published : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
শিশু কীভাবে পৃথিবীর আলো দেখবে, কোন প্রক্রিয়ায় সে ভূমিষ্ঠ হবে- স্বাভাবিক প্রসব নাকি সিজারিয়ান, এ দুয়ের ভালো-মন্দ নিয়ে বিশ্বজুড়ে তর্কবিতর্কের শেষ নেই। এদিকে পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইউরোপ-আমেরিকার পাশাপাশি এশিয়ার দেশগুলোতেও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের হার। কিন্তু এটা কতটা যুক্তিযুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত? প্রশ্নটা এবার উঠেছে খোদ পাশ্চাত্যেই।
স্বাভাবিক প্রসবই সাধারণভাবে সবার কাম্য। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রসব-জটিলতা এড়াতে কিংবা শিশুর জীবন রক্ষার্থে সিজারের প্রয়োজন হতে পারে। যেমন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দীর্ঘায়িত প্রসব, প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল যখন আশঙ্কাজনকভাবে জরায়ুমুখের কাছে নেমে আসে, মাতৃগর্ভে শিশুর অস্বাভাবিক অবস্থান কিংবা প্রসবের আগেই নাড়ি জরায়ুর বাইরে বেরিয়ে আসা। এছাড়াও রয়েছে গর্ভবতী মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ডিম্বাশয় ও জরায়ুর সিস্ট, টিউমার ইত্যাদি। ঝুঁকিপূর্ণ এসব পরিস্থিতিতে চিকিৎসকরা সিজারিয়ান প্রসবের পক্ষে মত দেন।
The Business of Being Born. ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিপ্রাপ্ত এ ডকুমেন্টারিতে যে দৃশ্যটি দেখে দর্শকরা সবচেয়ে বেশি ভিরমি খেয়েছেন তা ছিলো, সিজারিয়ান অপারেশন করে একটি শিশুকে তার মাতৃগর্ভ থেকে বের করে আনার দৃশ্য। বহুল আলোচিত এ তথ্যচিত্রের নির্বাহী প্রযোজক সাবেক আমেরিকান টিভি উপস্থাপিকা রিকি লেক ও এর পরিচালক অ্যাবি এপস্টেইন। সবার কাছে তারা শুধু একটি বার্তাই পৌঁছে দিতে চেয়েছেন-মা এবং অনাগত সন্তানের স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়ানোর দরকার পড়লেই কেবল সিজারিয়ান অপারেশন করা উচিত এবং প্রসবকালে মা ও শিশুর সুস্থতাসহ সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এটা কখনোই প্রথম পছন্দ হওয়া উচিত নয়।
সিজারিয়ান অপারেশনের ঝুঁকি সম্পর্কিত একটি সাম্প্রতিক জরিপও তাদের এই মতামতকে সমর্থন করেছে। অক্টোবর ২০০৭-এ বৃটিশ মেডিকেল জার্নাল পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. জোস ভিলার ৪১০টি ল্যাটিন আমেরিকান হাসপাতালের ৯৭,০০০ ডেলিভারি রিপোর্ট অনুসন্ধান করেন। তারপর তিনি এ সত্যে উপনীত হন যে, স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় সিজারিয়ান করা মায়েদের মৃত্যুঝুঁকি তিনগুণ বেশি। রিপোর্টে বলা হয়, স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে যেখানে মায়েদের মৃত্যুঝুঁকি ০.১%, সেখানে সিজারিয়ানের ক্ষেত্রে ০.৪%। ডা. ভিলার বলেন, সিজারিয়ান একটি মেজর অপারেশন বলে এর ঝুঁকিও স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি।
এছাড়াও সিজারের পর মায়ের শরীরে রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। আবার স্বল্প ওজনের বাচ্চার বেলায় স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় সিজারের মৃত্যুঝুঁকি দ্বিগুণ। উপরন্তু, সিজারিয়ান অপারেশনে জন্ম নেয়া বাচ্চাদের মধ্যে শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত জটিলতা পরিলক্ষিত হয়। কারণ, স্বাভাবিক প্রসবের সময় শিশুর ফুসফুস থেকে কিছু তরল নিঃসৃত হয়, যা মাতৃগর্ভের বাইরে এসে স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্যে শিশুর ফুসফুসকে প্রস্তুত করে দেয়। সিজারিয়ান অপারেশন এই প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে।
এসবের পরও চিকিৎসক গবেষক বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন-সিজারিয়ান প্রাণ বাঁচায়, যখন সত্যিই তা প্রয়োজন। কিন্তু এ নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রসব প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে হাসপাতালগুলোতে ‘পিটোসিন’ নামে একটি ওষুধ ব্যবহারের চল রয়েছে, যা প্রসূতির জরায়ুতে প্রয়োজনীয় সংকোচন সৃষ্টি করে। কিন্তু এ সংকোচন আবার কিছুটা ব্যথা সৃষ্টি করে, তাই এ ব্যথার উপশমে চিকিৎসকরা দেন ব্যথানাশক ইনজেকশন (Epidural Painkiller), যেটি জরায়ুর সংকোচনকে ধীর ও বিলম্বিত করে, যা গর্ভস্থ শিশুর ঝুঁকির কারণ হতে পারে। অতঃপর চিকিৎসকরা শেষপর্যন্ত সিজারের পক্ষেই মত দেন। এর প্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, হাসপাতালগুলো এক্ষেত্রে পরিচালিত হচ্ছে মুনাফার চিন্তায়।
Pushed : The Painful Truth About Childbirth and Modern Maternity Care গ্রন্থের লেখক জেনিফার ব্লক বলেন, ‘ধরুন, আপনি একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকলেন, আরাম করে টেবিলে বসলেন কিন্তু কোনো খাবারের অর্ডার দিলেন না, ফলে স্বাভাবিকভাবেই রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ আপনার কাছ থেকে কোনো পয়সাই নিতে পারলো না। হাসপাতাল, ক্লিনিকে গিয়ে সিজার না করে সন্তান প্রসব করাও অনেকটা তেমনি।’ তার মতে, ‘স্বাভাবিক প্রসব হাসপাতালগুলোর জন্যে লাভজনক নয়।’ উল্লেখ্য, স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় সিজারিয়ান অপারেশন কয়েকগুণ বেশি ব্যয়বহুল।
শুধু তা-ই নয়, স্বাভাবিক প্রসবে যেখানে সাধারণত একদিনের বেশি হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন হয় না, সেখানে সিজারের ক্ষেত্রে থাকতে হয় পাঁচ থেকে সাত দিন পর্যন্ত। অর্থাৎ একদিকে সিজারের খরচ, তার সাথে যুক্ত হয় হাসপাতাল বা ক্লিনিকে তুলনামূলক বেশিদিন অবস্থানের খরচ। এর পাশাপাশি অতিরিক্ত ওষুধের খরচ তো আছেই। তবু কেবল আমেরিকাতেই নয়, বিশ্বজুড়েই বেড়ে চলেছে অপ্রয়োজনীয় সিজারের হার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০০৮ সালে সারা পৃথিবীতে যত শিশুর জন্ম হয়েছে তার মধ্যে ৬২ কোটিই হয়েছে অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান অপারেশনে!
Misconceptions : Truth, Lies, and the Unexpected on the journey to Motherhood বইটির লেখিকা নাওমি উল্ফ। তিনি অভিযোগের আঙুল তুলেছেন ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ও হাসপাতালগুলোর দিকে। এছাড়াও বিশেষজ্ঞদের মতে, বিভিন্ন টিভি-সিরিয়াল ও চলচ্চিত্রে স্বাভাবিক প্রসব প্রক্রিয়াকে সবসময় দেখানো হয় একটি তীব্র যন্ত্রণাময় ও রক্তক্ষয়ী বিষয় হিসেবে, যা অযাচিত কিছু ভীতির সৃষ্টি করে। কিন্তু এগুলো থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের প্রকৃত ধারণা নিয়ে মূল সত্যটা জানা উচিত।
এ পরিস্থিতিগুলো ছাড়াও বর্তমানে আরেকটি কারণে সিজারের প্রবণতা বাড়ছে, তা হলো স্বেচ্ছা সিজার। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, ইলেকটিভ সিজারিয়ান সেকশন। এক্ষেত্রে সন্তান জন্মদানের জন্যে মা-ই স্বেচ্ছায় সিজারিয়ান প্রসবের পথ বেছে নেন। সাম্প্রতিককালে সচেতন চিকিৎসকদের দুশ্চিন্তার কারণ মূলত এই স্বেচ্ছা সিজার। কোনো কোনো চিকিৎসকের মতে, ‘বর্তমানে সারা পৃথিবীতেই সিজারের হার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ মায়েদের চাহিদা। অনেক ব্যস্ত মায়েরা তাদের প্রসবের সময়সূচিটা নিজেদের মতো তৈরি করে নিতে চান।’
গর্ভধারণের ৩৭ থেকে ৪২ সপ্তাহ পর্যন্ত সময়টি হলো সন্তান প্রসবের স্বাভাবিক কাল। কিন্তু স্বেচ্ছা সিজারের বেলায় অধিকাংশ প্রসবই হয়ে থাকে ৩৪ থেকে ৩৬ সপ্তাহের মধ্যে অর্থাৎ স্বাভাবিক গর্ভকালীন সময়ের আগেই। এর ফলে সিজারিয়ান শিশুরা কিছু স্বাস্থ্য-জটিলতার সম্মুখীন হয়, শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা যার মধ্যে অন্যতম। ফলে শিশুর নিঃশ্বাসের গতি দ্রুত হয়ে ওঠে, যা ‘টাইপ টু রেসপিরেটরি স্ট্রেস সিনড্রোম’ নামে পরিচিত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যারা স্বেচ্ছায় সিজার করাতে চান তারা যেন এর ঝুঁকির দিকটিও সমানভাবে বিবেচনা করেন। কারণ, সিজারের ঝুঁকি বহুমুখী। মূত্রথলি ও অন্ত্রে অপারেশনজনিত আঘাতের ঝুঁকি, দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা, মারাত্মক রক্তক্ষরণ-যাতে রক্ত পরিসঞ্চালনেরও প্রয়োজন হতে পারে, এমনকি রয়েছে প্রসূতি মায়ের মৃত্যুর ঝুঁকি। এছাড়াও অপারেশনের সময় জরায়ুতে জীবাণু সংক্রমণ হলে তা উপশমে কখনো কখনো ছয় মাস পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। অপারেশনের ক্ষত শুকাতে জরায়ুর টিস্যুতে যে পরিবর্তন ঘটে, তাতে ভবিষ্যৎ গর্ভধারণও হয়ে ওঠে তুলনামূলক ঝুঁকিপূর্ণ। আশঙ্কার বিষয়টি হলো, সিজার-পরবর্তী জটিলতায় আক্রান্ত হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নবজাত সন্তানকে মায়ের স্তন্যদানে বিলম্ব ও বিঘ্ন ঘটে।
এছাড়াও চেতনানাশক ওষুধের ঝুঁকি এবং অন্যান্য দিক বিবেচনায় সিজারকে একটি মেজর অপারেশন বলেই গণ্য করা হয়, সাথে এর আনুষঙ্গিক ঝুঁকিগুলো তো আছেই। আর এ প্রক্রিয়ায় বাচ্চাকে মায়ের জরায়ু কেটে বের করা হয় বলে ভবিষ্যৎ গর্ভধারণও কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
প্রখ্যাত মেডিকেল জার্নাল ‘ল্যানসেট’-এ বলা হয়েছে, সিজারের ঝুঁকি কমানোর অন্যতম উপায় হলো শুধুমাত্র চিকিৎসাশাস্ত্র নির্দেশিত পরিস্থিতিগুলোতেই এর দ্বারস্থ হওয়া। কারণ, স্বেচ্ছা সিজার মা ও শিশুর জীবনকে নানারকম ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। Caesarean Section without Medical Indication শীর্ষক একটি প্রতিবেদনের সুরও একইরকম-স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় সিজারে মায়ের ঝুঁকি ও ক্ষতির শঙ্কা তিনগুণ বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০০৭ ও ২০০৮ সালে ভারত নেপাল শ্রীলঙ্কা থাইল্যান্ড ফিলিপাইন জাপান চীন কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে একটি জরিপ চালায়। এ নয়টি দেশের ১২২টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে স্বেচ্ছা সিজার পরবর্তী জটিলতাগুলো পর্যবেক্ষণ করা হয়। এতে দেখা যায়, এসব মায়েদের একটি বড় অংশকে হয় আইসিইউ-তে ভর্তি করতে হয়েছে অথবা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে রক্ত পরিসঞ্চালন করতে হয়েছে, এমনকি মৃত্যুবরণও করেছে কেউ কেউ।
সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলভার্নিয়া হাসপাতালের প্রসূতি বিশেষজ্ঞ ডা. হো হন কক্ বলেন, কোনো কোনো মায়েরা স্বেচ্ছায় সিজারিয়ান বেছে নেন, এর কারণ প্রধানত মানসিক। তারা আসলে স্বাভাবিক প্রসবের ব্যথা ও অন্যান্য শারীরবৃত্তিয় পরিবর্তনগুলো নিয়ে বৃথাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। কেউ-বা আবার দিন-তারিখ-রাশি মিলিয়ে নির্দিষ্ট শুভদিনে সন্তান জন্ম দিতে চান, তখন স্বাভাবিকভাবেই তিনি সিজারের প্রতি আগ্রহী হন। আর এই ইচ্ছেমতো শিডিউলিং করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯০ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে সময়ের আগে জন্ম নেয়া অপরিণত শিশুজন্মের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, চীনে মোট প্রসবের অর্ধেকই ঘটে সিজারের মাধ্যমে, যার এক চতুর্থাংশই স্রেফ অপ্রয়োজনীয়। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে মোট এক লক্ষ প্রসবের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দেশেও বেশ নাটকীয়ভাবেই যেন বেড়ে গেছে সিজারিয়ান প্রসবের হার। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে গবেষণা অনুসন্ধান শুরু হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে (প্রথম আলো, ১৯ এপ্রিল ২০১১) একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। তাতে রাজধানীর একটি হাসপাতালের চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, সেই হাসপাতালে ২০১০ সালে ১০ হাজার ২৩৬টি শিশুর জন্ম হয়, যার মধ্যে ৬৬ শতাংশই ঘটে সিজারের মাধ্যমে!
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন বিস্ময়কর চিত্র শুধু রাজধানীর একটি হাসপাতালের নয়, সারা দেশেই কমবেশি এমনটি ঘটছে। মাতৃমৃত্যু ও মাতৃস্বাস্থ্যসেবা জরিপ ২০১০ অনুসারে, সে বছর দেশে প্রায় চার লাখ ৩৮ হাজার শিশু সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে জন্ম নিয়েছে। ২০০১ সালের তুলনায় এ সংখ্যা পাঁচ গুণ বেশি!
রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশে শিশুজন্মের সংখ্যা ও হার বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে অপ্রয়োজনীয় সিজারের সংখ্যাও। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, এর জন্যে কোনো জবাবদিহির ব্যবস্থা নেই। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। তাদের মতে, ২০১০ সালের মোট সিজারিয়ান অপারেশনের মধ্যে এক লাখ ৪০ হাজার ছিলো নিছক অপ্রয়োজনীয়। অর্থাৎ শুধু সে বছরেই অপ্রয়োজনীয় সিজারের পরিমাণ ছিলো ৩২ শতাংশ ! জরিপে বলা হয়েছে, শিক্ষিত ও ধনী শ্রেণী অর্থাৎ সামর্থ্যবানদের ক্ষেত্রে এর হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। পরিসংখ্যান মতে, ব্যক্তিমালিকানাধীন হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে যত প্রসব হচ্ছে তার ৭১ শতাংশই হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় সিজারে।
সে রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ফ্যাকাল্টির ডীন প্রফেসর ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, অপ্রয়োজনীয় সিজারের কারণে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। এছাড়াও সিজারিয়ান অপারেশনের সময় বেদনানাশক ও চেতনানাশক ব্যবহার করা হয়, এর প্রভাব পড়ে মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যের ওপর। আইসিডিডিআরবি-র জনস্বাস্থ্য কার্যক্রমের প্রধান পিটার কিম স্ট্রিটফিল্ড-এর মতে, সিজারের ফলে নবজাত শিশুকে মায়ের দুধ শুরু করাতে সমস্যা দেখা দেয়। এতে মায়ের জরায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি বাড়ে। প্রসব-পরবর্তীকালে মায়ের মানসিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
এ প্রসঙ্গে আরেকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রসূতি মায়ের এমন কিছু লক্ষণের কথা বলা আছে, যখন সত্যিই সিজার করা প্রয়োজন। কিন্তু চিকিৎসক যেন সেটি অবশ্যই ব্যবস্থাপত্রে উল্লেখ করেন-কেন এক্ষেত্রে সিজার করা হলো। তিনি মনে করেন, এমন জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকলে অপ্রয়োজনীয় সিজারের হার কমে যাবে। দেশের বিশিষ্ট শিশু-চিকিৎসক প্রফেসর ডা. এম কিউ কে তালুকদার বলেন, ‘প্রসবযন্ত্রণা শুরু হলে মা-কে অবশ্যই সার্বিক নজরদারিতে রাখা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাভাবিক প্রসবের জন্যে চিকিৎসক শেষপর্যন্ত অপেক্ষা করবেন, চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। এটাই মেডিকেল এথিকস বা নৈতিকতা।’
২০১০-এ যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জীবনের প্রথম দিনগুলোতে যেসব ক্ষুদে অণুজীব আমাদের শরীরে এসে স্থান করে নেয়, তারাই পরবর্তীতে আমাদের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তোলে। উপরন্তু এরা অন্যান্য ক্ষতিকর জীবাণুগুলোকে প্রতিহত করে। স্বাভাবিক প্রসবকালে মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসার সময় শিশুর শরীরে এরকম প্রায় ১০০ প্রজাতির হিতকরী ব্যাকটেরিয়া এসে জমা হয়। যেমন ল্যাকটোব্যাসিলাস, যা দুধ ও দুধ জাতীয় খাবার হজমে অন্যতম সহায়ক।
এ তুলনামূলক গবেষণাটিতে দেখা গেছে, স্বাভাবিক প্রসবজাত শিশুর ত্বক, নাক, মুখ ও পায়ুপথে যেসব উপকারী ব্যাকটেরিয়ার হদিস মেলে সে তুলনায় সিজারিয়ান শিশুর শরীরে প্রাপ্ত ব্যাকটেরিয়াগুলো একেবারেই ভিন্ন প্রকৃতির। কারণ, সিজারিয়ান শিশুরা মাতৃদেহের স্বাভাবিক প্রসব-পথ অতিক্রম করতে পারে না বলে এসব উপকারী অণুজীবগুলো থেকে তারা বঞ্চিত হয়।
অন্যদিকে ইউনিভার্সিটি অব পুয়ের্তো-রিকো, ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডো এবং ভেনিজুয়েলার দুটি হেলথ ইনস্টিটিউটের যৌথ গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, সিজারিয়ান শিশুদের ত্বক ও শরীরে প্রায়শই পাওয়া যায় স্ট্যাফাইলোকক্কাস এবং এসিনোব্যাকটার-এর মতো ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া। এসব বিবেচনায় গবেষকরা বলেন, সিজার শিশুর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে যেভাবে ব্যাহত করে, সেটি তার ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যের জন্যে মোটেই অনুকূল নয়। ফলে সাধারণভাবে এসব শিশু এলার্জি, এজমা এবং দুর্বল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাজনিত বিভিন্ন রোগের ঝুঁকিতে থাকে।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে নির্ভেজাল আর গভীরতম সম্পর্কটি হলো মা এবং সন্তানের। ইয়েল ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণায় ব্রেন স্ক্যান পরীক্ষায় দেখা গেছে, যেসব মায়েরা স্বেচ্ছায় সিজার করিয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে এ সম্পর্কের উষ্ণতা তুলনামূলক কম। সম্ভাব্য কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্বাভাবিক প্রসবকালে যখন জরায়ুতে সংকোচন ঘটে তখন মায়ের পিটুইটারি গ্ল্যান্ড থেকে ‘অক্সিটোসিন’ নামক একটি হরমোন নিঃসৃত হয়। আর মা ও সন্তানের মাঝে মমতার সেতুবন্ধন ও সুষম আত্মিক যোগাযোগ রচনার ক্ষেত্রে এ হরমোনটির রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। কিন্তু সিজারের পুরো প্রক্রিয়াটিতে এ হরমোনটির কোনো ভূমিকাই নেই বলে পরবর্তীকালে এসব মায়েদের বিষণ্নতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অপেক্ষাকৃত বেশি থাকে।
ইয়েল ইউনিভার্সিটির গবেষক জেমস স্যাইন বলেন, আমরা সিজারের বিপক্ষে নই, কিন্তু সেটি যেন শুধুমাত্র সত্যিকার প্রয়োজনেই ঘটে। এ ব্যাপারে ডা. হো-এর মতামতও সুস্পষ্ট-‘যেসব মায়েরা সিজারে আগ্রহী তাদের উচিত আগেই চিকিৎসকের সাথে খোলামেলা আলোচনা করে পুরো বিষয়টি জেনে নেয়া। তারপর একটি সুস্পষ্ট ধারণা নিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া-তিনি আসলে কোনটি বেছে নেবেন। আর আমরা যেন ভুলে না যাই যে, স্বাভাবিক প্রসবই সবদিক থেকে ভালো।’
তথ্যসূত্র : রিডার্স ডাইজেস্ট (জুলাই ২০১১)
নিউজউইক (ফেব্রুয়ারি ২০০৮)