published : ৩১ জানুয়ারি ২০১৮
"ডেল কার্নেগির বইতে পড়েছিলাম গল্পটা। একটি দুর্ঘটনায় এক পিতা তার ছেলেকে হারান। ভদ্রলোক কিছুতেই এই নিদারুণ মৃত্যুশোক সহ্য করতে পারছিলেন না। খাওয়া ঘুম কাজকর্ম সব প্রায় বন্ধ। মর্মান্তিক যন্ত্রণায় দিন কাটছিল তার। এ কষ্টের ভার বহন করা তার পক্ষে কিছুতেই আর সম্ভব হচ্ছিল না। শরীর-মন পুরো ভেঙে গিয়েছিল।
এমন দুঃসহ সময়ে একদিন তার ছোট্ট মেয়েটি আবদার করে বসল- বাবা, আমাকে একটা নৌকা বানিয়ে দেবে? মেয়েকে খুশি করতে তিনি একটানা কয়েক ঘণ্টা কঠোর পরিশ্রমে কাঠ দিয়ে একটা নৌকা বানালেন। নৌকাটি মেয়ের হাতে তুলে দিতে গিয়েই তার মনে হলো, ছেলে মারা যাওয়ার পর নৌকা বানানোর এই কয়েকটি ঘণ্টাই তিনি পুত্রশোকের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত ছিলেন।
কেন তিনি এ সময়টা পুত্রশোকের দুঃখ অনুভব করলেন না? কারণ খুঁজতে গিয়ে টের পেলেন ছেলের মৃত্যুর পর এই প্রথম তিনি ছেলেকে নিয়ে কিছু ভাবার সময় পান নি। তখন তিনি বুঝলেন, কাজ জিনিসটা এমনই। কোনো কাজ করার সময় কারো পক্ষে অন্য কিছু ভাবা সম্ভব নয়। নৌকা তৈরির সময় তিনি ছিলেন ঐ কাজটার মধ্যে পুরোপুরি ডুবে যাওয়া মানুষ। তাই সন্তান হারানোর শোকও তার তখন অনুভূত হয় নি। ব্যস, তিনি যন্ত্রণা থেকে মুক্তির পথ পেয়ে গেলেন।
এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন-একের পর এক কাজ করে যাবেন। যতক্ষণ কাজ ততক্ষণই শান্তি। তিনি মন দিয়ে কাজ করতে লাগলেন। করতে করতে ঠিকই একসময় পুত্রশোক কাটিয়ে উঠলেন।
কাজ এভাবেই মানুষকে বাঁচায়। কাজ দিয়েই আমরা দুঃখকে অতিক্রম করি, দুর্ভাগ্যকে জয় করি। যে যত বেশি কাজ করে সে তত হতাশামুক্ত, দুঃখ-যন্ত্রণাহীন ও আনন্দপূর্ণ। প্রতিটা কাজই জীবনে কমবেশি সাফল্য নিয়ে আসে। সাফল্য মানেই আনন্দ। তাই কাজ মানেও আনন্দ। একজন মানুষ যত কাজ করবে তত তার জীবনে আনন্দ বাড়বে।”
কাজ, বিশ্বাস ও ইতিবাচকতা শীর্ষক একটি অনবদ্য বক্তৃতায় কথাগুলো বলেছিলেন শিক্ষাবিদ ও ‘আলোকিত মানুষ চাই’ আন্দোলনের স্বপ্নদ্রষ্টা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।
চলুন শুনি, দেহ-মন-দীর্ঘায়ুর ওপর কর্মব্যস্ততার প্রভাব নিয়ে এ-কালের চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্যগবেষকরা কী বলছেন-
প্রাচীন প্রবাদ মতে, কাজ করতে করতে মানুষ বড়জোর ক্লান্ত হয়, কিন্তু কাজ না করতে করতে সে হয়ে পড়ে হতাশ ও বিষণ্ন। হাল আমলের বিজ্ঞানীরা বলছেন, কর্মব্যস্ততাহীন অলস মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিও তুলনামূলক বেশি। আর দৈনন্দিন রুটিন অনুসারে কর্মব্যস্ত সময় পার করেন যারা, তারা অপেক্ষাকৃত সুস্থ জীবনযাপন করেন। বাড়ে তাদের দীর্ঘায়ুর সম্ভাবনা।
তারা বলছেন, আনন্দময় কর্মব্যস্ততা শরীর-মন দুয়ের জন্যেই স্বস্তিদায়ী ও স্বাস্থ্যকর। ফলপ্রসূ ব্যস্ততা দেহ-মনকে রাখে সুস্থ ও প্রাণোচ্ছল। দূর হয় মনের মেঘ। যাবতীয় আলস্য ও নেতিচিন্তা-হতাশা-বিষণ্নতাকে বিদায় করে ঝেঁটিয়ে। জীবন হয়ে ওঠে সুখী ও সার্থক।
এর পাশাপাশি যে-কোনো সমস্যা মোকাবেলায় মনোদৈহিক দিক থেকে তারা হন অধিকতর সক্ষম। গবেষণায় দেখা গেছে, ক্রমাগত নানারকম কাজের মধ্য দিয়ে মানুষ হয়ে ওঠে বাস্তববাদী। বুদ্ধিমত্তা হয়ে ওঠে সুতীক্ষ্ণ। স্মৃতিশক্তি থাকে অটুট। ফলে বয়সজনিত স্মৃতিভ্রষ্টতায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তাদের তুলনামূলক কম।
আমেরিকায় পরিচালিত একটি সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, লক্ষ্যপানে ব্যস্ত মানুষেরা সুনিদ্রা উপভোগ করেন। ঘুম থেকে তারা ভোরে জাগতেও পারেন কোনো জড়তা ছাড়াই। তাদের সামনে কারণটা স্পষ্ট থাকে যে, কেন তারা ভোরে জাগবেন। সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনার কারণেই তাদের জন্যে এটা বেশ সহজ।
যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিদদের মতে, কর্মব্যস্ত দিন কাটান যারা, তারা অনিদ্রা ও ঘুম-সংক্রান্ত জটিলতায় ভোগেন কম। স্লিপ সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এ গবেষণাটি মূলত যাদের ওপর চালানো হয় তাদের গড় বয়স ছিল ৭৯। তবে গবেষণায় নেতৃত্বদানকারী প্রফেসর জেসন অং বলেন, যে-কোনো বয়সী মানুষের ক্ষেত্রেই এটা সত্য।
ব্যস্ত দিনের শেষে ঘুম ভালো হয় বলে তাদের মনও থাকে সতেজ। থাকতে পারেন উদ্যমী। ফ্রন্টিয়ার্স ইন নিউরোসায়েন্স জার্নালের একটি রিপোর্টে গবেষক সারা ফেসিনি বলেন, হরেক প্রকার কাজ আর চ্যালেঞ্জের পথ ধরে মস্তিষ্কে ঘটে নিউরোপ্লাস্টিসিটি বা নিউরোনের সংযোগায়ন। মস্তিষ্ক হয়ে ওঠে প্রখর। নিত্যনতুন দক্ষতার বিকাশ ঘটে সহজেই।
কাজে ফুরসত পাই না বলে আমরা যে কখনো-সখনো হা-হুতাশে ভুগি না তা নয়; কিন্তু জেনে রাখুন, আজকের গতিময় পৃথিবীতে ব্যস্ত মানুষের কদর বেশি। আপনি ব্যস্ত, অতএব আপনি একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। অন্যদিকে অলস মানুষের সময় কাটে অনর্থক গালগল্প আর ঠুনকো বিনোদনে। জীবনে যা কেবল দুর্গতিই বাড়ায়।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিহেভিয়ারাল সায়েন্সের প্রফেসর ও সাইকোলজিস্ট ক্রিস্টোফার হ্যাসি। ২০১০-এ প্রকাশিত ফিজিওলজিক্যাল সায়েন্স জার্নালে তিনি লিখেছেন, ব্যস্ততার সময়টাই আদতে আমাদের সুখের সময়। সে বিচারে অলস লোকের অবস্থা বড় শোচনীয়। সুখী হওয়ার জন্যে তাদের প্রতি একটাই আহ্বান-কর্মব্যস্ত থাকুন।
কর্মমগ্ন লোকেরা নিশ্চিতভাবেই আত্মবিশ্বাসী। আরামবলয় ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারেন তারা। বাড়ে তাদের কর্মপরিধি। বিষয়টি মাথায় রেখেই অভিভাবকদের প্রতি গবেষকদের পরামর্শ-শৈশব থেকেই সন্তানদের গড়ে তুলুন কর্মব্যস্ত মানুষ হিসেবে। আত্মবিশ্বাসদৃপ্ত একজন মানুষের মতোই সে থাকবে হতাশা ও নেতিবাচকতা থেকে মুক্ত।
দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে বা পেশাগত জীবন শেষে নিছক অলস অবসরযাপন নয়, বরং যতটা সম্ভব কর্মব্যস্ত থাকুন। আনন্দ খুঁজে নিন সেবায়। ব্যস্ত থাকুন সৃষ্টির কল্যাণে। মনোদৈহিক সুস্থতার জন্যেই জরুরি এই কর্মসম্পৃক্ততা। ২০১৬-তে যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, অবসর গ্রহণের পর একবছরের কর্মসম্পৃক্ততাও অকালমৃত্যুর হার কমাতে পারে শতকরা ১০ ভাগ পর্যন্ত!
এ প্রসঙ্গে ইতালির ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিলের নিউরোসায়েন্টিস্টরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন-পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে যারা অবসরজীবন যাপন করছেন, তাদের পেশির স্বাভাবিক শক্তি ও কার্যক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি, যা পরবর্তীতে জটিল রোগের সম্ভাবনা বাড়ায়। হেলথ ইকোনমিকস জার্নালে প্রকাশিত এ গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে ইউরোপের ১২টি দেশে অবসর-যাপনরত ৫০ ও তদূর্ধ্ব বয়সী মানুষের ওপর।
মানবকল্যাণে ব্যস্ততা অবসর-জীবনে আপনাকে রাখবে সুস্থ ও প্রাণবন্ত। রীতিমতো বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত এটি। ৬৫ বছর বয়সে অবসরে গেছেন এমন ১০০১ জন সুইডিশ নাগরিককে দুবছর পর্যবেক্ষণ করেন কানাডার ক্যালগেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজিস্ট প্রফেসর ইয়ানিক গ্রিপ। তিনি বলেন, এদের মধ্যে যারা সপ্তাহে অন্তত একদিন সেবামূলক কাজে ব্যস্ত ছিলেন, অন্যদের তুলনায় তাদের বয়সজনিত স্মৃতিভ্রষ্টতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমেছে প্রায় আড়াই গুণ।
প্রফেসর গ্রিপের মতে, প্রবীণদের কর্মসম্পৃক্ততা বিশেষত সেবাধর্মী কাজে ব্যস্ততা তাদের সুস্থতার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে তারা উদ্যমী থাকেন। এতে মস্তিষ্ক যেমন থাকে সক্রিয়, তেমনি চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডেও তারা থাকেন সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজিস্ট ড. জেন প্রিন্স বলেন, কর্মব্যস্ততায় কমে তাদের ব্যথা ও যন্ত্রণার অনুভূতি।
জ্ঞানীরা বলেন, আলস্যই জীবনের প্রথম শত্রু। আর কর্মব্যস্ততা মানে জীবনের উদযাপন। সুস্থতা, সুখ ও সাফল্য ধরা দেয় কর্মপ্রাণ মানুষের ভাগ্যেই। উদ্যমী হয়ে কাজে নেমে পড়লেই লেজ গুটিয়ে পালায় যত ভয়, শঙ্কা আর বিষণ্নতা। বহুমুখী কাজের মধ্য দিয়ে তখন প্রকৃতই খুঁজে পাওয়া যায় মানবজীবনের অর্থ ও সার্থকতা। অন্যদিকে আরামে বাড়ে শত ব্যারাম। এটাই সত্য।
তাই যথাসাধ্য ব্যস্ত থাকুন-ইতিবাচক ফলপ্রসূ কাজে আর সঙ্ঘবদ্ধ সেবায়। নিয়মিত মেডিটেশন, সুস্থ জীবনাচার ও সুপরিকল্পিত দৈনন্দিন রুটিন হোক আপনার কর্মব্যস্ত জীবনের অনুপ্রেরণা। থাকুন সুস্থ। জীবন হোক সুখ ও সার্থকতায় পূর্ণ।