শিশু ভালো কিছু শিখছে তো?

মুরুব্বিরা বলেন, চারাগাছ বাঁকা হয়ে বেড়ে উঠলে তা বাঁকা বৃক্ষ হিসেবেই থেকে যায়, আর সোজা হয় না। গাছের প্রাণ আছে। কিন্তু তাকে সোজা করার জন্যে কোনো শিক্ষক নেই, আছে কাঠি, লাঠি বা বাঁশ। সুতলি (পাটের চিকন দড়ি) দিয়ে চারাগাছকে বেঁধে রাখতে হয় একটি কাঠি বা লাঠি বা কচি বাঁশের সাথে। এতে যদি কিছুটা সোজা হয়!

মানুষকে সোজা করার জন্যে কি আর কাঠি, লাঠি বা বাঁশ চলে? আগে মা-বাবা সন্তানকে কোথাও মারলে সে নিজেকে সান্ত্বনা দিত যে, যাক মেরেছে মেরেছে, এ জায়গাটা আগে বেহেশতে যাবে। এখনকার স্মার্ট শিশুরা মোটেও তা ভাবে না। তাদের প্রশ্ন, আমি যাওয়ার আগে ঐ জায়গাটা বেহেশতে গিয়ে করবেটা কী?

তাই কোনোরকমে বুঝ দেয়ার বা হিসাব মেলানোর জন্যে গোঁজামিল বলে যা করি আমরা বড়রা, কেউ কেউ, কখনো সখনো, তা করার সুযোগ কমে আসছে। মোবাইল ফোন যদি স্মার্ট হতে পারে, বোকার বাক্স টিভি যদি স্মার্ট হতে চেষ্টা করতে পারে তো মানব সন্তানরা কেন স্মার্টার হবে না। হবেই তো! আজ হোক বা কাল। তাই তাদেরকে কী শেখাচ্ছি বা শেখার জন্যে তাদের সামনে কী তুলে ধরছি, সেটা নিয়েই এখন চিন্তা।

বাল্যশিক্ষার বইয়ে ছড়া আছে মামা বাড়ি নিয়ে। আমাদের সমাজে এখনো অধিকাংশ পরিবারে শিশু জন্ম নেয়ার প্রথম কয়েক মাস তার কাটে নানার বাড়িতে। কারণ, নতুন মায়েরা কী করবেন আর কী করবেন না বুঝে উঠতে পারেন না বলে নিজের মায়ের কাছে থাকতেই বেশি সাচ্ছন্দ্য পান। এতে অসুবিধার কিছু নেই। শিশুর প্রথম আবাসন, নানা বাড়ি একসময় হয়ে ওঠে তার সুখময় স্থান। তবে গোলমালটা যেন বাঁধান নানাবাড়িতে মামার বউ হয়ে আসা ভদ্রমহিলাটি, যিনি সম্পর্কে হন মামী। এবং এই দৃশ্যই তুলে ধরা হয়েছে সেই ছড়ায় এভাবে-

তাই তাই তাই

মামা বাড়ি যাই

মামা দিল দুধ-ভাত

পেট ভরে খাই

মামী এলো লাঠি নিয়ে

পালাই পালাই

আহা বেচারা, তার প্রিয় নানাবাড়ি এখন মামারও বাড়ি। যেখানে গিয়ে কত তৃপ্তি করেই না দুধ-ভাত খেল। খাওয়ার পর কোথায় একটু আরামে বসবে, তা নয়। নিষ্ঠুর মামী (!) তার দুধ-ভাত অন্যের সন্তান খেয়ে গেল বলে লাঠি নিয়ে তাড়া করলেন! একটা শিশু মনে কারো সম্পর্কে কী কুটিল ধারণাই না সৃষ্টি করছে এই ছন্দ। যে শিশুটি তার মামীকে মায়ের মতোই পেয়েছে, সে যখন এই ছড়া সুর করে পড়বে, একটু একটু করে মামীর সম্পর্কে তার অবচেতন মনে সন্দেহের বীজ দানা বাঁধতে থাকবে। বাস্তবে মামীর কথাবার্তা, আচরণ সবকিছু দেখে সে মেলাতে শুরু করবে আমার মামী লাঠি নিয়ে হয়তো তাড়া করছেন না, কিন্তু চোখ রাঙিয়ে, ধমকে কিছু বলছেন না তো! মামী কি ভালো? মামী কি খারাপ? বেচারা মামীকে সারাক্ষণ স্ক্যানিং চলতেই থাকবে। এর পরিণতি কী? মানসিক দ্বন্দ্ব বাস্তবেও দ্বন্দ্ব বাড়ায়। মনে মনে ঝগড়া করলে বাস্তবেও ঝগড়া বাড়ে।

‘শিশুর সরলতা‘ লিও টলস্টয়ের একটি ছোট গল্প। গল্পটি সংক্ষেপে এরকম- দুটি শিশু নতুন জামা পড়ে খেলছে। খেলতে খেলতে পাশেই কাদামাটি ছিল। তো সেই কাদামাটি একজন আরেকজনের জামায় লাগিয়ে দেয়। তো যার জামায় কাদামাটি লেগেছে সেই সময়ই তার মা সেখান এসে উপস্থিত। যে শিশুটি কাদামাটি লাগিয়েছে মা রেগে গিয়ে তাকে ধরে এক চড় লাগিয়ে দিয়েছেন। তখন সেই শিশুটি কান্না শুরু করে দিলে সেই শিশুটির মা-ও সেখানে এসে উপস্থিত হন। তো দুই মায়ের মধ্যে শুরু হয় তুমুল ঝগড়া। বাড়ির পুরুষরাও এসে জমা হয়। তখন এক প্রাজ্ঞ ব্যক্তি এসে তাদের ঝগড়া থামানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।

যেখানে বড়রা ঝগড়ার একপর্যায়ে মারামারি করার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, সেখানে শিশু দুটি আবার একসাথে আপন মনে খেলা আরম্ভ করেছে। গল্পের প্রাজ্ঞ ব্যক্তিটি তখন বড়দেরকে বললেন, এদের কাছ থেকে শেখো সরলতা কাকে বলে।

এই যে শিশুর সরল মন, একে দয়া করে কলুষিত হতে দেবেন না। কারো মন্দটা তাকে বলে বলে তার সরল মনটা বিষিয়ে দেবেন না। ভালো কিছু বলুন, সে ভালো ভাববে। আর ভালো ভালো ভাবলে, ভালো হবেই। তাই মামার বাড়িতে যাওয়ার আনন্দ নিয়ে যে ছড়াটি লেখা হয়েছিল, সে আনন্দ আরো বাড়িয়ে দিতে আমরা বলতে চাই একটু অন্যভাবে। খুশির খবর হলো, ইতোমধ্যেই এ নিয়ে সুজনেরা ভেবেছেন। ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমী বইমেলায় একটি শিশুতোষ প্রকাশনার স্টল থেকে ভেসে আসছিল গানের সুরে-

তাই তাই তাই

মামা বাড়ি যাই

মামী দিলেন দুধ-ভাত

পেট ভরে খাই

মামা এলেন ছিপ নিয়ে

মাছ ধরতে যাই

শিশুকে বাঘ, কুকুর বা দৈত্য-দানোর ভয় দেখাবেন না। শিশু বয়সে বিরাটকায় দৈত্য-দানো কল্পনা করতে করতে  যখন স্কুলে যাবে টিচারকে দেখে ভয় পাবে, সহপাঠীকে দেখে কুঁকড়ে যাবে, পরীক্ষাকে ভাববে জুজু, ভাইভা বোর্ডকে ভাববে ফাঁসির মঞ্চ, তারপর চাকরি করতে গেলে বসকে দেখে কাঁপবে দুই পা। কারণ, ভয় যে তার মনে ঘাপটি মেরে আছে। ভয়ের কোনো আকার নেই, সে সবসময় অন্য ব্যক্তি বা বস্তুর ওপর ভর করেই ভয় দেখাতে আসে।

শিশুকে রূপকথাও শোনাবেন না। ধরুন, যে রূপকথায় আছে চেরাগ ঘষলে দৈত্য এসে সব করে দেয়। বাস্তবে সে যখন চেরাগ পাবে না, তখন খুঁজবে কে কে তার কাজ করে দিতে পারে। পা বলে হাঁক ছাড়বে, আর মা-কে বা গৃহকর্মীকে পানির গ্লাস নিয়ে ছুটে আসতে হবে। নিজের কাজ নিজে করার ক্ষেত্রে এই যে মানসিক পঙ্গুত্ব, এটা শারীরিক পঙ্গুত্বের চেয়েও মারাত্মক।  

সবশেষে, ২০১৭ সালে কোয়ান্টামের আহ্বান একে সমমর্মিতার বছর করার। তাই চলুন এ ছড়াটিকে আমরা নতুন করে লিখি

আয় রে আয় টিয়ে
নায়ে ভরা দিয়ে
না’ নিয়ে গেল বোয়াল মাছে
তাই না দেখে ভোঁদড় (নাচে) কাঁদে
ওরে ভোঁদড় ফিরে চা
খোকার (নাচন) দোয়া দেখে যা।

মাঝির নাও নিয়ে গেছে বলে ভোঁদড়ের সহানুভূতি প্রকাশ যেন পায় কান্নায়। আর মাঝি যেন নাও হারানোর কষ্ট ভুলে আবার নতুন করে শুরু করতে পারে, ভোঁদরের কান্না যেন থামে সেজন্যেই পরম করুণাময়ের সাহায্য চেয়ে দোয়া করছে খোকা। এরকম মানবিক মহাসমাজ যেন আমরা গড়ে তুলি পৃথিবী জুড়ে, এটাই আমাদের প্রার্থনা।