হক এবার ছেলেটিকে নিয়ে চললেন তার বাড়ি। পুরো ৫০০ টাকা তুলে দিলেন তার মায়ের হাতে। বিবাদ বাকবিতণ্ডা এড়িয়ে কত বুদ্ধিমত্তার সাথে সমাধানই শুধু দিলেন না, হতদরিদ্র একটি পরিবারের অবস্থাই তিনি বদলে দিলেন। কারণ ৫০০ টাকার মূল্যমান তখনকার বাজারে অনেক।  

মহান এই মানুষটির ১৫১তম জন্মদিন আজ 

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক জন্মগ্রহণ করেন ২৬ অক্টোবর ১৮৭৩ বর্তমান বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জে। তিনি মৃত্যুবরণ করে ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল ৮৮ বছর বয়সে। ঢাকাস্থ শিশু একাডেমির পশ্চিম পাশে তিন নেতার মাজারের মধ্যে একটি হলো শেরে বাংলার সমাধি। 

জন্মদিনে আমরা গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি এই মহান মানুষটির প্রতি।