একজন শমশের আলী স্যার

published : ১১ আগস্ট ২০২৫

https://files.quantummethod.org.bd/resize/200/-/media/image/article/article_image_professor_dr_khondkar_siddiq_e_rabbani_20250811.png

অধ্যাপক ড. খোন্দকার সিদ্দিক-ই রব্বানী

শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ (১৯৭৮-২০০৮),
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন (২০০৮-২০১৫) এবং অনারারি প্রফেসর (২০১৬ থেকে)
বায়ো-মেডিকেল ফিজিক্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

শমশের আলী স্যারকে আমি সরাসরি শিক্ষক হিসেবে পাই নি, কিন্তু পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে একজন সহশিক্ষক হিসেবে তার অনেক সাহচর্য পেয়েছি।

বিদেশে পিএইচডি-তে করা গবেষণার বিষয় বাদ দিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের কাজে লাগে এমন কোনো গবেষণার বিষয় খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম, ১৯৭৮ সালে এদেশে ফিরে এসে। তখন মুহতাশাম স্যারের অনুপ্রেরণায় ঢুকলাম সৌর শক্তিতে, আর শামসুল ইসলাম স্যারের অনুপ্রেরণায় বায়ো-মেডিকেল ফিজিক্সে।

কিন্তু দেখলাম বিভাগে অনেক শ্রদ্ধেয় এবং মেধাবী শিক্ষকরা, যারা তত্ত্বীয় এবং মৌলিক এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্সে প্রথিতযশা, তারা আমাদের বায়ো-মেডিকেল ফিজিক্সের গবেষণাকে ভালো চোখে দেখছেন না। কেউ বলেছেন, ‘এর মধ্যে ফিজিক্স কোথায়?’, কেউ-বা আমাদের সাথে গবেষণা করতে ছাত্রদেরকে নিরুৎসাহিত করেছেন—এটিকে একটি ‘বাজে সাবজেক্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। কিন্তু শমশের আলী স্যার নিজে একজন তত্ত্বীয় ফিজিক্সের অগ্রণী হয়েও সবসময় আমাদেরকে সমর্থন দিয়ে গেছেন, উৎসাহ দিয়ে গেছেন।

তিনি একসময় টেলিভিশনে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্যে অনুষ্ঠান করতেন, সেখানে বেশ কয়েকটি এপিসোডে আমাদের গবেষণার বিষয় নিয়ে উপস্থাপন করার সুযোগ দিয়েছেন আমাকে। এ প্রসঙ্গে তার বিনয় নিয়ে একটি কথা বলব, যা প্রমাণ করে তার অবস্থান কত ওপরে : প্রতিটি এপিসোডে আলোচ্য বিষয় নিয়ে শুরুতে তিনি ভূমিকা হিসেবে কিছু কথা বলতেন। একবার আমি বললাম যে, স্যারের একটি কথায় কিছু ভুল তথ্য চলে এসেছে। তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে সাথে সাথেই সেটিকে সংশোধন করে পুনরায় উপস্থাপন করলেন। তার ভাবভঙ্গিতে দেখলাম ভুল ধরে দেয়াতে তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হন নি, বরং খুশিই হয়েছেন এবং তা ছিল সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত। এ ধরনের চরিত্র আমাদের দেশের শীর্ষস্থানীয় পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিরল।

ইলেক্ট্রনিক্সে বিশেষ আগ্রহ থাকায় আমি নিজের হাতেই গবেষণার যন্ত্রপাতি ডিজাইন ও তৈরি করতাম। এতে কেউ কেউ আমাকে নিরুৎসাহিত করতেন, বলতেন, ‘তুমি তো বিদেশের যন্ত্রের মতো গুণাগুণসম্পন্ন যন্ত্রপাতি দেশে তৈরি করতে পারবে না, তোমাদের গবেষণা শেষ পর্যন্ত হাস্যকর হয়ে যাবে না?’ কিন্তু শমশের আলী স্যারের কাছ থেকে এমন কথা কখনো শুনি নি। উপরন্তু ১৯৮৮ সালে যখন আমি বাংলাদেশে প্রথম কম্পিউটারাইজড মেডিকেল যন্ত্র তৈরি করি, যেটি দিয়ে সূক্ষ্ম স্নায়বিক সংকেত মাপা যায় এবং তা দিয়ে আমি দেশে রোগীদেরকে প্রথম নার্ভ কনডাকশন টেস্ট করে দেয়া শুরু করি, তখন শমশের আলী স্যার খুব উৎসাহ দিলেন।

১৯৯০ সালে বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স এবং থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্স থেকে আমি যখন জুনিয়র গ্রুপে স্বর্ণপদক পাই, তখন শমশের আলী স্যার একদিন আমাকে বলেন যে, তোমার ঐ যন্ত্রের জন্যেই তোমাকে এ পুরষ্কারটি দেয়া হয়েছে। বুঝতে পারি, শমশের আলী স্যার বিচারক প্যানেলে থাকার জন্যেই আমি হয়তো পুরস্কারটি পেয়েছি।

গত ২০২৩ সালে এশিয়াটিক সোসাইটিতে Science & Religion—from the perspective of a Physicist শিরোনামে আমার একটি বক্তৃতা ছিল। শমশের আলী স্যার অনলাইনে সে অনুষ্ঠানে পুরোটা সময় ধরে ছিলেন এবং আমার বক্তব্যের ওপর তার সুচিন্তিত বক্তব্য তুলে ধরেন, কারণ এ বিষয় নিয়ে আমারও অনেক আগে থেকে তার চিন্তাভাবনা ও কাজ ছিল।

কয়েক বছর আগে আমাদের ক্লাসের বন্ধু মনোয়ারের বাসায় স্যারের দাওয়াত ছিল। স্যারের বাসা আমার বাসার কাছে হওয়াতে তাকে আমার গাড়িতে নিয়ে গেলাম। গাড়িতে তিনি বললেন, একবার শান্তিনিকেতনে একটি অনুষ্ঠানে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেখানে তিনি নাকি একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিলেন। গাড়িতে বসে আমাদেরকেও সে গানের কয়েকটি লাইন গেয়ে শোনালেন। স্যার যে গান গাইতে পারেন আগে কখনো জানতাম না।

শমশের আলী স্যারের গবেষণার বিষয়ে আমার যেহেতু তেমন জ্ঞান নেই, তাই সেই দিকটা নিয়ে আমি কিছু বলব না, কিন্তু যারা বিষয়গুলো জানেন, তাদের বক্তব্য থেকে বুঝি কত উঁচু মানের একজন পদার্থবিদ তিনি ছিলেন। যেখানে দেশের অন্য পদার্থবিদেরা কেবল বিশ্বসেরা বিজ্ঞান জার্নালে প্রকাশনাকেই জীবনের সাফল্য হিসেবে ভেবে নিয়েছিলেন, এর বাইরে সবকিছুকেই যারা নিচু স্তরের কাজ হিসেবে ভাবতেন, সেখানে মেধা ও যোগ্যতায় তাদের থেকে কোনো অংশে কম না হয়েও স্যার ঠিকই বুঝেছিলেন দেশের মানুষের জন্যে কোনো অবদান না রাখতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার কোনো মূল্য নেই।

তাই তার জীবনের উল্লেখযোগ্য অংশকে তিনি বিজ্ঞানকে দেশের মানুষের কাজে লাগানোর ও সবার মধ্যে বিজ্ঞানকে ছড়িয়ে দেয়ার কাজে নিয়োজিত করেন। তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে, পাশ্চাত্যের বহুমাত্রিক সুবিধার মধ্যে থেকে যারা গবেষণা করছেন তাদের সাথে এদেশে বসে গবেষণার প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকা কঠিন, আবার সেদিকে পুরো জীবনকে নিয়োজিত করলে এদেশের মানুষের উপকারেও কিছু করা হয় না, যাদের কষ্টার্জিত আয়ের অর্থে আমাদের পড়াশোনা ও গবেষণা চলছে। তাই তিনি প্রায়োগিক গবেষণাকে খুবই পছন্দ করতেন, যার কারণে আমাদের কাজগুলো তার পছন্দের তালিকায় ছিল। নিজে তত্ত্বীয় পদার্থবিদ হয়েও নীতি-নির্ধারণী কয়েকটি আলোচনা সভায় তাকে বলতে শুনেছি যে, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে মৌলিক বিজ্ঞানের গবেষণায় ১৫%-এর মতো বাজেট বরাদ্দ রেখে ৮৫%-ই প্রায়োগিক গবেষণায় ব্যয়িত হওয়া উচিত।

শমশের আলী স্যারের জন্যে আয়োজিত দোয়া অনুষ্ঠানে গিয়ে জানতে পারি তার বহুমুখী কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের পরিচালক তিনি হন মাত্র ৩৩ বছর বয়সে, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়—দুটিরই প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য তিনি। তার স্ত্রীর প্রতিষ্ঠিত মারী কুরি স্কুলের চেয়ারম্যান, সেবামূলক প্রতিষ্ঠান আহছানিয়া মিশনের কার্যকরী পরিষদের সদস্য, ইসলামের আধ্যাত্মিকতার সাথে শিক্ষা ও সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ‘নেদায়ে ইসলাম’-এর সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান—এসব প্রমাণ করে কীভাবে নিজের জীবনকে তিনি উৎসর্গ করেছিলেন—সৃষ্টিকর্তা যে উদ্দেশ্যে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের নির্মোহ আকাঙ্ক্ষায়। তার মতো মানুষ পৃথিবীতে বিরল। পরজগতে আল্লাহ তাকে উচ্চস্থানে আসীন করে পুরস্কৃত করবেন আশা রাখি।