বাড়ছে থ্যালাসেমিয়া, প্রয়োজন সচেতনতা

একটি ঘটনা। ভাই এবং বোন, দুজনই থ্যালাসেমিয়া রোগী। প্রতি মাসে রক্ত নেয়া লাগে বলে দুজন একসাথে রক্ত নিতে যান। এতে বাবা-মায়েরও সুবিধা হয়।

একদিন হঠাৎ রক্ত নেয়ার সময় ঘনিয়ে আসলে তারা হাসপাতালে গিয়ে রক্ত পেলেন না। একদিন দুইদিন তিনদিন হয়ে গেল। রক্ত নেই। ওদিকে সময়ের সাথে সাথে দুজনের অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হতে শুরু করল।

এর মধ্যে একজন ডাক্তার দেখলেন যে তার রক্তের গ্রুপের সাথে মিলে যায়। তিনি সাথে সাথে রক্ত দিলেন। কিন্তু রক্তের ব্যাগ তো একটা, রোগী দুজন। বোন বলছে ভাইকে রক্ত দিন, ভাই বলছে বোনকে। অবশেষে বোনের জেদের কাছে হার মানলো ভাই, রক্ত নিল। কিন্তু আর একটি ব্যাগ রক্ত জোগাড় সম্ভব হলো না। বোনটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল।

বাড়ছে থ্যালাসেমিয়া রোগ (ছবিসূত্র : www.bhorerkagoj.com)

থ্যালাসেমিয়ার গল্পগুলো খুব দুঃখের হয়। আমাদের দেশে বর্তমানে প্রতি ৮ জনে একজন থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত। বছরে গড়ে আড়াই হাজার করে এর রোগী সংখ্যা বাড়ছে। যারা এ রোগে আক্রান্ত তাদের প্রতি মাসে ২ থেকে ৩ বার রক্ত নিতে হয় বেঁচে থাকার জন্যে।

থ্যালাসেমিয়া কী

থ্যালাসেমিয়া একটি ব্লাড ডিজঅর্ডার। অনেকেই একে রক্তের ক্যান্সার ভেবে ভুল করেন। তবে এটি বংশগত জিনঘটিত বংশগত একটি রোগ। এতে রক্তে অক্সিজেন পরিবহনকারী হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে ত্রুটি দেখা দেয় যার ফলে রক্তে অক্সিজেন স্বল্পতা (অ্যানিমিয়া) ঘটে।

থ্যালাসেমিয়া একটি ব্লাড ডিজঅর্ডার। এটা কোন ক্যান্সার নয়! বংশগত একটি রোগ।

থ্যালাসেমিয়া রোগের উপসর্গ কী

হলদে ত্বক বা জন্ডিস, দেহে অতিরিক্ত আয়রন জমা হওয়া, স্‌প্লিন বা প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া, শারীরিক বৃদ্ধি হ্রাস পাওয়া, পেট বাইরের দিকে প্রসারিত হওয়া, গাঢ় রঙের মূত্র ইত্যাদি থ্যালাসেমিয়ার রোগীর উপসর্গ। সাধারণত জন্মের ছয় মাস বয়স থেকেই এই উপসর্গগুলো দেখা দিতে শুরু করে।

তবে থ্যালাসেমিয়া রোগীর উপসর্গ আর বাহকের উপসর্গ এক নয়। কেউ থায়ালসেমিয়া বাহক কিনা তা বাহ্যিকভাবে বোঝার কোনো উপায় নেই। এর জন্যে রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে।

থ্যালাসেমিয়ার রোগী এবং বাহক এক নয়

থ্যালাসেমিয়া রোগী ও বাহক হওয়া একেবারেই ভিন্ন ব্যাপার। একজন থ্যালাসেমিয়া বাহক সমাজের আর দশজনের মতই স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠেন। তাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই।

তবে থ্যালাসেমিয়া রোগী হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে যত দ্রুত সম্ভব।

থ্যালাসেমিয়া মানেই জীবন শেষ নয়

থ্যালাসেমিয়ার বাহকদের কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না।

থ্যালাসেমিয়া রোগীদের শরীরে রক্তের হিমোগ্লোবিন ঠিকমতো তৈরি হয় না। যে কারণে একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর তাদের রক্ত নিতে হয়। সাধারণত প্রতি মাসে ১-৪ ব্যাগ রক্ত রোগীরা নিয়ে থাকেন। যেহেতু বারবার রোগীকে রক্ত নিতে হয়, তাদের শরীরে আয়রনের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার আশংকা থাকে। সেক্ষেত্রে বিশেষ ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হয়।

থ্যালাসেমিয়া মানেই জীবন শেষ নয়

আর আধুনিক যুগে থ্যালাসেমিয়া রোগের যুগান্তকারী চিকিৎসা হচ্ছে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন (BMT-Bone Marrow Transplant) যা খুবই ব্যয়বহুল।

কীভাবে এই রোগ প্রতিরোধ সম্ভব

থ্যালাসেমিয়া একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। এই রোগ প্রতিরোধের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে সচেতনতা। একজন থ্যালাসেমিয়া বাহক যদি আরেকজন থ্যালাসেমিয়া বাহককে বিয়ে করেন, তাহলে তাদের সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে ২৫%। তাই বিয়ের আগেই বর কনের থ্যালাসেমিয়ার পরীক্ষা করে নেয়া উচিৎ।

একজন থ্যালাসেমিয়া বাহক যদি আরেকজন সুস্থ মানুষকে বিয়ে করে তাহলে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া হওয়ার কোনো আশংকা থাকে না।

বিয়ের আগে সবার উচিত থ্যালাসেমিয়া টেস্ট করিয়ে নেয়া। (ছবিসূত্র : www.prothomalo.com)

তবে যদি থ্যালাসেমিয়া বাহকদের মাঝে বিয়ে হয়েই যায়, তাহলে গর্ভধারণের ৮ থেকে ১৪ সপ্তাহের মধ্যে মায়ের জরায়ুর পানি পরীক্ষা করে বাচ্চার অবস্থা জানা যাবে। গর্ভের শিশু যদি থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হন তাহলে বাবা-মাদের বিশেষ কাউন্সেলিং করতে হবে। আর বাচ্চা থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে স্বাভাবিক জন্মদানে অসুবিধা নেই।

থ্যালাসেমিয়া রোগীদের পাশে দাঁড়াতেই প্রতিষ্ঠিত হয় কোয়ান্টাম ব্লাড ল্যাব

এই লেখার শুরুতে যে ভাই বোনের গল্পটি বলা হলো, তারা আসলে কোয়ান্টাম ব্লাড ল্যাবের অনুপ্রেরণা। যে ডাক্তার সেদিন রক্ত দিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন একজন কোয়ান্টাম গ্রাজুয়েট। তার কাছ থেকে এই মর্মান্তিক ঘটনা জানার পরই কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন উদ্যোগ নেয় নিরাপদ রক্তের প্রয়োজনে মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানোর।

২০০০ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ কোয়ান্টাম ব্লাড ল্যাব

২০০০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে দুই দশকের যাত্রায় কোয়ান্টাম গড়েছে ৪ লক্ষ ৭০ হাজার স্বেচ্ছা রক্তদাতার সুসংগঠিত ডোনার পুল। জীবন বাঁচানোর জন্যে এ পর্যন্ত কোয়ান্টাম বিতরণ করেছে ১৪ লক্ষ ৬৩ হাজার ইউনিট রক্ত ও রক্ত উপাদান।

কোয়ান্টাম ল্যাবে থ্যালাসেমিয়া রোগীদেরকে ফ্রিতে রক্ত সরবরাহ করা হয়।

থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্যে কোয়ান্টাম ল্যাবে আছে বিশেষ কার্ড করার সুব্যবস্থা। যেন ল্যাবে এলেই তারা সরাসরি রক্ত পেয়ে যান। সাধারণত থ্যালাসেমিয়ার রোগীদের প্রতি মাসে রক্ত যোগাড় করতে খরচ পড়ে যায় ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। অনেক স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে এ খরচ বহন করা সম্ভব হয় না। তাদেরকে বিনামূল্যে বা নূন্যতম প্রসেসিং খরচে বছরের পর বছর ধরে রক্ত সরবরাহ করে যাচ্ছে কোয়ান্টাম ব্লাড ল্যাব। এই পর্যন্ত দুই লক্ষ ৬৫ হাজার ইউনিট রক্ত থ্যালাসেমিয়া রোগীদেরকে রক্ত সরবরাহ করেছে কোয়ান্টাম। ২০২২ সালে ১৭,৪৬০ ইউনিট রক্ত থ্যালাসেমিয়া রোগীদেরকে ফ্রি দেয়া হয়েছে।

জরুরি রক্তের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন কোয়ান্টাম ল্যাবে :

+৮৮ ০২ ২২২২২১৮৬৯
+৮৮ ০২ ৪৮৩২২৮০৯
+৮৮ ০১৭১৪০১০৮৬৯