রক্তদান সম্পর্কে ৫টি ভুল ধারণা

published : ১৩ জুন ২০২৩

রক্তদান এমন একটি মহৎ কাজ যার তুলনা আর কোনোকিছুর সাথেই হয় না। কেননা রক্তের বিকল্প শুধুই রক্ত।

একজন রক্তের জন্যে কাতর মানুষ ও তার ভুক্তভোগী পরিবারই শুধুমাত্র বোঝেন এক ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করতে কতটা পরিশ্রম করতে হয়।

বাংলাদেশে বিগত বছরগুলোতে স্বেচ্ছা রক্তদানকারীদের সংখ্যা বাড়লেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল।

এখনো অনেকেরই আছে রক্তদান সম্পর্কিত কিছু ভুল ধারণা। অনেকেই একে দেখেন এক ভীতিকর কাজ হিসেবে। রক্তদান করলে কেউ মারা যায় না।

চলুন জেনে নেয়া যাক, রক্তদান সম্পর্কে কী কী ভুল ধারণা সাধারণভাবে রয়েছে।

সূঁচের ভয়

রক্ত দিতে যারা ভয় পান এদের একটা বড় অংশই এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন সুঁইয়ের ভয়কে!

রক্ত না দেয়া অধিকাংশের বড় ভয় থাকে সূঁচে (ছবি সূত্র : www.ekushey-tv.com)

যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল মনোবিজ্ঞানী রক্তদানে ভয়ের মূল কারণ চিহ্নিত করার জন্যে একটি জরিপ করেন।

১,০০৮ জন পুরুষ এবং নারীর ওপর করা এই জরিপে উঠে আসে অবাক করা তথ্য।

২৭%-এরও বেশি অংশগ্রহণকারী জানান যে, রক্তদানের সময় অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন এই আতঙ্ক তাদের ভেতর কাজ করে!

প্রায় ১২% জানান রক্তদানের সময় বা তারপরে মাথা ঘোরা, মাথাব্যথা বা জ্ঞান হারাবার ভয় তাদেরকে রক্তদানের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করে।

অথচ গবেষণায় দেখা গেছে যে, রক্তদানের আগে জ্ঞান হারানো মানুষের সংখ্যা ৪%-এরও কম!

আর রক্ত দেয়ার সময় বা পরে জ্ঞান হারায় ১% এরও কম!

তারমানে এক অমূলক ভয় অনেককেই রক্তদানের মতো মহৎ ও পুণ্যময় কাজ থেকে দূরে রাখছে।

অথচ নিয়মিত রক্তদাতাদের ভাষ্যমতে, রক্ত দেবার সময় শরীরে যখন সুঁই ফোটানো হয়, তা একটি পিঁপড়ার কামড়ের থেকে মোটেই বেশি কিছু নয়! এমনকি এই ব্যথা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সয়ে যায়।

অথচ একবার ভাবুন, সেই অসহায় মুখগুলোর কথা!

আপনার শরীরের উচ্ছিষ্ট রক্তটুকু পেলেই যে কি না প্রাণে বাঁচতে পারত, অকালে ঝরে পড়ত না থ্যালাসেমিয়ায় ভোগা নিষ্পাপ শিশুগুলো!

সময়ের প্রতিশ্রুতি

আজ দেবো, কাল দেবো করে করে রক্তদানের জন্যে সময় বের করতে পারেন না কেউ কেউ।

অথচ চার মাস পরপর বছরে মাত্র তিনটি দিন রক্তদানের জন্যে সময় বের করা মোটেই অসম্ভব কিছু না। প্রয়োজন শুধু ইচ্ছাশক্তি।

বিশ্বখ্যাত স্বেচ্ছাসেবী মানবিক সংস্থা ‘রেড ক্রস’ এর তথ্য অনুযায়ী একজন পরিপূর্ণ সুস্থ মানুষের রক্তদান করতে সময় লাগে মাত্র ৮ থেকে ১০ মিনিট। রক্তদানের আগে ও পরে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও বিশ্রামসহ সর্বোচ্চ ৪০-৫০ মিনিট সময় ব্যয় হয় স্বেচ্ছা রক্তদানে।

চার মাস পরপর বছরে মাত্র তিনটি দিন নিয়মিত রক্তদান করুন।

কিন্তু গড়িমসি করে অনেকেই নিজেকে বঞ্চিত করেন অত্যন্ত পুণ্যময় এই কাজ থেকে।
তাই প্রতি চার মাস পরপর ব্যক্তিগত শিডিউলে একটি দিন রক্তদানের জন্যে নির্ধারিত রাখুন।

রক্তদানের আনন্দ ও তৃপ্তি যখন আপনি একবার উপলব্ধি করবেন, তখন সারাবছরই আপনি অপেক্ষায় থাকবেন এই দিনটির।

সম্ভাব্য স্বাস্থ্যঝুঁকি

রক্তদান সম্পর্কিত সবচেয়ে প্রচলিত ভুল ধারণা হলো, রক্ত দিলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়।

আসলে বিষয়টি তো তা নয়ই বরং নিয়মিত রক্তদানে শরীর থাকে আরো সুস্থ!

নিয়মিত রক্তদানে শরীরের রক্ত চলাচল প্রক্রিয়া বাধাহীনভাবে হয়। ফলে ধমনীতে ব্লক হবার সম্ভাবনা কমে আসে।

গবেষণায় দেখা গেছে, বছরে অন্তত তিনবার যারা রক্তদান করেন, তাদের হৃদরোগ ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হবার হার আশ্চর্যজনকভাবে কম!

নিয়মিত রক্তদানে শরীর থাকে আরো সুস্থ , হয়ে উঠে আরো পরিপূর্ণ ফিট।

রক্তদানের পরপরই শরীরের অস্থিমজ্জা নতুন কোষ তৈরির জন্যে উদ্দীপ্ত হয়। রক্ত দান করার মাত্র ২ সপ্তাহের মধ্যেই নতুন রক্ত কণিকা জন্ম হয়ে এই ঘাটতি পূরণ করে দেয়।

আর প্রাকৃতিক নিয়মেই যেহেতু প্রতি ৪ মাস পর পর রক্তের রেড সেল বদলে যায়, তাই বছরে ৩ বার রক্ত দিলে শরীরের লোহিত কণিকাগুলোর প্রাণবন্ততা ও কর্মদক্ষতা আরো বেড়ে যায়।

বিখ্যাত মেডিকেল জার্নাল ‘Journal of the National Cancer Institute’ এ প্রকাশিত হয়েছে, নিয়মিত রক্তদানে ক্যান্সারের সম্ভাবনা কমে ৩৭%!

এমনকি প্রথমবার রক্তদানের মাত্র ছয় মাসের মাথায় ক্যান্সারের হ্রাসের এই পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে।

ইংল্যান্ডে এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, নিয়মিত স্বেচ্ছা রক্তদাতারা দুরারোগ্য রোগ-ব্যাধি থেকে প্রায়ই মুক্ত থাকেন।

নিয়মিত রক্তদাতাদের ফুসফুস, লিভার, পাকস্থলী, কোলন ক্যান্সারসহ ১৭টিরও বেশি রোগের ঝুঁকি কম থাকে।

নারীদের সম্পর্কে ভুল ধারণা

রক্তদানের ক্ষেত্রে আরও একটি প্রচলিত ভুল ধারণা নারীদের এই মহৎ উদ্যোগ থেকে পিছিয়ে রাখে।

যেমন নারীদের শরীরে রক্ত এমনিতেই কম, রক্ত দিলে তো শরীরে কিছুই থাকবে না! ত্বক শুষ্ক ও প্রাণহীন হয়ে যাবে!

অথচ বাস্তব চিত্র কিন্তু একেবারেই ভিন্ন।

গড়পরতা নারীর শরীরে উদ্বৃত্ত রক্তের পরিমাণ ৮০০ মি.লি.। অন্যদিকে, স্বেচ্ছা রক্তদানে একজন দাতার কাছ থেকে নেয়া হয় মাত্র ৩৫০ থেকে ৪০০ মিলিলিটার রক্ত। তাই এক ব্যাগ রক্ত দেয়ার পরও শরীরে থাকে পর্যাপ্ত রক্ত।

নারীরা নির্ভয়ে স্বেচ্ছায় নিয়মিত রক্ত দিতে পারেন। (ছবি সূত্র : www.ppbd.news)

আর রক্তদানের পরবর্তী কিছুদিন ভিটামিন-সি যুক্ত ফলমূল, সবুজ শাকসবজি, ডিম, মাছ, মাংস, দুধ খেলে এবং পর্যাপ্ত পানি পান করলে প্রদত্ত রক্তের ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়।

নিয়মিত রক্তদান ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে; কমিয়ে দেয় শরীরে অতিরিক্ত মেদ জমার প্রবণতা।

শরীরে ফ্রি রেডিকেল তৈরি হওয়ার কারণে বয়স বাড়ার সাথে সাথে বুড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়, নারীদের ক্ষেত্রে যা বেশি দৃশ্যমান। রক্ত দিলে শরীর থেকে ফ্রি রেডিকেলগুলো বের হয়ে যায়, যা সাহায্য করে তারুণ্য ধরে রাখতে।

এ-ছাড়াও, নিয়মিত রক্তদানে ত্বক থাকে টানটান ও লাবণ্যময়, দেহমন থাকে প্রাণবন্ত ও এনার্জেটিক।

অবশ্য কিছু বিশেষক্ষেত্রে নারীদের রক্তদান করা থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়।

যেমন- অসুস্থ কিংবা মাসিক বা পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে রক্ত দেয়া যাবে না। মাসিক শেষ হবার সাত দিন পর নারীরা রক্ত দিতে পারেন।

অন্তঃসত্ত্বা কিংবা প্রসূতি, স্তন্যদানকারী মা কিংবা গর্ভপাত হয়ে থাকলে রক্তে আয়রনের মাত্রা স্বাভাবিকের চাইতে কিছুটা কম থাকে। তাই আয়রনের মাত্রা স্বাভাবিক হলেই একজন নারী রক্তদান করতে পারবেন।

Reference:

https://www.colorado.edu/health/2020/01/24/top-3-blood-donation-fears-and-how-overcome-them

https://healthmatters.nyp.org/the-surprising-benefits-of-donating-blood/

https://nutritionfacts.org/blog/lowering-you-cancer-risk-by-donating-blood/#:~:text=The%20blood%20donors%20ended%20up,significantly%20reduced%20risk%20of%20death.