কাউকে না কাউকে তো শুরু করতে হবে

সেলফি নিয়ে সবচেয়ে মজার জোকসটা শুনবেন?

বাসায় কাজের লোক নেই, এ নিয়ে গৃহকর্ত্রী পেরেশান। অগত্যা কদিন পর মহল্লা থেকে নিজেই খুঁজে নিয়ে এলেন একজনকে। দিন কয়েক পর বান্ধবীদের আড্ডায় এ নিয়ে গল্প হচ্ছিল। একজন সাবধান বাণী দিলেন- ‘চেনাশোনা ছাড়া কাকে না কাকে খুঁজে এনেছ, বিশ্বাস করা যায় নাকি কাউকে আজকাল? দিনকালের যা অবস্থা, একটা ছবিটবি অন্তত তুলে রাখা উচিত ছিল।’ সরল মনে গৃহকর্ত্রী বললেন, ‘এভাবে ছবি তোলার কথা বলা যায় নাকি যে, বুয়া, দাঁড়াও তোমার একটা ছবি তুলি? সে কী মনে করবে? বুঝবে না যে, তাকে সন্দেহ করছি?’

এ-যুগে এহেন নির্বুদ্ধিতায় (!) তার বান্ধবীরা রীতিমতো বিস্মিত, তৎক্ষণাৎ ওরা বাতলে দিলেন মোক্ষম সমাধানটি- ‘এভাবে বলবে কেন? বলবে, আসো বুয়া তোমার সাথে একটা সেলফি তুলি!’

হাটে মাঠে ঘাটে রাস্তায় বাড়িতে গাড়িতে, পানির নিচে, সোজা হয়ে, চিৎ কিংবা তেরছা হয়ে আমরা সেলফি তুলে যাচ্ছি বিরামহীন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেল, পবিত্র হজব্রত পালন করতে গিয়ে তাওয়াফ করার সময়ও কেউ কেউ সেলফি তোলার মহান কাজটি সেরে নিচ্ছেন!

আমরা নিজেরাও অনেক সময় বুঝি না যে, আমরা আসলে কতটা হাস্যকর হয়ে পড়ছি।

আগে আমরা কথা বলতাম। বন্ধুতে বন্ধুতে, মা মেয়েতে, বাবা ছেলেতে, ভাই বোনেতে কত কথাই না হতো! সারাদিন কী করলাম, কোথায় গেলাম, কী খেলাম, কার কার সাথে দেখা হলো ইত্যাদি বিচিত্র আলাপ। এহেন প্রাণবন্ত আলাপচারিতায় আমরা পরস্পরকে বুঝতাম, টের পাওয়া যেত হৃদয়ের উষ্ণতা। বাড়ত হৃদ্যতা। সবকিছু ছিল জীবন্ত ব্যাপার। এখনো কথা হয়। আমরা প্রতিদিন কথা বলি। তবে ফেসবুকে। ফেসবুক স্ট্যাটাসে চলে হৃদয়ের অনুভূতির আদান-প্রদান।

বাবার জন্মদিন। ছেলে ভীষণ আবেগময় ভাষায় স্ট্যাটাস দিল- ‘আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। বাবা, তোমাকে অনেক ভালবাসি ...।’ বাবা পড়লেন। আবেগকাতর হলেন। ততোধিক আবেগমথিত ভাষায় স্ট্যাটাস দিলেন পুত্রকে উদ্দেশ্য করে। ছেলের প্রতি জানালেন তার ভালবাসার ডিজিটাল অনুভূতি।

পাঠক কী ভাবছেন? বাবা-ছেলে বহু দূরে থাকেন, না জানি কত দিন ওদের দেখা নেই! না, ঘটনা সে-রকম নয়। বাবা-ছেলে দুজনেই থাকেন একই শহরে। একই বাসায়! দুই রুমের মাঝখানে একটা মাত্র দেয়াল। এমন নয় যে, দুজনের মাঝে সম্পর্কের দূরত্বটা অনেক। বরং দুজনের সম্পর্ক বন্ধুর মতো। তবু সেদিন এ নিয়ে আর কোনো কথাই হলো না দুজনের। হাসিমুখে বাস্তবিক শুভেচ্ছা বিনিময় কিংবা মমতাময় স্পর্শ- কিছুই না। যা বলার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বলা হয়েছে, পরিচিতরাও সবাই দেখেছে, তাই তো যথেষ্ট। আবার কী!

ঘটনা কিন্তু কাল্পনিক নয়। একেবারে সত্যি। ঘরে ঘরে এ এখন এক মারাত্মক ব্যাধিই বটে। মা বসে আছেন টিভি-সিরিয়াল নিয়ে, বাবা ব্যস্ত ল্যাপটপে, ছেলে ফেসবুকে আর মেয়ে ছুটল কাউকে টেক্সট করতে। সবমিলিয়ে জীবনটা এখন আগাগোড়াই ভার্চুয়াল।

আমরা এভাবেই মেতে থাকি সবসময়। কিছু না কিছু নিয়ে। যা দিয়ে আমাদের মাতিয়ে তোলা হয়, মাতিয়ে রাখা হয় আমরা তা-ই নিয়ে মেতে থাকি। ভেবেও দেখি না কখনো। একেকটা সময় একেকটা নতুন নতুন উন্মাদনা আসে। আমরা নিশ্চিন্তচিত্তে ঝাঁপিয়ে পড়ি।

বছর কয়েক আগে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় এলো নতুন হুজুগ ‘ফ্ল্যাশ-মব’। চার ছক্কা হই হই/ বল গড়াইয়া গেল কই গানের তালে রাস্তা আটকে উদ্দাম নৃত্য। দেশজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সোৎসাহে নাচল গাইল তারুণ্যের উৎসাহ-উচ্ছ্বাসে আর প্রাজ্ঞ প্রবীণেরা ততোধিক উৎসাহে তা প্রচার করলেন তাদের পত্রিকা আর সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু ঠিক কেন এই ফ্ল্যাশ-মব? এত হুলস্থূল করে কেন নাচলাম, গাইলাম, নেচেই-বা কী লাভটা হলো, কিছুই আমরা জানি না।

আমরা যখন ধীরে ধীরে নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ভুলে অর্থহীন আনন্দে সুখ খুঁজে বেড়াচ্ছি, ফ্ল্যাশ-মব, ফেসবুক ইত্যাদি নিত্যনতুন উন্মাদনায় অস্থির হয়ে আছি, পাশ্চাত্যের সচেতন মানুষ তখন কী করছে? খোঁজ নিয়েছি কখনো? ওরা এখন উপলব্ধি করছে যে, দিনের পর দিন এসব মাতামাতি শেষপর্যন্ত আসলে অনর্থ বটে। তাতে ক্রমাগত নিজেকেই হারিয়ে ফেলে মানুষ। তুলনায় নিজের দিকে ফিরে তাকানো ঢের লাভজনক। এবং জরুরি। শান্তির জন্যে, স্বস্তির জন্যে।

পাশ্চাত্যেও ফ্ল্যাশ-মব হচ্ছে, তবে তা কেবলই গানবাজনা ও হইচই সর্বস্ব নয়। ওরা এখন ক্রমশ ঝুঁকছে প্রশান্তির দিকে। ওদের সচেতন অংশ উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন যে, প্রশান্তিটাই জীবনের জন্যে সবচেয়ে জরুরি। তাতে স্বাস্থ্য, পেশা, পরিবার, সমাজ সবখানেই আসে একটা সুন্দর গতিময়তা আর অপূর্ব জীবনছন্দ।

প্রশান্তির প্রয়োজনটা তাই ওরা ভালোই বুঝছেন। বুঝছেন ওদের সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী-সহ সমাজের সর্বস্তরের সাধারণ মানুষেরাও। তাই তো সেন্ট্রাল লন্ডনের ব্যস্ততম জনবহুল স্থান ট্র্যাফলগার স্কয়ারে ওরা সমবেত হন মেডিটেশন ফ্ল্যাশ-মবে, যেখানে বিভিন্ন বয়সী শত শত তরুণ-যুবা-বৃদ্ধ নারী-পুরুষকে দেখা যায় খোলা আকাশের নিচে চোখ বুঁজে মাটিতে বসে আছেন নানা ধ্যানভঙ্গিতে।

এটি শুরু হয়েছিল মূলত ২০১১ সালের জুনে। তারপর বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের আয়োজনে এমন ফ্ল্যাশ-মব একাধিকবার অনুষ্ঠিত হয়েছে লন্ডনে, বার্সেলোনায়, মেক্সিকো সিটিসহ ইউরোপের আরো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে। দলবদ্ধ মেডিটেশন শেষে অংশগ্রহণকারীদের সে কী প্রশান্তিময় উচ্ছ্বাস! (ইউটিউবে খুঁজলেই এই ভিডিওগুলোর দেখা মিলবে, আগ্রহী পাঠক দেখে নিতে পারেন।)

সিদ্ধান্তটা এখন নিতে হবে আসলে আমাদেরকেই। পাশ্চাত্যের ছুড়ে ফেলা ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডের কঙ্কাল-সংস্কৃতি নিয়েই আমরা আকণ্ঠ মেতে থাকব? নাকি সারা পৃথিবীর সচেতন মানুষ যে একটু একটু করে আলোকময় প্রশান্তির খোঁজে নৈতিকতা, ধ্যান ও আত্মনিমগ্নতার দিকে ঝুঁকছে- আমরা সেদিকে যাব? আমরা সোৎসাহে দাবি করি বটে যে, এসব আমাদের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। কিন্তু চর্চার বেলায় আমরা কতটা উদ্যোগী ও আন্তরিক?

একথা কাউকে আজ বলে বোঝানোর কিছু নেই যে, সামাজিক পারিপার্শ্বিক পেশাগত বিভিন্নমুখী অস্থিরতার দরুন নানাভাবে আক্রান্ত হচ্ছে আমাদের ব্যক্তিজীবন ও আমাদের মনোদৈহিক স্বাস্থ্য। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে আমাদের পরিবারগুলো। যার ফলশ্রুতিতে এত মাদকাসক্তি, নারী নির্যাতন, মনোসামাজিক ব্যাধি এবং আরো অনেক কিছু।

তাই পরিবার সমাজ মানুষ বাঁচাতে সর্বোপরি আমাদের চিরায়ত নৈতিক মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ ঘটাতে নিজেদের দিকে ফিরে দেখা, নিজেদের উন্নত সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গগুলোর চর্চা এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি। কারণ অন্ধকার দূর করার উপায় নিয়ে আমরা কমিটি-কমিশন গঠন করতে পারি, দিস্তা দিস্তা কাগজে রচনা করতে পারি দশাসই গবেষণা-প্রবন্ধ, কিন্তু সত্য হলো, একটু আলো জ্বালালেই এক ঝটকায় দূর হয়ে যায় সমস্ত অন্ধকার। আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি ও নৈতিক মূল্যবোধের পুনর্জাগরণই হতে পারে সেই কাঙ্ক্ষিত আলো। এর চর্চা এখন একটু একটু করে শুরু করে দিলেই হলো।

আর কাউকে না কাউকে তো শুরু করতে হবে।