‘খুনি চেয়ার’ কে না বলুন ॥ সুস্থতার জন্যে দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে থাকুন

যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা চিকিৎসা গবেষণা কেন্দ্র মায়ো ক্লিনিক। এ প্রতিষ্ঠানের মেদস্থূলতা নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক কার্যক্রমের সহ-পরিচালক জেমস লেভিন। পেশায় এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট লেভিন কয়েক দশক ধরে মেদস্থূলতা এবং দীর্ঘক্ষণ বসে কাটানোর প্রভাব নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছেন। গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তার মতামত হলো-দীর্ঘসময় বসে নয়, বরং সার্বিক সুস্থতার জন্যে দিনের বেশিরভাগ সময় দাঁড়িয়ে থাকার বা দৈহিকভাবে সক্রিয় থাকার অভ্যেস করুন।

লেভিনের মতে, চেয়ারে বসে কাজ কিংবা নিছক আলস্যবশত অথবা নানা কারণে দিনের একটা বড় সময় বসে কাটান যারা, দীর্ঘমেয়াদে তারা উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, মেদস্থূলতাসহ নানারকম রোগ-জটিলতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। অন্যদিকে এ সময়টাই যদি কাজ করা যায় দাঁড়িয়ে বা হাঁটাচলার মধ্যে, তবে কমে আসে এসব রোগঝুঁকি।

এ পুরো বিষয়টি নিয়েই জেমস লেভিন লিখেছেন তার অনবদ্য গবেষণাগ্রন্থ গেট আপ!, এ বছরই যা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও তিনি উদ্ভাবন করেছেন বিশেষ ধরনের ট্রেডমিল ডেস্ক, যার ওপর দাঁড়িয়ে এবং চাইলে ধীরলয়ে হেঁটে ডেস্ক জব বা অফিসের কাজকর্ম করা যায় নিশ্চিন্তে।

দৈনন্দিন জীবনে হরেক রকম কাজে কিংবা কাজ ছাড়াও অধিকাংশ সময়ই আমরা বসে কাটাই। চেয়ারে বসে অফিসের কাজ করি, খাওয়াদাওয়া করি, মিটিংয়ে আলোচনা করি। টিভি দেখা আর আড্ডা তো আছেই। জরিপে দেখা গেছে, আমেরিকানরা তাদের কর্মজীবনের একটা বড় সময় বসেই কাটিয়ে দেয়-দিনে গড়ে প্রায় ১৩ ঘণ্টা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ এক প্রাণঘাতী ব্যাপার। ২০১০ সালে চিকিৎসা সাময়িকী সার্কুলেশন এ বিষয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে, তাতে বলা হয়-সাত বছর ধরে ৮,৮০০ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, এদের মধ্যে যারা দিনে চার ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় বসে কাটান তাদের অকালমৃত্যুর ঝুঁকি ৪৬ শতাংশ বেশি তাদের চেয়ে, যাদের ক্ষেত্রে এটি সাকুল্যে দু-ঘণ্টার বেশি নয়।

গবেষকদের মতে, দিনের অর্ধেকেরও বেশি সময় যারা বসেই কাটান তাদের ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তুলনামূলক দ্বিগুণ। এবং সবমিলিয়ে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে শতকরা ৫০ ভাগ। সব দেখেশুনে মনে হয়, চেয়ারই বুঝি হয়ে উঠেছে এক মৃত্যুফাঁদ!

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর কারণটি খুব চমকপ্রদ। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা যে স্বাস্থ্যপ্রদ কিছু নয়, তার সূত্র লুকিয়ে আছে মানুষের সৃষ্টিতত্ত্বে। অর্থাৎ মানবদেহ এবং এর অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো এমনভাবে তৈরি ও সজ্জিত যে, দিনমান সক্রিয় থাকলেই কেবল এর সুস্থতা নিশ্চিত হয়, অলস শুয়ে-বসে থাকায় নয়। নিষ্ক্রিয়তা বা কম দৈহিক নড়াচড়ায় দেহের বিপাকক্রিয়ার গতি হয়ে পড়ে ধীর। শরীরে অতিরিক্ত ক্যালরি জমে, বাড়ে চর্বির পরিমাণ। পরিণতি মেদস্থূলতা আর হৃদরোগ, উচ্চ কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিসসহ বিভিন্ন জীবনঘাতী রোগযন্ত্রণা।

এজন্যে গবেষকদের পরামর্শ-খাবার গ্রহণের পরপরই বসে বা শুয়ে পড়বেন না, তাতে রক্তে বাড়ে শর্করার পরিমাণ। বরং সচল থাকুন, তাতে রক্তের শর্করামান থাকবে আপনার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে।

অনেকেরই ধারণা যে, বেশি খেলে ওজন বাড়ে আর খাওয়া কমিয়ে এ নিয়ন্ত্রণ করা যায় সহজেই। কিন্তু জেমস লেভিন বলছেন, ওজন নিয়ন্ত্রণে এর চেয়েও সহজতর ও কার্যকর পদ্ধতিটি হচ্ছে নিত্য সচল থাকা এবং যথাসম্ভব কম সময় বসে কাটানো। দিনে যখনই সুযোগ পাওয়া যায় তখনই একটু হেঁটে আসা-বাইরে কিংবা নিদেনপক্ষে ঘরেই হোক-হাঁটতে হাঁটতে আলাপ-আলোচনা এবং এ জাতীয় কাজগুলো সেরে নেয়া।

পাশ্চাত্যে সম্প্রতি এ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তাই অফিস, কর্মক্ষেত্র, এমনকি স্কুলে পর্যন্ত এর চর্চা শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। কর্মীদের সুস্থতা নিশ্চিত করতে অফিস কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা করছেন ট্রেডমিল ডেস্কের। স্কুলে শিক্ষার্থীরা গণিত আর বানানের ক্লাস করছে টুল-টেবিলহীন ক্লাসে খেলাধুলা কিংবা দৌড়ঝাঁপ করতে করতে। কোনো কোনো শহর-কর্তৃপক্ষ স্বল্প দূরত্বে গাড়ি ব্যবহার না করার জন্যে আহ্বান জানাচ্ছেন নাগরিকদের। সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, এর সার্বিক ফল হয়েছে বেশ চমৎকার। সুস্থতার হার বেড়েছে দৃশ্যমানভাবে।

তাই, কোনো অজুহাতেই আর বসে থাকা নয়; আপনিও উঠে দাঁড়ান। হাঁটুন। সচল থাকুন। আপনার জীবন হোক গতিময় ও কর্মমুখর। সবদিক থেকেই আপনি সুস্থ থাকবেন। হতে পারেন কর্মব্যস্ত সুখী জীবনের উদাহরণ।

সায়েন্টিফিক আমেরিকান (নভেম্বর ২০১৪)-এ প্রকাশিত স্বাস্থ্য নিবন্ধ ‘কিলার চেয়ার’ অবলম্বনে