published : ১ আগস্ট ২০২২
জন্মের পর থেকে প্রথম ছয় মাস মাতৃদুগ্ধই হওয়া উচিত শিশুর একমাত্র খাবার।
এসময় মধু, জ্যুস, স্যুপ বা অন্য কোনো পানীয়, এমনকি পানি পান করানোরও প্রয়োজন নেই। কারণ মায়ের দুধের শতকরা ৯৫ ভাগই পানি।
ছয় মাসের পর থেকে মায়ের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য স্বাভাবিক খাবার দেয়া যেতে পারে। তবে দু' বছর পর্যন্ত মায়েরা শিশুদের অবশ্যই স্তন্যদান করবেন।
শিশুর জন্মের পর প্রথম দুই-তিনদিন মায়ের শরীরে যে ঘন আঠালো হলুদাভ দুধ তৈরি হয় তাকে বলা হয় কলোস্ট্রাম (Colostrum) বা শালদুধ। পরিমাণে কম উৎপন্ন হলেও শিশুর জন্যে এটি আশীর্বাদ।
এন্টিবডি ও এন্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর এই দুধ নবজাতককে বিভিন্ন রোগ-জীবাণু থেকে রক্ষা করে, শরীরে তৈরি করে দীর্ঘমেয়াদী রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা। তাই জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে নবজাতককে অবশ্যই শালদুধ পান করাতে হবে।
অন্তত দুই বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের সঙ্গে বসবাস করেছে এমন শিশুদের ওপর পরিচালিত বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের (বিডিএইচএস) ২০১৭-১৮ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে শিশুর প্রথম ছয় মাস পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ পানের হার ৬৫ শতাংশ।
স্তন্যদানের ব্যাপারে জ্ঞানের অভাব, বুকের দুধ খাওয়ালে ফিগার নষ্ট হয়ে যাবে- এমন ভুল ধারণা, পেশাজীবী নারীদের সন্তানকে স্তন্যদানের সময়-সুযোগের অভাব, স্তন্যদানের জন্যে নির্ধারিত স্থানের (breast feeding zone) স্বল্পতা- এমন কারণগুলোই দায়ী স্তন্যদানের হার কমার জন্যে।
বাংলাদেশে মায়েদের স্তন্যদানের অগ্রগতিকে ব্যাহত করছে ফর্মুলা দুধের আগ্রাসী বিপণন- এমনটিই উঠে এসেছে ইউনিসেফের একটি রিপোর্টে।
ফর্মুলা মিল্ক উৎপাদন ও বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রাসী ভূমিকার কারণে এবং বিজ্ঞাপনের মোহে পড়ে অনেক মা-ই এখন ফর্মূলা মিল্কের দিকে ঝোঁকেন। টেলিভিশনের পর্দায় ফর্মুলা দুধের চটকদার বিজ্ঞাপনে নাদুসনুদুস শিশুদের দেখে অনেক মা-ই মনে করেন এই দুধ খাওয়ালে বুঝি তার শিশুটিও এমন হবে!
পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে চিকিৎসকরাও নবীন মায়েদের ফর্মুলা দুধ খাওয়াতে উৎসাহিত করেন।
নিয়মিত কৌটার দুধ খাওয়ালে শিশু ভুগতে পারে পেটের পীড়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, এলার্জি ও অপুষ্টিজনিত নানা রোগে।
বিশেষ অবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শে শিশুকে কৌটার দুধ দেয়ার প্রয়োজন হলেও তা অবশ্যই শিশুর অভ্যাসে পরিণত করা ঠিক নয়।
আবার যেহেতু কৌটার দুধপানে বাচ্চাকে কষ্ট করতে হয় না, তাই এক সময় সে মায়ের দুধ খাওয়া বন্ধ করে দেয়। এতে মায়ের শরীরে কাঙ্ক্ষিত হরমোন তৈরি হয় না, ফলে কমে যায় দুধ উৎপাদন।
এছাড়াও গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু কৌটার দুধ খায় তাদের তুলনায় যারা মায়ের দুধ খায় তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ হয় বেশি।
শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্যে যত ধরনের পুষ্টি উপাদানের প্রয়োজন রয়েছে তার সবটাই আছে মায়ের দুধে। শিশুর জন্যে স্রষ্টাপ্রদত্ত এই খাবারের চেয়ে ভালো, এমনকি বিকল্পই হতে পারে না।
আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না থাকায় তা শিশুর জন্যে নিরাপদও। মায়ের দুধ শিশু সহজেই হজম করতে পারে; গ্যাসের সমস্যা, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্ত থাকায় শিশু থাকে প্রাণবন্ত ও সতেজ।
মাতৃদুগ্ধে রয়েছে পর্যাপ্ত আমিষ, চর্বি, শর্করা, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ম্যাগনেসিয়াম।
মায়ের দুধে পূর্ণমাত্রায় ভিটামিন-এ থাকে, যা শিশুর চোখ ও ত্বকের জন্যে উপকারী। আর ম্যাগনেসিয়াম ও ক্যালসিয়াম শিশুর হাড় ও হৃদপিণ্ডের গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
এছাড়াও এতে পর্যাপ্ত পরিমাণে জিঙ্ক থাকে যা শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশের জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
যেসব শিশু মায়ের দুধ পান করে, তাদের বয়স অনুপাতে শরীরের ওজনও থাকে আদর্শ।
মায়ের দুধই শিশুর প্রধান রোগ প্রতিষেধক। যেসব শিশু মায়ের দুধ পান করে তাদের কান পাকা রোগ, নিউমোনিয়া, শ্বাসনালীর রোগ, হাঁপানি, এলার্জি, চর্মরোগ ইত্যাদি সংক্রমণের আশঙ্কা কম থাকে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকায় শিশু অসুস্থ হলেও দ্রুতই সেরে ওঠে।
মাতৃদুগ্ধ পানে শিশুর ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা কমে যায়। ফলশ্রুতিতে কমে অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি।
শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মো. মুজিবুর রহমান বলেন, কিছু অপরিণত নবজাতকের নেকরোটাইজিং এন্টারোকোলিটিস (এনইসি) হয়।সেক্ষেত্রে শিশুর পেট ফুলে যায়, ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়, শিশু একদম মৃত্যুরদ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। এ ধরনের শিশুদের একমাত্র মায়ের দুধ পান করিয়েইবাঁচানো যায়।
স্তন্যদানে মায়ের সাথে সন্তানের বন্ধন হয় সুদৃঢ়। ফলে সন্তানের মাঝে নিরাপত্তাবোধ ও আত্মবিশ্বাসের ভিত গড়ে ওঠে শৈশবেই।
দুধ খেতে খেতে মায়ের বুকে ঘুমিয়ে পড়া- এটা শিশুর মধ্যে নিরাপত্তার অনুভূতি তৈরি করে। অন্যদিকে, যেসব শিশু মায়ের বুকের দুধবঞ্চিত তাদের মধ্যে বড় হওয়ার পরও নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি কাজ করে।
কাজেই একজন সচেতন মা হিসেবে বিশেষ কোনো মেডিকেল কারণ ব্যতীত কোনো অজুহাতেই সন্তানকে বুকের দুধবঞ্চিত করবেন না।