published : ৩০ মে ২০২২
গর্ভধারণ এবং নির্দিষ্ট সময় পর শিশুর জন্ম- পৃথিবীতে প্রাণীকুলের আগমনের ছকটাই এরকম!
জন্মদান ও জন্মগ্রহণের এই প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক নিয়মেই হয়ে আসছে সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে। কিন্তু আধুনিক সময়ে এসে যেন ব্যত্যয় ঘটেছে এই চিরন্তন নিয়মে! ঘটিয়েছি আমরাই সিজারিয়ান বা সি-সেকশন বার্থের কৃত্রিম উপায়ে বাচ্চাকে পৃথিবীতে আনতে গিয়ে, যার কিছুটা প্রয়োজনে আর বেশিরভাগই বিনা প্রয়োজনে। কিন্তু মা ও সন্তানের কল্যাণ কি তাতে হচ্ছে?
WHO-এর সাম্প্রতিক জরিপমতে বিশ্বজুড়ে এখন ২১ শতাংশ শিশু জন্মাচ্ছে সিজারিয়ানের মাধ্যমে। অন্যদিকে 'সেভ দ্য চিলড্রেন' বলছে, বাংলাদেশে গত দুই বছরে সিজারিয়ানের হার বেড়েছে ৫১ শতাংশ!
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, এসময় বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ৮০ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। যার ৭৭ শতাংশই ছিল অপ্রয়োজনীয়!
আসলে সিজারিয়ান অপারেশন অনেকটাই নির্ভর করে হাসপাতালগুলোর ওপর৷ সিংহভাগ ক্ষেত্রেই ডাক্তাররা সিজারিয়ান করান স্রেফ ক্লিনিকের বিল বাড়ানোর জন্যে!
গত এক যুগে দেশে সিজারিয়ান বেড়েছে ৮ গুন; এ-বাবদ ব্যয় হয়েছে ৪,০৮১ কোটি টাকা! এই বিপুল অংকই প্রমাণ করে কতটা রমরমা বিজনেস প্রোডাক্ট এটা।
নরমাল ডেলিভারিতে যে খরচ হয়, সার্জারি কস্ট, সিট/কেবিন ভাড়া, ওষুধবাবদ সিজারিয়ানে লাগে তার কয়েকগুণ। সিজারিয়ানের ব্যাপারে ক্লিনিকগুলোর অতিউৎসাহের এ এক ‘যৌক্তিক’ কারণ! কিন্তু এ-ব্যাপারে সাধারণ মানুষের আগ্রহের কারণ কী?
মূলত কিছু নেতিবাচক ধারণাই সিজারিয়ানের দিকে যাবার রাজপথ! যেমন-
· আমাদের দেশের মায়েদের গড় উচ্চতা কম এবং তাদের গর্ভাশয় তুলনামূলক ছোট। তাই সন্তানের নরমাল ডেলিভারি খুব কঠিন!
· সিজারিয়ান করলে ব্যথা লাগে না, তাহলে খামোখা অত কষ্ট কেন সহ্য করতে যাব?
· ‘সিজারিয়ান' শব্দটির সাথে খানিকটা আধুনিকতা আর বিত্তের সম্পর্ক জুড়ে গেছে!
· আগের ধাত্রী আর এখনকার ধাত্রীর তফাৎ আকাশ-পাতাল! এর থেকে সিজারই ভালো!
· সিজারিয়ান বেবি বেশি স্মার্ট!
এ-ছাড়াও সিজারের দিকে অনেকে যান নিকটাত্মীয়, বিশেষত প্রসূতির পরিবারের চাপের মুখে বাধ্য হয়ে।
আর হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নেয়ার পর প্রসূতিকে দেখেই চিকিৎসকেরা নরমাল ডেলিভারির ব্যাপারে এমনভাবে ভয় পাইয়ে দেয় যে সিজারের দিকে না গিয়ে তার পরিবারের গতিক থাকে না।
আর দশটা সার্জারির মতো সিজারিয়ানেও যথেষ্ট ঝুঁকি থাকে বিধায় যেখানে বহির্বিশ্বে এটাকে এড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে সেখানে দেশে মুড়িমুড়কির মতো হচ্ছে সিজার অপারেশন। এতে করে মা ও সন্তান উভয়ই পড়ছে নানা রোগের ঝুঁকিতে।
মায়ের দিক থেকে ঝুঁকির জায়গা হলো অপারেশন-পরবর্তী সেলাই। কারণ সেলাইয়ে ইনফেকশন হলে পরবর্তীতে এটি হার্নিয়ার রূপ নিতে পারে। সেলাইয়ের স্থানে পুঁজ জমে হতে পারে পেটের চামড়ার মারাত্মক ক্ষতি। সম্ভাবনা থাকে অ্যানেস্থেশিয়ার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে হাড় ক্ষয় হওয়ার।
সিজারের পর নারীদের ফার্টিলিটি বা সন্তান ধারণের ক্ষমতাও কমে যায়।
সিজারিয়ানকালে মাকে যেসব অ্যানেস্থেটিক ড্রাগ দেয়া হয় তা নবজাতকের উপরও প্রভাব ফেলে। সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারেও বাধা হয়ে উঠতে পারে সিজার।
স্বাভাবিক প্রসবকালে শিশুর ফুসফুসে চাপ পড়ে বাড়তি জলীয় পদার্থ বেরিয়ে যায়, যা সিজারিয়ান শিশুর ক্ষেত্রে হয় না। এতে ফুসফুস নাজুক হয়ে শ্বাসকষ্ট বা এজমাজনিত সমস্যা তৈরি করে। যে-কারণে সিজারিয়ান বেবিদের মধ্যে অল্পতেই ঠান্ডা লাগার প্রবণতা দেখা যায়।
এছাড়াও, নবজাতকের ৩৫০টি ইমিউন জিনের পরিবর্তন হয় সিজারিয়ান অপারেশনের ফলে৷ যা শিশুর দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য জটিলতার কারণ৷
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাভাবিক প্রসবে জন্ম নেওয়া শিশুরা বেশি স্মার্ট এবং এরাই পরবর্তী জীবনে অনেক বেশি মেধার পরিচয় দিয়েছে।
নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে জন্মানো শিশুরা কষ্টসহিষ্ণু হয়। শ্বাসকষ্ট এবং এ্যাজমাজনিত সমস্যা এদের কম হয়। অন্যদিকে, জন্মগ্রহণকালে এদের শরীরে কিছু ভালো ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
জন্মের পরপরই এরা দ্রুত মায়ের বুকের দুধ পায়। মাতৃগর্ভ থেকে বেরোনোর অল্প সময়ের মধ্যে নবজাতক পায় মায়ের বুকের উষ্ণতা, সিজারিয়ান শিশুরা যা পায় দেরিতে।
এসব কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ হলো, একদম অপরিহার্য না হলে সিজার না করা। তাই একজন সচেতন নারী হিসেবে সন্তান জন্মদানে স্বাভাবিক প্রসবই হওয়া উচিৎ আপনার প্রথম পছন্দ!
অনেকের ধারণা একবার সিজারিয়ান হলে আর কখনো নরমাল ডেলিভারি করা যাবে না। এটা ভুল ধারণা! বাস্তবতা হলো একাধিকবার সিজার অপারেশনের পরও নরমাল ডেলিভারি সম্ভব। এমনকি তিন সিজারিয়ানের পরও নরমাল ডেলিভারির নজির আছে।
তাই প্রথম সন্তান হোক বা পরবর্তী, চেষ্টা থাকা উচিৎ নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের।