published : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
দুই বন্ধুতে গল্প হচ্ছে।
একজন বলছে : সভ্যতার এই অভাবনীয় অগ্রগতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আজকের যে অভূতপূর্ব উত্থান, এর মূলে রয়েছে আশাবাদী ও নৈরাশ্যবাদী দুদলেরই সমান অবদান। অন্যজনের উৎসুক প্রশ্ন : আশাবাদীদের ভূমিকা আছে তা তো বুঝলাম, কিন্তু নৈরাশ্যবাদীর ভূমিকাটা কেমন? প্রথমজনের উত্তর : আছে, নৈরাশ্যবাদীদের কৃতিত্বও আছে বৈকি-আশাবাদীরা ছিল বলে এরোপ্লেন আবিষ্কৃত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু নৈরাশ্যবাদীরা ছিল বলেই তো আবিষ্কৃত হয়েছে প্যারাসুট!
পাঠক, জোকসটা পড়ে নিশ্চিত হেসে নিয়েছেন জানি। কিন্তু একটু ভাবুন তো, প্যারাসুট যিনি আবিষ্কার করেছেন, আসলেই কি তিনি নৈরাশ্যবাদী, নাকি বরং আশাবাদের দিক থেকে আরো একধাপ এগিয়ে? বাঁচার আশা তীব্র বলেই না প্যারাসুট আবিষ্কারের কথা তিনি ভেবেছেন- এরোপ্লেন দুর্ঘটনা-কবলিত হলেও যাতে বাঁচার একটা উপায় অন্তত থাকে। তাহলে এদের আর নৈরাশ্যবাদী বলে গাল দেয়ার অধিকার আছে কার?
আসলেই তা-ই। আমাদের চারপাশের মানুষ- যাদের আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি, যাদের সাথে আমাদের নিত্যদিনের ওঠা-বসা, তাদের সবাই-ই আসলে কমবেশি আশাবাদী। আশা নিয়েই তো আমাদের বেঁচে থাকা। একজন মানুষ বেঁচে আছেন, তার জীবন আছে, কাজকর্ম করছেন মানেই তার আশা আছে। কারণ আশাই জীবনের মূল চালিকাশক্তি। আশা ছাড়া জীবন নেই। জীবন মানেই আশা।
এই আশা হয়তো কারো মধ্যে দৃশ্যমানভাবে বেশি, কারো মধ্যে হয়তো-বা কম কিংবা খানিকটা ঝিমিয়ে গেছে। যিনি উদ্যমে সর্বক্ষণ অনুপ্রাণিত, তাকে আমরা আশাবাদী বলে বাহবা দিচ্ছি; আর যার মধ্যে এর প্রকাশটা তুলনামূলক কম, তাকে আশাহীন কিংবা নৈরাশ্যবাদী আখ্যা দিয়ে কার্যত আরো সেদিকেই ঠেলে দিচ্ছি।
যদিও হওয়া উচিত ছিল এর উল্টোটা- তাকে একটু বুঝিয়ে, উৎসাহিত করে বা আর কিছু না-হোক, নিতান্তই একটু পিঠ-চাপড়ে সাহস দেয়া, একটুখানি শক্তি যোগানো। ধর্ম আর মহামানবদের শিক্ষা তো আমাদের তা-ই বলে।
আর একজন মানুষকে নৈরাশ্যবাদী বলিই বা কী করে? যিনি বেঁচে আছেন, পরের মুহূর্তটিতেও বেঁচে থাকার জন্যে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন (ইচ্ছে করলে এটা বন্ধের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তও তো তিনি করতে পারতেন। যারা এটা করে, তাদের আশা বোধহয় শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকে বলেই তা করে), খাওয়াদাওয়া করে শক্তি সঞ্চয় করছেন, পড়াশোনা করছেন বা পেশাগত দৈনন্দিন কাজকর্ম করছেন- তাকে আর যা-ই হোক, ‘নৈরাশ্যবাদী’ বলে আখ্যা দেয়াটা অযৌক্তিকই বটে।
কারণ জীবন আর আশা সমার্থক। জীবন আছে, তার মানে আশা হারিয়ে যায় নি। সে আশা হতে পারে পড়াশোনা বা কর্মক্ষেত্রে আরাধ্য সাফল্যের, স্বপ্ন পূরণের বা বৈষয়িক সমৃদ্ধির। অর্থাৎ আশা আছেই-হতে পারে কম কিংবা বেশি। আমাদের কাজ এখন একটাই- চিরন্তন এ আশার শক্তিকেই আরো বাড়িয়ে তোলা, নিজেদের আশার সল্তেটাকে একটু ভালো করে জ্বালিয়ে নেয়া-যাতে সাফল্য আর আনন্দময় জীবনের দিকে পথচলা হয় সহজ। এবং তা সম্ভবও।
কেনই-বা আমাদের আশা আর উদ্যমে ভাটা পড়ে? প্রতিদিনকার নানা স্ট্রেস বা টেনশন অস্থিরতা ভয় আলস্য দীর্ঘসূত্রিতা এবং মূলত নেতিবাচক জীবনদৃষ্টিকে এর অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। মূলত এসবই একজন মানুষের ভেতরের উদ্যম ও চিরায়ত আশার বোধটিকে ক্রমশ দুর্বল করে দেয়, পরিণত করে তথাকথিত নৈরাশ্যবাদী মানুষে।
মুক্তির উপায়? ধরা যাক, ঘুটঘটে অন্ধকার একটি ঘর, আলোর লেশমাত্র সেখানে নেই। এখন এ ঘরটিতে কেন আলো নেই, কীভাবে আলো নিভে গেল, কীভাবে আবার আলোকিত করা যায়, ঘরটি আলোকিত করতে কত আলো প্রয়োজন এবং কীভাবে তার যোগাড় হবে-এসব নিয়ে নানা আলোচনা, মিছিল-মিটিং, বৈঠক-সভা-সমিতি (প্রয়োজনে তদন্ত কমিটিও) করা যেতে পারে। কিন্তু আবার এটাও সত্য যে, এতকিছু না করে একটি মোমবাতি জ্বেলে দিলেই ঘরটি পুনরায় আলোকিত হয়ে উঠতে পারে।
জীবনঘাতী নেতিবাচকতা আর নৈরাশ্যবাদীতার বৃত্ত থেকে এক ঝটকায় বেরিয়ে আসার সহজ পথও এমন একটাই-তা হলো, কাজে নেমে পড়ুন। টেনশন অস্থিরতা ভয় আলস্য দীর্ঘসূত্রিতা-আপনার মধ্যে যা-ই থাকুক না কেন, এসব কীভাবে তাড়াবেন বা ঠেকাবেন সে চিন্তা পরে হবে। যা আছে, যেটুকু শক্তি আর সক্ষমতা আপনার আছে তা নিয়ে আগে কাজে নেমে পড়ুন। শ্রমানন্দময় কাজ-যেখানে কাজের আনন্দ আছে, বেঁচে থাকার আনন্দ আছে, দেয়ার আনন্দ আছে, সেবার আনন্দ আছে-যত স্বল্প আর ক্ষুদ্র পরিসরেই তা হোক।
প্রশ্ন করে বসতে পারেন, শুধু কাজ কীভাবে একজন মানুষকে আশাবাদী করে তুলতে পারে বা তার আশার শক্তিকে বাড়িয়ে দিতে পারে? অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের খুব সুন্দর একটি কথা আছে-‘কাজ হচ্ছে গঙ্গাজল। কাজের মধ্যে থাকলে পরে ক্লেদ, গ্লানি, বিষণ্নতা, হতাশাসহ সমস্ত নেতিবাচকতা ধুয়ে-মুছে একজন মানুষ হয়ে ওঠেন ঝকঝকে, তকতকে আর নির্মল। আক্ষরিক অর্থেই তিনি হয়ে ওঠেন সুস্থ দেহ আর প্রশান্ত মনের অধিকারী। তার জীবনের পরতে পরতে তখন থাকে শুধু আশা, আশা আর আশা-যা বাড়িয়ে দেয় তার উদ্যম ও কর্মস্পৃহা। ফলে সাফল্যও আসে সহজ স্বতঃস্ফূর্ততায়।’
কারণ কাজের নিজস্ব একটি শক্তি আছে, যা একটি ইতিবাচক বৃত্ত সৃষ্টি করে। এ বৃত্ত আশার, এ বৃত্ত উদ্যমের, এ বৃত্ত শ্রমানন্দের। আর সে কাজ যদি হয় মানুষের কল্যাণের নিমিত্ত, তবে একটা আলোকিত আনন্দময় জীবনই তো তার প্রাপ্য।
শ্রমানন্দময় কর্মপ্রচেষ্টার পাশাপাশি নিজের অন্তর্গত আশাবাদ ও ইতিবাচকতার ভিত্তিটিকে আরো সংহত করে তুলতে জীবন থেকে নেতিবাচক সমস্ত কথা, আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি সচেতনভাবে পরিহার করুন। নিজেকে ক্রমাগত আশা ও ইতিবাচকতার কথা শোনান। দিনে অন্তত শতবার বলুন, সুস্থ দেহ প্রশান্ত মন কর্মব্যস্ত সুখী জীবন। তাহলে আপনার মস্তিষ্ক আপনাকে সেভাবেই পরিচালিত করবে এবং আপনি নিজেই হয়ে উঠবেন অমূল্য এ বাণীর একজন অনন্য ও সার্থক উদাহরণ।