published : ২১ মার্চ ২০২৪
নিজের স্বপ্নকে বাস্তবরূপ দিতে প্রতিবছর দেশের হাজারো মানুষ পাড়ি জমান ইউরোপ আমেরিকার নানা দেশে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) ‘বিশ্ব অভিবাসন প্রতিবেদন-২০২২’ অনুযায়ী ২০২০ সালে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী বাংলাদেশী অভিবাসীর সংখ্যা ছিল ৭৪ লাখ।
আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যাককিনসে গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের ‘পিপল অন দ্য মুভ: গ্লোবাল মাইগ্রেশনস ইমপ্যাক্ট এন্ড অপরচুনিটি’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ভাষাজ্ঞান ও শ্রমদক্ষতার অভাবে স্থানীয় লোকদের তুলনায় অভিবাসীদের কাজের সুযোগ কম থাকে। এজন্যে তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার একটু বেশি। স্থানীয়দের তুলনায় তারা মজুরিও পায় ২০-৩০ শতাংশ কম।
আসলে অভিবাসীদের অনেকেই এখন নেমেছেন টিকে থাকার লড়াইয়ে। আর যে-সকল দেশ গড়ে উঠেছে অভিবাসনের ওপর ভিত্তি করে, সেখানকার অনেক মানুষই এখন সেসব দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। নতুন আগত যারা এই দেশকে নিজের বাসভূমি বানাতে চেয়েছিলেন, জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়, আবাসন সঙ্কট, অভিবাসীর সংখ্যা হু হু করে বাড়ার ফলে তাদের অনেকেই এখন দেশে ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন।
২০২২ সালে হংকং থেকে শরণার্থী হয়ে উত্তর আমেরিকায় প্রবেশ করা এই অভিবাসী বলেন, কখনই ভাবিনি যে পশ্চিমা দেশগুলোতে শুধুমাত্র একটি কক্ষের ভাড়া জোগাড় করতেই আমাকে হিমশিম খেতে হবে। বেসমেন্টে একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে থাকেন তিনি। এর জন্য তাকে পরিশোধ করতে হয় ৬৫০ ডলার!
এর ফলে তার মাসিক আয়ের ৩০ শতাংশই চলে যায় বাসা ভাড়ায়। বাকি খরচ মিটিয়ে মাস শেষে সঞ্চয় বলতে থাকে না কিছুই। অথচ হংকংয়ে থাকা অবস্থায় তিনি যে অর্থ আয় করতেন, তার এক-তৃতীয়াংশ সঞ্চয় করতে পারতেন।
তাহলে শুনুন একজন ভুক্তভোগীর কথা-
“তিন মাসের ভিসা নিয়ে বিশ্বের একটি উন্নত দেশে গিয়েছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই তিন মাস পর অবৈধ হয়ে গেলাম। তারপরও কাজ করে যাচ্ছিলাম। কাজটা ভালোই ছিলো। বেতনও ভালো। কিন্তু কয়েক বছর পর নিয়ম হলো যে, কোনো অবৈধ অভিবাসী সে দেশে থাকতে পারবে না। শুরু হলো ধরপাকড়।
এসময় একজনের সাথে পরিচয় হলো। সে বললো, তাকে আট লাখ টাকা দিলে সে আমার স্থায়ী হওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। নিরুপায় হয়ে তা-ই করলাম। এজন্যে বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ধারও করতে হলো। ফিরে এলাম দেশে।
এবার সে প্রতিমাসেই আমার কাছ থেকে বেতনের ভাগ চাইত। বাধ্য হয়ে দিতে হতো তাকে। কারণ সে ভিসা করিয়ে না দিলে আমি তো বিপদে পড়বো। আমি অপেক্ষা করছিলাম, দুবছর পর স্থায়ীভাবে বসবাসের আবেদন করতে পারবো সেটার জন্যে।
এক বছর যখন শেষ হলো তখন ভিসা করিয়ে দেয়ার বিনিময়ে সে আরো টাকা দাবি করলো। তা-ই দিলাম। কিন্তু ছয় মাসের মাথায় ইমিগ্রেশন পুলিশ এসে আমাকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যায়। আমার কাগজপত্র না কি সব অবৈধ! আমাকে দেশে পাঠিয়ে দিল। লোকটি আমার জন্যে আসলে কিছুই করে নি। মাঝখান থেকে হারালাম ২০ লক্ষ টাকা আর জীবনের অমূল্য দুটি বছর।“
২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে ৫০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে গেছে; গত ১৫ বছরে বাংলাদেশীদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে তিন গুণ। আসলে ইউরোপ আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্যে বিদেশি শিক্ষার্থীরা হলো দুধেল গাই। যত বেশিসংখ্যক স্টুডেন্ট আকৃষ্ট করা যায় তত মুনাফা।
২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ১০ লাখ বিদেশি শিক্ষার্থী পড়তে গেছে, যা তাদের অর্থনীতিতে যোগ করেছে ৩৪ বিলিয়ন ডলার। একই বছর কানাডা গাড়ি, গাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশ ও বিমান রপ্তানি করে যত ডলার উপার্জন করেছে, তার চেয়ে বেশি আয় করেছে বিদেশি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে- ২২ বিলিয়ন ডলার!
আর ইংল্যান্ড বিদেশি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি ও আনুষঙ্গিক ফি বাবদ ৫২ বিলিয়ন ডলার আদায় করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ব্রিটিশ শিক্ষার্থীদের জন্যে বার্ষিক টিউশন ফি যেখানে নয় হাজার পাউন্ড, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্যে এই ফি তিন থেকে চার গুণ বেশি।
খোদ বৃটেনের পত্রিকা দি গার্ডিয়ান বলছে- ব্রিটিশ সরকার নিজ দেশের ছাত্রছাত্রীদের যে ভর্তুকি দিচ্ছে, সেটা আদায় করছে বিদেশি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। গত চার অক্টোবর থেকে তারা বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসা ফি, হেলথ ইনস্যুরেন্স ফি এসব বাড়িয়েছে। উদ্দেশ্য- অতিরিক্ত ১০০ কোটি পাউন্ড আদায় করা।
অতএব বুঝতেই পারছেন এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো থেকে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করার ব্যাপারে তারা কেন এত মরিয়া! অন্য বেনিয়ারা যেমন তাদের পণ্য বিক্রি করার জন্যে নানারকম প্রলোভন দেখায়, এই উচ্চশিক্ষার বেনিয়ারাও একইভাবে পৃথিবীজুড়ে এই ধারণা ছড়িয়ে দিয়েছে যে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি না থাকলে জীবন বৃথা!
প্রতিবছর বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের দূতাবাসের সহযোগিতায় আমাদের দেশে এডুকেশন ফেয়ার আয়োজন করে। বাংলাদেশে তরুণ-তরুণীদের শিক্ষিত জ্ঞানী ও যোগ্য করে তোলার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে তারা এসব মেলা আয়োজন করে না, করে বিদেশি শিক্ষার্থীর ‘সাপ্লাই চেইন’ চালু রাখতে। যাতে তাদের দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত হয়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে জন্মহার ক্রমশ কমছে। ফলে তাদের প্রচুর শ্রমিক দরকার।
তাদের টোপগুলোও খুব ইন্টারেস্টিং। তারা বলে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ ডিগ্রি নিতে খরচ হবে ৭৫ লাখ টাকা। পাশ করেই আপনি যে চাকরি পাবেন বছরে বেতন হবে কমপক্ষে ৮০ লাখ টাকা। এক বছরেই আপনার টাকা উঠে আসবে। অতএব বিদেশি এমবিএ তোমার ক্যারিয়ার ও জীবনের জন্যে চমৎকার বিনিয়োগ!
প্রথমত ওখানে উপার্জন যেমন বেশি, খরচও সমানুপাতিক হারে বেশি।
দ্বিতীয়ত, বিদেশে যারা পড়তে যায়, টিউশন ফি ও থাকা-খাওয়ার খরচ যোগানোর সামর্থ্য অধিকাংশেরই থাকে না। এই গ্রুপ ঋণ করে। এই ঋণ হচ্ছে আসল ফাঁদের শুরু।
স্টুডেন্ট লোন- যেটি আরেকটি ব্যবসা। চাকরি পাওয়ার পর ২০-২৫ বছর পার হয়ে গেছে, স্টুডেন্ট লোনের কিস্তি শোধ করেই যাচ্ছে- ইংল্যান্ড-আমেরিকায় এরকম প্রচুর ঘটনা রয়েছে। আর যারা লোন না নিয়ে পার্ট-টাইম চাকরি করে থাকা খাওয়ার খরচ যোগায়, তাদের ব্যবহার করা হয় সস্তা শ্রমিক হিসেবে। তাদেরকে খুব কম বেতনে নিয়োগ দেয় স্থানীয়রা।
বাস্তবতা হচ্ছে, যারা বিদেশে পড়ার ব্যাপারে মরিয়া তাদের একটা বড় অংশের আশাভঙ্গ হয় সেখানে যাওয়ার পরে। এ নিয়ে বহু রিপোর্ট বিভিন্ন সংবাদপত্রে বিভিন্ন সময় প্রকাশিত হয়েছে। এই বাস্তবতা সামনে রাখলে বিদেশে পড়াশোনা শতকরা ৯৫ জনের জন্যেই এক সোনার হরিণ, যা কোনোদিনই ছোঁয়া যায় না।
বিদেশে বাইরের দিকটা আপনি যতই সাজানো গোছানো চকচকে দেখুন না কেন, ভেতরের চিত্র কিন্তু অন্যরকম। কারণ অনেকেই খুব কাছে থেকে সেখানকার বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পান না।
জীবন আপনার, তাই সিদ্ধান্তও আপনার– বিদেশে যাবার আগে বাস্তবতার নিরিখে তাই একটু ভাবুন এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিন।
আসলে জীবনকে সুন্দর করতে হলে আপনার প্রয়োজন জীবনের লক্ষ্য, অন্য কারও ওপর বা অন্য কোন দেশের ওপর নির্ভরতা নয়। আগে ঠিক করুন- কেন আপনি বাঁচবেন। বাঁচার একটা সুনির্দিষ্ট কারণ থাকলে জীবন আপনার জন্যে অনেক সহজ হয়ে যাবে, জীবনে নিয়ে আপনি নিতে পারবেন সঠিক সিদ্ধান্ত।