published : ৮ মার্চ ২০২২
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস।
মূলত ১৯১৪ সাল থেকেই বেশ কয়েকটি দেশে এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
বাংলাদেশও ১৯৭১ সাল অর্থাৎ স্বাধীনতা লাভের পূর্ব থেকেই এই দিবসটি উদযাপিত করছে।
অতঃপর ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চকে নারী দিবস হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।
১৯৯৬ সাল থেকে নারী দিবসে জাতিসংঘ একটি করে প্রতিপাদ্য বিষয় দিয়ে আসছে।
৮ মার্চ ২০২২, নারী দিবসে জাতিসংঘের স্লোগান হলো- “নারীর সমতা সকলের প্রগতি”।
নারীর অগ্রগতি প্রতিষ্ঠায় বিংশ শতাব্দীলগ্নে জন্ম নেয়া এক নারী স্বপ্ন দেখেছিলেন যা একবিংশ শতাব্দীতে এখন বাস্তব।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের কথা। অধিকাংশ নারী-ই ভাবত ঘরের বাইরে চিকিৎসা করালে বুঝি তাদের সম্মান থাকে না! নারীসমাজ ছিল নানান অপচিকিৎসার শিকার। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণই ছিল নিয়তি।
সেই নারীসমাজের মুক্তিদাত্রী হিসেবে ধূমকেতুর মতো আত্মপ্রকাশ করেন একজন নারী।
তিনি ডা. জোহরা বেগম কাজী। বাংলার প্রথম মুসলিম নারী চিকিৎসক!
বাবা ডাঃ কাজী আব্দুস সাত্তারের সাথে জোহরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছেন। অল্প বয়স থেকেই নারীদের রোগযন্ত্রণাকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে।
তখন থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখতেন চিকিৎসক হবার। একজন নারী যে চিকিৎসক হতে পারে- সেকালে এটা ভাবাও ছিল অসম্ভবের নামান্তর। কিন্তু জোহরা ভাবতে পেরেছেনই শুধু না, স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যে প্রতিনিয়তই চালিয়েছেন প্রাণান্ত প্রয়াস।
ক্লাসে সবসময়ই প্রথম হতেন তিনি; দ্বিতীয় হন নি কখনো। তার স্মৃতিশক্তি ছিল অতুলনীয়।
রায়পুরায় খ্রিস্টান মিশনারী স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে একদিন দুষ্টুমি করে বলেন, কংগ্রেসের আহ্বানে আগামীকাল সারাদেশে সব স্কুল বন্ধ থাকবে!
কথাটি স্কুলের সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে; পৌঁছে যায় স্কুল কর্তৃপক্ষের কানেও। কর্তৃপক্ষ বুঝলো এটা জোহরার মনগড়া কথা। শাস্তিস্বরূপ প্রতিদিন চার পৃষ্ঠা বাইবেল পড়তে দেয়া হলো তাকে।
একদিন ক্লাসটিচার তাকে বাইবেল থেকে চার লাইন মুখস্থ বলতে বলেন। জোহরা গোটা বাইবেল-ই ধারাবাহিকভাবে বলতে শুরু করেন। অবাক হয়ে যায় শিক্ষকসহ গোটা ক্লাস।
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন জোহরার বড় ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
একবার কবি তাদের বাড়িতে আসেন। যাওয়ার সময় কিশোরী জোহরাকে জিজ্ঞেস করেন, “তোমার জীবনের লক্ষ্য কি?" জবাবে জোহরা বলেন- "আমি পড়ব, পড়াব এবং লোকের সেবা করব”।
শুনে কবি নজরুল খুব খুশি হলেন; প্রাণভরে দোয়া করলেন তাকে।
ডা. জোহরা বেগম কাজীর জন্ম ১৯১২ সালের ১৫ অক্টোবর অবিভক্ত ভারতের মধ্যপ্রদেশের রাজনান গ্রামে। পৈত্রিক নিবাস বাংলাদেশের মাদারিপুর জেলার কালকিনি থানার গোপালপুর।
১৯২৯ সালে তিনি আলিগড় মুসলিম মহিলা স্কুল থেকে প্রথম বাঙালি হিসেবে কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক পাশ করেন।
এরপর ভর্তি হন দিল্লির পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত ‘লেডি হার্ডিঞ্জ মেডিকেল কলেজ ফর ওমেন’-এ। সেখান থেকে প্রথম বাঙালি মুসলিম ছাত্রী হিসেবে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ১৯৩৫ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে এমবিবিএস পাস করেন। ১ম শ্রেণিতে ১ম হয়ে লাভ করেন ‘ভাইসরয় পদক’।
কর্মেই জীবনের সার্থকতা- জোহরা বেগম কথাটি বিশ্বাস করতেন মনে-প্রাণে। বাস্তব জীবনেও ছিল বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি।
নাগপুরে মানুষের সেবার জন্যে মহাত্মা গান্ধী যে ‘সেবাগ্রাম’ নির্মাণ করেন জোহরা বেগম সেখানে অবৈতনিকভাবে কাজ শুরু করেন। অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে ১৩ বছর কর্মজীবন কাটিয়েছেন তিনি।
মহিলারা যেন হাসপাতালে আসতে আগ্রহী হন এবং চিকিৎসাসেবা নিতে পারেন সেজন্যে ঢাকা মেডিকেলে তিনিই প্রথম মহিলাদের পৃথকভাবে চিকিৎসা দেবার ব্যবস্থা করেন।
একবার গ্রামের এক মাদ্রাসায় জোহরা বেগম আমন্ত্রিত হন। তিনি তখন জীবনের শেষপ্রান্তে। ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেন, “তোমরা সবকিছু পড়বে। ডাক্তার বলে শুধু ডাক্তারি-ই পড়তে হবে এমন কোনো কথা নয়। তোমরা সবই পড়বে।”
জীবনের শেষক্ষণে অসুস্থ অবস্থায়ও তিনি বিশ্বাসের সাথে বলেছিলেন- আজও আমি চিকিৎসা করতে পারব!
আমৃত্যু তিনি অনাড়ম্বর জীবনযাপন করেছেন। খ্যাতির চূড়ায় উঠেও ছিলেন নিরহংকার; পোশাক-পরিচ্ছদ, চলাফেরায় একদম সাদাসিধে।
২০০৭ সালের ৭ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৮ সালে ভূষিত হন একুশে পদকে (মরণোত্তর)।
নারী দিবসের প্রাক্কালে এই মহিয়সীর প্রতি আমরা জানাই গভীর সম্মান ও শ্রদ্ধাঞ্জলি।