published : ১৮ আগস্ট ২০১৮
মওলানা জালালুদ্দীন রুমীর সেই গল্পটা আজও আমাদের পারিবারিক জীবনে বেশ প্রাসঙ্গিক।
‘তিন মুসাফির। একজন আরব, একজন রোমান, একজন পার্সিয়ান। তিন জন একই পথ দিয়ে চলেছে। তারা কেউ একে অন্যের ভাষা পুরোপুরি বোঝে না, কোনোরকম ইশারা-ইঙ্গিতে অল্পস্বল্প কথায় কাজ চালিয়ে নিচ্ছে। পথ চলতে চলতে তাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও গড়ে উঠল।
পথিমধ্যে তারা হঠাৎ একটি থলে কুড়িয়ে পেল। তাতে কিছু স্বর্ণমুদ্রা। তিন জনই উৎফুল্ল। সামনেই বাজার আছে, কিছু ফলমূল কিনে খাওয়া যাবে। আরব মুসাফির বলল, চলো, আমরা ইনাব কিনে খাই। পার্সিয়ান বলল, না, আঙুর কিনব। রোমান বলল, ইনাব আঙুর কোনোটাই নয়, ভিটিস কিনব এবং আমরা সেটাই খাব।
স্বর্ণমুদ্রাগুলো দিয়ে কী কেনা হবে, এ নিয়ে কিছুতেই একমত হতে পারছিল না তারা। এভাবে এককথা-দুকথা, একপর্যায়ে শুরু হলো ঝগড়া। তাদের বন্ধুত্ব রূপ নিল রীতিমতো কলহে। প্রত্যেকেই যার যার কথায় অনড়। একজন কিনতে চায় ইনাব, একজনের পছন্দ আঙুর আর একজনের কথা হলো, ভিটিস কিনতে হবে।
গল্পের এ পর্যায়ে রুমী বলছেন, এই তিন মুসাফিরের জন্যে এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একজন ভাষান্তরকারী বা দোভাষীর, যিনি তিন জনের ভাষাই বোঝেন। তাহলে এদের ঝগড়া খুব সহজেই মিটে যায়। কারণ তারা প্রত্যেকেই একই জিনিস চাচ্ছে, কিন্তু পরস্পরকে বোঝাতে পারছে না। আরবি ভাষায় যা ইনাব, ফার্সিতে তা-ই আঙুর আর একজন রোমান ভাষাভাষীর কাছে তা-ই ভিটিস। অর্থাৎ তিন জনের চাওয়া একই, কিন্তু একে অন্যের ভাষা বুঝতে পারছে না বা বোঝার চেষ্টাও করছে না বলেই তারা জড়িয়ে পড়েছে বিবাদে।’
আমাদের পারিবারিক জীবনও আসলে তা-ই। পরিবারে একজন মানুষ কী চায়? প্রতিটি মানুষ, পরিবারের প্রত্যেক সদস্যই মূলত একটি জিনিসই চায়। এককথায় বলা যায়, সেটি হলো সম্মান। পরিবারে স্বামী স্ত্রী সন্তান বাবা মা ভাই বোন শ্বশুর শাশুড়ি সবাই চায় মূলত তার প্রাপ্য সম্মানটুকু, চায় একটা স্বীকৃতি। চায় শ্রদ্ধা, চায় সমমর্মিতা। চায় তাকে একটু মমতার চোখে দেখা হোক। খাওয়াদাওয়াসহ জীবনধারনের জন্যে প্রয়োজনীয় যা-কিছু, সেসব তো একটা পশুও চায়। কিন্তু মানুষ যা চায়, যা নিয়ে বাঁচতে চায়, তা হলো তার সম্মান ও আত্মমর্যাদা। এমনকি ঘরের গৃহকর্মীটি পর্যন্ত ন্যূনতম সম্মান আর মর্যাদা চায়।
ধর্মের চিরন্তন শিক্ষাও তা-ই। পবিত্র কোরআনে সূরা বাকারা-য় ১৮৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা (স্বামী ও স্ত্রী) পরস্পর পরস্পরের পোশাক’। এ আয়াতের মর্মার্থ হলো, স্বামী-স্ত্রীর সম্মান ও মর্যাদা নির্ভর করে তাদের পরস্পরের ওপর, তারা একে অন্যের সম্মান। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি, দাম্পত্য জীবন এবং পারিবারিক জীবনের মৌলিক চাওয়াটিকে ধর্মীয়ভাবেও অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কারণ এটি ঠিক থাকলে বাকি সবকিছু এমনিতেই সহজ হয়ে যায়।
পরিবারে এক + এক = এগারো
সাধারণভাবে এক যোগ এক সমান দুই, কিন্তু পরিবারে বা একটি পরিবার গড়তে দুজন মানুষ যখন একত্র হন তখন সেটি হয়ে যায় এগারো। অর্থাৎ পরিবারে দুজন মানুষের শক্তি, সামর্থ্য ও কর্মক্ষমতা হয়ে উঠতে পারে এগারো জন মানুষের সমান। আর এটা তখনই সম্ভব, যখন আমরা সেটা বিশ্বাস করতে পারব এবং সেই দক্ষতা অর্জন করতে পারব।
সার্কাসে দেখা যায়, একজন জাগলার দুহাতে এগারোটি পর্যন্ত বল নিয়ে জাগলিং করতে পারেন, একটি বলও মাটিতে পড়ছে না। কারণ তিনি বিশ্বাস করেছেন এবং এই দক্ষতা অর্জন করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন যে, আমি এটি পারব এবং করে দেখাব।
আমরা অধিকাংশ মানুষই দায়িত্ব নিই—সেটা মনের টানে, মমতার টানে, আবেগের টানে-যে কারণেই হোক। আর আমরা আমাদের পরিবারের জন্যে ত্যাগ স্বীকার করতে পারি, কারণ এটা আমাদের প্রাচ্যের হাজার বছরের ঐতিহ্য।
বিয়ে হলো একটি প্রয়োজন, একটি দায়িত্ব
একটি পরিবারের শুরুটা হয় বিয়ের মধ্য দিয়ে। আমরা বলতে পারি, বিয়ে হলো একটি প্রয়োজন, যা দুজন মানুষের জৈবিক মানসিক আবেগীয় ও সামাজিক চাহিদা পূরণ করে। বিয়েটা হচ্ছে এই প্রয়োজনগুলো পূরণের একটি উদ্যোগ বা প্রক্রিয়া। আর এগুলো পূরণের পথে কোনো ঘাটতি অনুভূত হলে সমস্যার শুরুটা হয় সেখান থেকেই।
অর্থাৎ বিয়ে মানে শুধুই ভালবাসা আর রোমান্টিসিজম নয়, এটি একটি দায়িত্ব। কিন্তু মিডিয়ার রঙিন জগতের প্রভাবে আমরা এটি ভুলে যাই। ফলে সিনেমা নাটক টিভি-সিরিয়ালের অবাস্তব জীবনের সাথে আমরা অনেক সময় আমাদের বাস্তব জীবনকে গুলিয়ে ফেলি। বিয়ে নিয়ে অলীক কল্পনার রাজ্যে ডুবে যাই। কল্পনার ফানুস ওড়াই।
ছেলেরা নায়িকার মতো ও মেয়েরা নায়কের মতো জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনী খোঁজে। ভাবে, তার স্বামী বা স্ত্রী সিনেমার স্বামী/ স্ত্রীর মতোই সবকিছু করবে, সব ভুল ক্ষমা করে দেবে, শ্বশুর-শাশুড়ি হবে সিনেমায় দেখা শ্বশুর-শাশুড়ির মতো। কিন্তু বাস্তব চিত্র প্রায়শই ভিন্ন।
বিয়ে ॥ জীবনের একটি বাস্তব ঘটনা
বিয়ে একটি বাস্তবতা, জীবনের অন্য সব অনুষঙ্গের মতো এটি খুবই বাস্তব একটি ব্যাপার। কিন্তু পরিবারের সদস্য যেমন, ভাই বোন বাবা মা সন্তানের সাথে বিরোধ সহজেই ভুলে যাই, ক্ষমা করতে পারি, কিন্তু দাম্পত্য বিরোধ আমরা ভুলতে পারি না। ভাই বাবা সন্তানের অপরাধ আমরা সহজেই ক্ষমা করতে পারি, কিন্তু একই অপরাধ স্বামীর ক্ষেত্রে হলে ক্ষমা করতে পারি না। আবার বোন মা কন্যার যে ভুল আমরা এড়িয়ে যাই সহজেই, সেই একই ভুল স্ত্রীর বেলায় আমরা অনেক বড় করে দেখি। কেন?
এর কারণ হলো, বিয়েতে ও দাম্পত্য সম্পর্কে আমরা দিতে চাই কম, কিন্তু পেতে চাই বেশি। এখানে আমরা শুধু হিসাব কষি, আমি কী পেলাম? বৈবাহিক সম্পর্কে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা কেবল নিজের অংশটুকু বুঝে নিতে চাই, যার ফলে অনেক ছোটখাটো সমস্যা প্রায়ই রূপ নেয় সংকটে। অথচ এ-ক্ষেত্রে কিছুটা বাস্তববাদী হলে অনেক সমস্যা খুব সহজেই সমাধান করা যায়।
বিয়ের মধ্য দিয়ে একটি বাস্তব ও দৈনন্দিন সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটে, আর এ বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা থাকা চাই প্রথম থেকেই। যেমন : স্ত্রী যদি মনে করেন, বিয়ের দিন তিনি যেভাবে সেজেগুজে বসে ছিলেন, তার খাওয়া-দাওয়াসহ অন্যান্য সব কাজকর্মের দায়িত্ব অন্যেরা নিয়েছে—বিয়ের পরও তা-ই ঘটবে, তাকে কিছুই করতে হবে না, কোনো দায়িত্ব নেই, তাহলে সেটি হবে অলীক কল্পনা মাত্র।
আবার পুরুষদের কেউ কেউ নিজের ক্ষমতা, পৌরুষ আর কর্তৃত্ব জাহির করতে গিয়ে বিয়েতে বা বিয়ের পর অনেক অতিরিক্ত ও লোক-দেখানো খরচ করেন। অথচ পুরোটাই হয়তো ছিল ঋণের টাকায়। পরবর্তীতে যখন বাধ্য হয়ে এটি বন্ধ করতে হয়, তখনই ঘটে স্বপ্নভঙ্গ। শুরু হয় দ্বন্দ্ব। তাই প্রত্যেক স্বামীরই উচিত তার আয়-রোজগার সম্বন্ধে শুরুতেই স্ত্রীকে একটি স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট ধারণা দেয়া।
এ-ছাড়াও বিয়ের ব্যাপারে কিছু বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি। প্রথমত, বিয়েটা হতে হবে পাত্র-পাত্রীর পছন্দে। অর্থাৎ পাত্র-পাত্রী যদি পরস্পরকে বিয়েতে সম্মত হন তবেই বিয়েটা হতে পারে। দ্বিতীয়ত, পারিবারিক পছন্দ বা সম্মতি। তৃতীয়ত, বিয়েটা সবসময় হতে হবে মোটামুটিভাবে সম-সামাজিক, সম-সাংস্কৃতিক, সম-অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে।
যা চাই, তা-ই আগে দিতে হবে অন্যকে ॥ জীবন থেকে শুধু আনন্দটুকুই নিন
যা চাই, তা আগে দিতে হবে অন্যকে। আমি সম্মান চাই, মমতা চাই, সমমর্মিতা চাই-এ জিনিসগুলোই আমাকে আগে দিতে হবে। যদি দিতে পারি তবে আমিও তা-ই পাব এবং সুখী হবো। অর্থাৎ পরিবারকে সুখী করার দায়িত্বটা আগে নিতে হবে আমাকেই।
আপনি যদি আপনার স্বামী/ স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞচিত্ত হতে পারেন, হৃদয়ের গভীর থেকে মমতা অনুভব করতে পারেন, সম্মান দিতে পারেন, তবে আজ কাল বা পরশু এই সম্মান এই মর্যাদা আপনি পাবেনই। এজন্যে চাই ধৈর্য।
অনেক সময় আমরা এই ধৈর্যটাই ধরতে পারি না। কিন্তু ধৈর্য, অপেক্ষা আর প্রো-একটিভিটি সুখী জীবনের জন্যে, বিশেষত পারিবারিক শান্তির জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই ধৈর্যটাকে অভ্যাসে পরিণত করুন।
আর জীবনে যেমন কিছু আনন্দ আছে, তেমনি আছে কিছু কষ্টও। পারিবারিক জীবনও তার ব্যতিক্রম নয়। যিনি বুদ্ধিমান, তিনি আনন্দের পরিমাণ বাড়ান, আর আনন্দটুকুই শুধু নেন। কষ্ট নেয়ার দরকারটা কী? কষ্টটা তো বোঝা। বোঝা বয়ে নিজের ভার বাড়ানোর চেয়ে বরং আনন্দটা নিয়ে হালকা থাকুন। কখন কে কী বলেছে, বকেছে, সেটি মনে রাখার চেয়ে স্বামী/ স্ত্রীসহ সবার সাথের সুখস্মৃতিগুলো লালন করুন।
আজকের সুখী পরিবারই ভবিষ্যৎ সুখী প্রজন্মের ভিত্তি
আমরা নিঃসংশয়ে বলতে পারি, আমাদের আজকের সুখী পরিবারই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুখের ভিত্তি, সুখী প্রজন্মের শিকড়। পরবর্তী প্রজন্ম এ শিকড় থেকেই জীবনীশক্তি ও প্রাণরস লাভ করবে।
সুখী সমাজের ভিত্তিও হচ্ছে সুখী পরিবার। সুখী পরিবার ছাড়া সুস্থ সমাজ হতে পারে না। কারণ অসুখী পরিবারগুলোর সন্তানদের শতকরা প্রায় ৮০ থেকে ৯০ ভাগই হয় মাদকাসক্ত, না হয় মানসিক অসুস্থতায় ভুগছে কিংবা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুখী দেখতে চাইলে তার প্রস্তুতি নিতে হবে মাতৃগর্ভে শিশুর বিকাশের সময় থেকেই। ভ্রƒণাবস্থা থেকেই শিশুর মনোদৈহিক বিকাশ শুরু হয়। সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফল অনুসারে, মাতৃগর্ভে থাকাকালীন শিশু যে কেবল মায়ের চিন্তা দিয়েই প্রভাবিত হয় তা নয়; বরং পারিপার্শ্বিক সবকিছু এমনকি বাবার চিন্তা দ্বারাও সে প্রভাবিত হতে পারে।
সন্তানসম্ভবা মায়ের চারপাশের পরিবেশ যত ভালো থাকবে, ইতিবাচক থাকবে মাতৃগর্ভে সন্তান তত সুন্দরভাবে বেড়ে উঠবে। এ-সময় সন্তানসম্ভবা মায়ের সাথে যত ভালো ব্যবহার করা যাবে, তার শারীরিক-মানসিক যতœ নেয়া যাবে, তার প্রতি মমতা দেয়া যাবে, তিনি যত আনন্দিত ও উজ্জীবিত থাকবেন, সন্তানের বিকাশ তত ভালো হবে।
এ-ছাড়াও সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিতে বিশেষভাবে সচেষ্ট হোন। সন্তানকে আপনি যত সময় দেবেন সন্তান তত আপনাকে বুঝতে চাইবে, অনুভব করবে। সে আপনার সুখ-দুঃখ আবেগের সাথী হবে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে আমেরিকান শিশু-কিশোররা তাদের বাবাদের সাথে কথা বলে দিনে পাঁচ মিনিট, আর টিভি দেখে সাত ঘণ্টা। ফলে তাদের পারিবারিক পরিবেশ ও সমাজ হয়ে উঠছে আগের চেয়ে অস্থিরতাপূর্ণ ও সহিংস।
সন্তান যখন কথা বলতে শেখে তখন সে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করে, কৌতূহলী হয়। এসময় তার প্রতি মনোযোগ দেয়াটা খুবই জরুরি। কারণ সে যদি আপনার কাছ থেকে উত্তর না পায় তাহলে সে বাইরে যাবে উত্তর খুঁজতে, আর তাতে সম্ভাবনা আছে বিভ্রান্ত হওয়ার। তাই সন্তানের প্রশ্নের উত্তর দিতে কখনো বিরক্ত হবেন না।
ছোট ছোট উদ্যোগেসুখী হোক আপনার পরিবার
পারিবারিক মনছবি করুন। আপনার পরিবার ও পরিবারের সদস্যদেরকে কোথায় দেখতে চান, সবাইকে নিয়ে কোথায় পৌঁছতে চান, পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন চান, এ সবগুলো বিষয় একত্র করে মনছবি দেখুন। এর ফলে আপনাদের চাওয়াটা সংজ্ঞায়িত ও সুনির্দিষ্ট হবে।
আসলে অধিকাংশ সময় আমরা বুঝিই না যে, আমরা কী চাই। ফলে কী করব, কীভাবে করব তা-ও বুঝতে পারি না। অন্যদিকে চাওয়াটা সুস্পষ্ট হলে লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যে দায়িত্ব নেয়া সহজ হয়।
সরাসরি কথা বলুন। স্বামী স্ত্রী বাবা মা শ্বশুর শাশুড়ি শ্যালক ননদ সবার সাথেই আন্তরিকভাবে সরাসরি কথা বলুন, কোনো মাধ্যম ধরে নয়। পরিবারে সহজ যোগাযোগ সবসময় পারস্পরিক সম্পর্কের সেতুবন্ধনটাকে মজবুত করে। মানুষকে কাছে নিয়ে আসে। রাগ ক্ষোভ অভিমান এমনিতেই দূর হয়ে যায়। আর কথা অত্যন্ত শক্তিশালী। তাই মমতা ও বিনয়ের সাথে কথা বলুন।
পারিবারিক রেওয়াজ গড়ে তুলুন এবং তা অনুসরণে পরিবারের সবাইকে উদ্বুদ্ধ করুন। যেমন, আমরা আমাদের পরিবারে উচ্চস্বরে চিৎকার, চেঁচামেচি বা ঝগড়া করি না কিংবা পরিবারের সবাই আমরা দিনে অন্তত একবেলা একসাথে খাওয়াদাওয়া করি।
প্রতি বৃহস্পতিবার পরিবারের সবাইকে নিয়ে পারিবারিক মেডিটেশনে অংশ নিন। পরিবারের সবার সুস্বাস্থ্য, সাফল্য ও সার্বিক কল্যাণের নিয়তে মাটির ব্যাংকে দান করে দিনের কাজ শুরু করুন।
একা নয় কিংবা শুধু স্বামী-স্ত্রী নয়, সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে অংশ নিন। সম্ভব হলে মাসে বা বছরে একবার পরিবারের সবাইকে নিয়ে বেড়াতে যান।
আপনার পরিবারকে ধর্মীয় ও আত্মিক চেতনা এবং নৈতিক মূল্যবোধ চর্চা ও প্রয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে গণ্য করুন। সেবা ও সৎকর্মের চর্চা শুরু করুন পরিবার থেকেই। পরিবারের প্রতিটি কাজই সৎকর্ম ও ইবাদত।
তাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে পরিবারের জন্যে যে-কোনো কাজ আনন্দচিত্তে করুন, বিরক্তি নিয়ে নয়। তাতে কাজের আনন্দ ও সন্তুষ্টি বহুগুণ বেড়ে যাবে।
আজকের প্রয়াসে গড়ে উঠুক সার্থক ভবিষ্যৎ প্রজন্ম
সন্তানসম্ভবা মা-কে সবসময় ভালো কথা বলতে এবং ভালো কিছু পড়তে, দেখতে উৎসাহিত ও সহযোগিতা করুন। যেমন : অটোসাজেশন, জীবন কণিকা, কোরআনের মর্মবাণী, বিভিন্ন ধর্মবাণীর সংকলন ইত্যাদি। সন্তান জন্মের পর তাকে পাশে রেখে এবং আরো একটু বড় হলে সাথে নিয়ে মেডিটেশন করুন। তাহলে জীবনের শুরু থেকেই সে ইতিবাচকতায় অনুপ্রাণিত হবে।
সন্তানকে আদর করবেন, কিন্তু আহ্লাদ দেবেন না। অতিরিক্ত আহ্লাদে সন্তান বখে যেতে পারে। চাওয়া মাত্রই সবকিছু দিয়ে দেবেন না, অপেক্ষার পর কোনো জিনিস পাওয়ার যে তৃপ্তি, সেটি তাকে অনুভব করতে দিন। যা সহজেই পাওয়া যায় তাতে কোনো আনন্দ থাকে না।
সন্তানের সাথে দৃঢ় হতে ভয় পাবেন না। কোনো ভুল বা অন্যায় দেখলে প্রয়োজনে দৃঢ় হবেন। সন্তান যখন আপনার দৃঢ়তা দেখবে তখন সে বুঝবে, ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা আপনার আছে এবং আপনি তার প্রতি সচেতন। নৈতিক দৃঢ়তা সবসময় অন্যের কাছে আপনার সম্মানটা বাড়িয়ে দেয়।
সন্তানকে অন্যের সামনে বকবেন না। ভুল করলে তাকে একা ডেকে বলুন। পারিবারিক জীবনে স্বামী-স্ত্রীসহ সবার ক্ষেত্রেই এটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য। যখনই কাউকে অন্যের সামনে বকবেন সে তার ভুলকে যৌক্তিক প্রমাণ করার চেষ্টা করবে এবং যুক্তি-পাল্টাযুক্তির পর তা একপর্যায়ে ঝগড়ায় রূপ নেবে।
সন্তানকে মারবেন না। যখনই মারলেন, আপনি আপনার সর্বশেষ অস্ত্রটা ব্যবহার করে ফেললেন। কিছু অস্ত্র কখনো ব্যবহার করতে হয় না। এজন্যে সবসময় শক্তি-প্রদর্শন আর সহিংসতা এড়িয়ে চলবেন।
সৎসঙ্ঘে একাত্ম হোন
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন কার্যক্রমগুলোর সাথে পারিবারিকভাবে একাত্ম হোন। সাদাকায়ন, আলোকায়ন, ওয়ার্কশপ, মাটির ব্যাংক করসেবাসহ ফাউন্ডেশনের সব অনুষ্ঠানে সপরিবারে অংশ নিন। আপনার পারিবারিক প্রশান্তি বাড়বে, পারিবারিক আবহ হয়ে উঠবে আরো সহজ স্বতঃস্ফূর্ত সমমর্মী ও সহযোগিতাপূর্ণ।
ফাউন্ডেশনের নৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হলে আপনার পরিবারের সদস্যদের আত্মিক শক্তি বিকশিত হবে। জীবনদৃষ্টি হবে সঠিক ও ইতিবাচক। ফলে পরিবারের সবার মধ্যে পরস্পরকে বোঝার, অনুভব করার ও অনুপ্রাণিত করার শক্তি বাড়বে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুন্দর ও আলোকিত বিকাশের জন্যে এটাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।