৪২০ কোটি ডলারের যোগান দিয়েছে ইথিওপিয়ার সাধারণ মানুষ!

পদ্মা সেতু নির্মাণে ২৯৭ কোটি ডলার ব্যয় হবে। দাতা সংস্থাগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।  

কিন্তু একমাত্র আমরাই কি এরকম উদাহরণ? না, দৃষ্টান্ত আরো আছে।

পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশ ইথিওপিয়া। গত ৬ বছর ধরে তারা নির্মাণ করছে আফ্রিকার সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ বাঁধ- ১.১ মাইল দীর্ঘ এ বাঁধ নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২০ কোটি মার্কিন ডলার যার পুরোটাই যোগান দিয়েছে সেদেশের সরকার ও সাধারণ মানুষ।  তার বিস্তারিত নিয়েই এ প্রতিবেদন।  

পৃথিবীর দীর্ঘতম নদ নীলনদ। এর রয়েছে দুটি উপনদী। একটি ব্লু নাইল বা নীলাভ নীলনদ। আরেকটি হোয়াইট নাইল বা শ্বেত নীলনদ।

উত্তরের ‘লেক টানা’ থেকে প্রবাহিত হয়ে ব্লু নাইল এগিয়েছে ইথিওপিয়ার পার্বত্য পশ্চিমাঞ্চল ‘ইথিওপিয়ান হাইল্যান্ডে’র মধ্য দিয়ে। একসময় তা প্রতিবেশী সুদানের সমতলভূমিতে নেমে মিলিত হয়েছে খার্তুমের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়া হোয়াইট নাইল বা শ্বেত নীলনদের সাথে। ব্লু নাইল এবং হোয়াইট নাইলের মিলিত ধারাই এরপর নাইল বা নীলনদ নামে প্রবাহিত হয়েছে প্রাচীনতম সভ্যতার লীলাভূমি মিশরের মধ্য দিয়ে।

ব্লু নাইল বা নীলাভ নীলনদের একটা বড় অংশ ইথিওপিয়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হলেও ৮০ র দশকে একের পর এক খরা আর দুর্ভিক্ষ, রাজনৈতিক হানাহানি আর গৃহযুদ্ধের শিকার হয়ে তারাই পরিণত হয়েছিল পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশে। 

সেই ইথিওপিয়াই এখন আবার জেগে উঠছে। ২০০৪-২০০৯ পর্যন্ত  টানা ৬ বছর ইথিওপিয়ার গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১০%, পরিণত হয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু অর্থনীতিতে।  

সম্প্রতি নীলনদে নির্মীয়মান ব্যয়বহুল এক জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পুরো অর্থায়ন নিজেরা করার মাধ্যমে নজর কেড়েছে তারা গোটা বিশ্বের।  

লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ‘ইথিওপিয়ান হাইল্যান্ডে’ যে মৌসুমী বৃষ্টিপাতের সৃষ্টি হয়, সেই জলধারাই পরিপুষ্ট করছে নীলনদকে। কিন্তু তারপরও প্রতিবেশি সুদান বা মিশরের মতো বাঁধ বা অন্য কোনো প্রকল্পের মাধ্যমে নীলনদ থেকে আর্থিকভাবে উপকৃত হওয়ার কথা কখনো ভাবে নি উজানে থাকা ইথিওপিয়া ।

 

কিন্তু ২০১১ সালে তারা হাতে নেয় উচ্চাভিলাষী এক মেগাবিদ্যুৎ প্রকল্পের, ২০১৭ সাল নাগাদ বাস্তবায়িত হলে যা হবে অফ্রিকার সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প,  উৎপাদন করবে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ- এখনকার তিনগুণ।  

ইথিওপিয়ায় এখন প্রতি ৫ জনে মাত্র ১ জন মানুষ বিদ্যুৎসুবিধা পায়, বাকি ৪ জনই এখনো থাকতে বাধ্য হচ্ছে অন্ধকারে।  কাজেই বিদ্যুতের এই মেগাপ্রকল্পটি দেশটির জন্যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।  শিল্পোৎপাদন বাড়বে, প্রাকৃতিক সম্পদের আরো কার্যকরী ব্যবহার সম্ভব হবে। এমনকি প্রকল্পটি শেষ হলে বিদ্যুৎ রপ্তানি করার সুযোগও হতে পারে তাদের, বছরে যা থেকে  আসবে ১ বিলিয়ন ডলার।  আর জলবিদ্যুৎ হওয়ায় পরিবেশের ওপরও এর কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে না। শুধু তাই না, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকলে বাঁধনির্মাণের ৪২০ কোটি ডলারও উঠে আসতে পারে ৫ থেকে ৬ বছরের মধ্যে ।  

তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো এ প্রকল্পটির অর্থায়ন যেভাবে ইথিওপিয়া করেছে সেটা।

৪২০ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিতব্য এ প্রকল্পের পুরো অর্থায়নই করেছে তারা নিজে, সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা নিয়ে। কারণ মিশরের সাথে নদী ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধের জের হিসেবে এ প্রকল্পের জন্যে  কোনো বিদেশি সাহায্য পায় নি তারা। ফলে ‘গ্রান্ড ইথিওপিয়ান রেনেসাঁ ড্যাম’  নামে খ্যাত এ বাঁধটি নির্মাণের জন্যে ইথিওপিয়ার সরকারকে সাধারণ মানুষের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। লটারি, অনুদান আর সরকারি বন্ড বিক্রির মাধ্যমে সংগ্রহ করতে হয়েছে অর্থ।

প্রকল্পটির একজন মুখপাত্র জাদিগ আবরাহা বলেন, একসময় মহান সভ্যতা হিসেবে পরিচিত ছিল যে জাতিটি, আজ তারাই পরিণত হয়েছে বিদেশি সাহায্য নির্ভর পরমুখাপেক্ষী একটি জাতিতে।  কিন্তু নিজেদের অর্থায়নে আফ্রিকার এই বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি করার মধ্য দিয়ে আমরা দেখিয়ে দিলাম, আমরাও পারি, দারিদ্রপীড়িত আর দুর্ভিক্ষের দেশ নয়, ইথিওপিয়াকে পৃথিবী এখন চিনবে আত্মনির্ভর আর মর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে।   

সাইমেনিউ ব্যাকেলি এ প্রকল্পের একজন প্রধান প্রকৌশলী। তিনি বলেন, অবারিত প্রাকৃতিক সম্পদ লুটে নেয়া যায়, এমন এক ভূখণ্ড হিসেবেই পৃথিবীর মানুষ চিনত আফ্রিকাকে। কিন্তু সেই আফ্রিকাই এখন আবার জেগে উঠেছে- স্বনির্ভরায়ন আর স্ব-শক্তিতে বলীয়ান হয়ে। বাঁধের নামে ‘রেনেসাঁ’ শব্দের ব্যবহার, এই পুনর্জাগরণকে বোঝাতেই।

 

(তথ্যসূত্র: টাইম ম্যাগাজিন, ১৩ জুন ২০১৬)