তোমাতে করিব বাস

কলেজে পড়তে ভেবেছিলাম, জীবনের সব চাওয়া মনে হয় কোনো এক মানুষের কাছে – যাকে পেলে সবকিছু পাওয়া হবে; জীবন হবে সার্থক! একজন মানুষ যে নিরাপত্তা দিবে, আমাকে বুঝবে, আমার সাথে ঘুরতে যাবে, অসুখে সেবা করবে, আমার হয়ে অন্যদের সাথে লড়বে, গ্লাসে পানি ঢেলে খাওয়াবে! তাই তখন চেয়েছিলাম কেবলই একটা মানুষকে। পেয়েওছি। প্রথম প্রথম সে কি আনন্দ! মনে হতো জীবনে এর চেয়ে বেশি কী চাওয়ার আছে? কিন্তু হায়! সময় যত গড়াতে লাগল, যৌবনের উত্তেজনা কমতে লাগল, ফিকে হতে লাগল এ আনন্দ।  

একদম ছোট যখন, তখন বিদেশ থেকে ছবি পাঠিয়েছিল এক ভাই। সেই ছবির নায়াগ্রা প্রপাত এখনও চোখে ভাসে! ছোট্ট আমি বুঝতে শিখেছিলাম একদিন আমাকেও যেতে হবে ঐ ঝর্ণার কাছে। বি-শা-ল বড় একটা প্লেনে চড়ে আর দামি একটা ক্যামেরাও কিনতে পারতে হবে, যাতে ছবি পাঠালে দেশে বসে সম্পর্কের ভাই-বোনেরা আহা-উহু করতে পারে; স্বপ্ন দেখতে পারে আমার মতো হওয়ার। তাই তো, অনেক অনেক টাকা থাকলে অনেক আনন্দ পাওয়া যাবে, মনে হবে জীবনটা সার্থক।

সার্থক যে হই নি তা বুঝেছিলাম নায়াগ্রার পাশে দাঁড়িয়ে। সব মহাদেশ ঘুরে শেষটায় চাচ্ছিলাম আমার ছোটবেলার স্বপ্নের সেই জলধারা দেখতে। কারণ ওতে যে জীবনের সার্থকতা রয়েছে! কী আনন্দ- কী আনন্দ! আনন্দ হবে না? সবগুলো মহাদেশে দুই দশকের ঘোরাঘোরি যে প্রাপ্তি দেয় নি—তা এই নায়াগ্রা দেবে আমাকে! কিন্তু জাহাজে দাঁড়িয়ে এমন খালি-খালি লাগল কেন? একটু কি আফসোসও হলো? এ-ই আমার স্বপ্নের স্বর্গ? এই- স্রেফ এই? এতটুকু মাত্র? চিৎকার দিতে ইচ্ছা হলো কেন? মরে যেতে ইচ্ছা করছে না কেন? কেন মনে হচ্ছে না জীবন সার্থক?

বাড়ির বিশাল বারান্দা থেকে নিচে তাকালে আনন্দ হয় না বহুদিন! উর্দিপরা দারোয়ানের সালামেও আনন্দ হয় না! অসুখ হলে সেবা পেলে আনন্দ হয় না! ছেলের ঈর্ষনীয় চাকরির সংবাদেও কেন মনে হয় না জীবন সার্থক? বাসায় কেউ অপেক্ষা করে আছে জেনেও কেন পরক্ষণেই হাহাকার লাগে? কত কিছু করলাম—বাড়িবাড়ি ছুটে চাঁদা তুলে একটা স্কুলে সাহায্য করেছি। শীতে/ বন্যায় পয়সা-শ্রম-সময় দিয়ে খেটেছি, অকাতরে অর্থ দিয়েছি। তবু খালি লাগে কেন? রক্ত দিয়ে তো অন্যদের মৃত্যু থেকে বাঁচিয়েছি, তবুও নিজের কেন মৃত্যুভয় হলো সেদিন? কী পেলাম না? কী পেলাম না তাহলে? সব তো করলাম—সবকিছু!

কী আতঙ্ক হয়েছিল সেদিন! হুট করে শ্বাসকষ্ট হয়েছিল! না, পাশে শুয়ে থাকা মানুষটাকে তো ডাকি নি, মেধাবী পুত্রকেও না। সাত-সমুদ্র তের নদীর পারের সেই স্মৃতিগুলোও তো একটু শান্তি দেয় নি! বরং আমার দুর্বিনীত অবাধ্য হৃদয় সেদিন আমার পঁয়তাল্লিশ বছরের অহমকে চূর্ণ করে কেঁদে উঠেছিল এমন একজনকে স্মরণ করে যাকে অবিশ্বাস করে এসেছি যখন থেকে যুক্তি বুঝেছি তখন থেকে। এরকম তো আমার হওয়ার কথা নয়! কেন মনে হয় যে কিছুই তো করা হলো না? আরও কেন বাঁচতে ইচ্ছে হয়! ব-হু-দিন বাঁচতে ইচ্ছে করে! হাঁটুর ব্যথা নিয়েও, বলিরেখা পড়া চামড়া নিয়েও, ডুবো তেলে ভাজা রূপচান্দা খেতে দেয় না তবুও এই দুর্বল পাকস্থলীটাকে ভীষণ ভালবেসে চলি। বয়স বাড়ছে আর সব হিসেব যেন পাল্টে যাচ্ছে! ভেবেছিলাম, মরবোই তো! সবকিছু করে অর্জনের খাতা পূর্ণ করব–তারপর একদিন টুপুস করে মরে যাব! আমাকে দেখে সবাই বলবে, ‘বাহ্, কি সুন্দর জীবন ছিল তার! আমাদেরও যদি হতো অমন?’

চাওয়ার এই সমীকরণের কোথাও স্রষ্টা ছিলেন না। ‘আল্লাহ’ বলে বহুদিন কাউকে ডাকি নি। কারণ দুঃখ-কষ্টকে আমি যুক্তি দিয়ে বুঝেছি। যৌবনে তাই-তাই করেছি যা দিয়ে সুদীর্ঘ আত্মজীবনী লেখা যায়। নিজেকে বুঝ দিয়েছি—মাটিতেই তো মিশতে হবে, অতএব এক মুহূর্ত অপচয় করা চলবে না। ধর্ম তো স্রেফ দুর্বলের জন্য! কারণ ধর্ম মানে হাজারটা না–লক্ষটা বিধিনিষেধ, সুতার উপর দাঁড়িয়ে জীবনযাপন, একটুও এদিক-সেদিক হলে স্রষ্টার আক্রোশ পড়বে যে! ডান থেকে বাম হওয়া মাত্র জাহান্নাম নামের সেই জেলখানায় ছুঁড়ে ফেলবে আর চাবুকে পিষে অত্যাচার করবে তার বানানো ‘আশরাফুল মাখলুকাতে’র উপর! এই ভয় থেকেই পালিয়ে বেরিয়েছি আল্লাহর কাছ থেকে! মোটা মোটা বই রপ্ত করেছি আর নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছি! আমার জীবন মহান তো কিছু না! একটা লতার জীবন যেমন, যেমন একটা আস্তাকুঁড়ের খেদ খাওয়া দাঁড়কাকের জীবন—তার বেশি কিছু তো নয়!

কিন্তু ঐ যে! মনটা অবাধ্যই রয়ে গেল আর জীবনের শেষ অধ্যায়ে ঠিকই পেতে গেল আজীবন অবিশ্বাস করে আসা স্রষ্টাকে! একটা সিডি পেয়েছিলাম–মহাজাতকের কন্ঠে। কোন এক ড্রয়ারের তলায় হারিয়ে যাওয়া সেই সিডি একদিন বাজিয়েই আমি আটকা পরে গেলাম। ফোনে শুনলাম, গাড়িতে শুনলাম, বাড়িতে শুনলাম—অবাক হয়ে কেবল শুনলাম আর বিস্মিত হলাম! এ কে? কার কথা শুনছি? এই কি সেই স্রষ্টা যিনি সারাক্ষণ চাবুক নিয়ে বসে আছেন আমাদের শায়েস্তা করবেন বলে? না! ইনি তো সে নন! ইনি তো আমাকে মমতায় গড়ার কথা বলেন! বলে চলেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা ভালবাসার কথা! বলে চলেন তাঁর ভালবেসে অপেক্ষা করে থাকার কথা! কিছু করো যাতে তাঁর স্নেহের মূল্যায়ন হয়। ভালো কিছু করো। বড় কিছু করো। নিজের জন্যে করো। অন্যের জন্যে করো। আমার কাছে কী চাও, বলো? সবই তো হাত পেতে নিচ্ছ! দম নিচ্ছ, ফল খাচ্ছ, বৃষ্টিতে ভিজছ, ঘুম যাচ্ছ! তবু ভাবছ, তিনি বদমেজাজী নিষ্ঠুর কেউ? তাঁর থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছ আর তাঁরই মেঘমালার নিচে তাঁরই বিস্তীর্ণ জমিনে ছুটে বেড়াচ্ছ? আর কোন্ কোন্ নেয়ামতকে অস্বীকার করে নাফরমানী করবে? চোখ ফেটে আসে কারণ এতকিছুর পরও তিনি যে অপেক্ষা করে আছেন! মুখ তো ফিরিয়ে নেন নি! এত কিছু যে পেলাম—এত কিছুর যোগ্য কি ছিলাম? মাথার উপর কারো হাতই কি ছিল না?

পৃথিবী ঘুরে যে শান্তি পাই নি, জীবনের অর্ধশতক পার করে মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে সেজদায় তা পেয়েছি। ভালো কিছু করায় আনন্দ পাই নি। হৈ হুল্লোরে বেঁচে থেকে আনন্দ পাই নি। আনন্দ পেয়েছি যখন বুঝেছি আমার জীবন আবর্জনা খাওয়া কাক বা কুকুরের জীবন না! ভালবাসার মানুষের আলিঙ্গনে নিরাপত্তা পাই নি, যে নিরাপত্তা পেয়েছি নিজের ভেতরে; যখন বুঝেছি এবং স্বীকার করেছি, কেউ তো সদা সজাগ আছেন মাথার উপর! কেউ তো প্রতিক্ষণ হৃদস্পন্দন চালু রেখে চলেছেন! শান্তি পেয়েছি যখন বুঝেছি কেউ তো অপেক্ষা করে আছেন আমার জন্যে! দম বন্ধ মানেই সবকিছুর শেষ না। আমি জানি কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি—অন্তত এমন তো কারো কাছে যাচ্ছি যিনি ছুঁড়ে ফেলে দিবেন না। বিন্দু বিন্দু করে এত মমতায় যিনি বানিয়েছেন তিনি যদি সাথে থাকেন তবে আর ভয় কি!

এর নাম কি সমর্পণ? এর নাম কি প্রাপ্তি? এর নাম কি এমন একজনের উপর আস্থা-বিশ্বাস-ভালবাসা যাতে বিলীন হওয়া যায়, যাকে বলা যায়, ‘তোমাতে করিব বাস—দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ মাস’?