করোনাকালে কোয়ান্টাম

published : ২৯ ডিসেম্বর ২০২০

ডিসেম্বর, ২০১৯ - চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান থেকে অজানা এক ভাইরাসে মানুষের সংক্রমিত হওয়ার খবর গণমাধ্যমে আসতে থাকে। পরবর্তীতে ভাইরাসটির নামকরণ হয় নভেল করোনাভাইরাস।

৩০ জানুয়ারি ২০২০ –পৃথিবীর ১৯টি দেশে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জারি করে জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা (Public Health Emergency) ।

৮ মার্চ ২০২০ - বাংলাদেশে শনাক্ত হয় প্রথম করোনা রোগী।

১১ মার্চ ২০২০ - কোভিড-১৯ কে ‘প্যান্ডেমিক’ (অতিমারি) ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।


লকডাউনে জনশূন্য রাজধানীর ব্যস্ত সড়ক (ছবিসূত্র- দৈনিক ইনকিলাব)

১৭ মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ আর ২৫ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণার সাথে সাথে দেশব্যাপী কার্যত শুরু হলো লকডাউন।

সকাল দুপুর রাত- মিডিয়ায় শুধু আতঙ্ক আর ভয়েরই খবর।

বিশ্ববাসীর মতো দেশের জনজীবনেও নেমে আসে চরম হতাশা আতঙ্ক অনিশ্চয়তা আর অস্থিরতা!

ঠিক সেই সময় কোয়ান্টামের দৃপ্ত উচ্চারণ শুধু এর হাজার হাজার সদস্যকেই ভরসা যোগায় নি, আশ্বস্ত করেছে দেশ-বিদেশের লাখো বাংলাভাষীকেও।

ডেটলাইন ১৯ মার্চ : সবার কাছে পৌঁছে গেল চিঠি- ‘আতঙ্ক নয়, সতর্ক হোন’

দেশে করোনা বিস্তারের একদম শুরুতে পারিপার্শ্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করে কোয়ান্টাম যখন বুঝতে পারলো দেশের মানুষের জনমনে আতঙ্ক দানা বাঁধতে শুরু করেছে তখনই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে তৈরি হলো চিঠি- আতঙ্কিত নয়, সতর্ক হোন। যেখানে জোরালোভাবে বলা হয় কোভিড-১৯ নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে এর মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় সতর্কতা এবং করণীয়-বর্জনীয় সম্পর্কে।

ব্যক্তিজীবনে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার শুদ্ধাচার পালন, সারাদিন ঘরের মধ্যে সোশাল মিডিয়া ও গণমাধ্যমে করোনা সংবাদে বুঁদ না থেকে স্বাভাবিক কর্মব্যস্ত জীবনযাপন, সঠিক খাদ্যাভাস, নাস্তার সাথে কালিজিরা ও রসুন খাওয়া, মেডিটেশন যোগব্যায়াম ও প্রাণায়াম- সব মিলিয়ে সুস্থ জীবনাচার করোনায় দেবে সুরক্ষা-

এই মেসেজসম্বলিত চিঠি হাতে হাতে, মেইলে এবং অনলাইন মেসেজিং অ্যাপের মাধ্যমে পৌঁছে গিয়েছিল লাখো মানুষের কাছে।

বাসায় সাদাকায়ন, গুরুজীর কণ্ঠে ২৯টি আলোচনা, ১৩৪ দিনের প্রায় প্রতিদিনই চিঠি!

এমনিতে সাদাকায়নসহ কোয়ান্টামের প্রতিটি প্রোগ্রাম-ই ভেন্যুকেন্দ্রীক। অর্থাৎ অংশগ্রহণ হয় শাখা সেল সেন্টারে সশরীরে। কিন্তু লকডাউনের একদম গোঁড়াতেই কর্তৃপক্ষের স্বিদ্ধান্তে পাবলিক প্রোগ্রাম বন্ধ করতে হলো। তবে সমস্যাকে নতুন সম্ভাবনায় রূপান্তরের যে কথা কোয়ান্টাম সবসময় বলে সেটি নিজেদের ক্ষেত্রে করে দেখিয়েছে করোনার এই সময়ে।

২০ মার্চ থেকে শুরু হলো ঘরে ঘরে সাদাকায়ন। প্রতি শুক্রবার সকাল ৯টায় গুরুজীর কন্ঠে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা এবং মেডিটেশনে একাত্ম হতে পেরেছে দেশ ও দেশের বাইরের অসংখ্য মানুষ।


লকডাউনের গৃহবন্দী সময়ে ঘরে ঘরে সাদাকায়নে একাত্ম হয়েছে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ

২৭ মার্চ থেকে ৩১ জুলাই বাসায় সাদাকায়নের ২০টি আয়োজনের প্রতিটিতেই ফাউন্ডেশন থেকে প্রেরণ করা হয়েছে গুরুজীর সাদাকায়ন আলোচনার রেকর্ডকৃত অডিও।

আর এতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বেড়ে গেল কয়েকগুণ। আগে হয়তো পরিবারের একজন বা দুজন মিলে সাদাকায়নে যেতেন। কিন্তু তখন পরিবারের সবাই, এমনকি ছোট শিশু, গৃহকর্মী বা বয়স্ক পরিজনরাও সাদাকায়নে অংশ নিতে পেরেছেন।

এ-ছাড়াও শবে বরাত, শবে কদর, মাহে রমজান ও আখেরি দোয়ার বিশেষ আলোচনাসহ গুরুজীর মোট ২৯টি আলোচনার অডিও পৌঁছে গেছে হাজার হাজার সদস্যের কাছে। শুদ্ধাচার, সিরাত এবং খতমে কামালির দৈনিক অডিও তো ছিলই!

অর্থাৎ ১৩৪ দিনের প্রায় প্রতিদিনই আমরা পেয়েছি শ্রদ্ধেয় গুরুজীর নতুন নতুন বাণী সম্বলিত অডিও! যেখানে করোনাভাইরাস সম্পর্কিত সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়াও সমসাময়িক নানা বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়। তুলে ধরা হয় মিডিয়ায় করোনা নিয়ে আতঙ্কবাদীদের ভয়ঙ্কর সব পূর্বাভাস আর হুঁশিয়ারির অসারতা। পরিস্থিতির সঠিক ও যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে জ্ঞাপন করা হয় অভয়বাণী।

করোনা মোকাবেলায় সেরা অস্ত্র হলো আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। কিন্তু অহেতুক আতঙ্ক ও মানসিক চাপে ভুগে বেশিরভাগ মানুষ তাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে নিজেদের অরক্ষিত করে ফেলছিল। অবস্থা বুঝে মানুষকে স্ট্রেসমুক্ত করে করোনা মোকাবেলায় সমর্থ করতেই নেয়া হয়েছিল পদক্ষেপগুলো।

কেন এই আতঙ্ক প্রচার?

১৯ মার্চ ২০২০ শ্রদ্ধেয় গুরুজী তার প্রথম আলোচনাতেই বলেন 'আতঙ্কের গ্রামার' নিয়ে। তিনি খুব স্পষ্ট করে বলেন- আতঙ্ক প্রচার থেকে যারা লাভবান হবে তারাই এই আতঙ্কের প্রচার করছে। তার বক্তব্যের কিয়দাংশ-

"আসলে আতঙ্কের একটা গ্রামার আছে।

প্রথম জিনিসটা যে কত ভয়াবহ, কত লোক মারা গেছে, কত ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে, মানুষ কত অসহায় হয়ে গেছে- এটাকে প্রচার করা হয়। এবং এটাকে শুধু ফোলাতে ফাঁপাতে থাকা।

যখন বেশি ফুলতে ফুলতে জিনিসটা ফেটে যায়, যখন আসল সত্যটা বেরিয়ে আসে, তখন আবার বলা শুরু হয় যে, ভবিষ্যতে পরিস্থিতি কত ভয়াবহ হতে পারে! যাতে বাস্তব সত্য জানার পরও আতঙ্ক থেকে সে বেরিয়ে আসতে না পারে।"

২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু-র দৃষ্টান্ত দিয়ে গুরুজী বলেন, "সে-সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞসহ পাশ্চাত্যের শীর্ষ ধনী দেশগুলোর স্বাস্থ্য বিষয়ক যেসব কর্মকর্তা একযোগে মিডিয়াকে ব্যবহার করেছিলেন আতঙ্ক প্রচারের জন্যে, তাদের প্রায় সবাই-ই কোনো না কোনোভাবে সুবিধা ভোগ করছিলেন হফম্যান লা রশ এবং গ্ল্যাক্সো স্মিথক্লাইন বিচাম নামে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দুটি ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে। যারা ছিল 'টেমি ফ্লু' নামে একটি ওষুধ বা তার মূল উপাদানের প্রস্তুতকারক। এই ওষুধটিকেই সোয়াইন ফ্লু নিরোধে কার্যকর বলে রায় দিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

টিকা, ওষুধ বিক্রি শেষ, পৃথিবীতে সোয়াইন ফ্লু-আতঙ্ক বলেও আর কিছু থাকল না!

এবং এবার করোনাভাইরাসকে ঘিরেও একই আতঙ্ক, একই ভীতির প্রচার করা হয়েছে। প্রায় প্রতিটি দেশকে ঘিরে ছিল মৃত্যুর পূর্বাভাস, যে আমেরিকায় ২২ লক্ষ, বৃটেনে ৫ লক্ষ, অমুক দেশে 'এত' লক্ষ, এমনকি বাংলাদেশেও এক লক্ষ মানুষ মারা যাবে। ভারতে নাকি সুনামির মতো ধেয়ে আসবে করোনা, ৩০ কোটি মানুষ আক্রান্ত হবে।

অথচ আজ এক বছরের মাথায় এসেও এসব ভবিষ্যদ্বাণীর কোনোটাই বাস্তব হয় নি।

গুরুজী খুব স্পষ্ট করে বলেন, আতঙ্ক প্রচার থেকে যারা লাভবান হবে তারাই এই আতঙ্কের প্রচার করছে। যাদের মূল উদ্দেশ্য সারা পৃথিবীর মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া। তাহলে যারা ভোগবাদী যারা বিলাসী পণ্যের ব্যাপারী ভার্চুয়াল জগতের যারা ব্যাপারী তারা ভালো ব্যবসা করতে পারবে।

আতঙ্কের ডামাডোলে সম্পদ ফুলে ফেঁপে উঠেছে প্রযুক্তি খাতের বেনিয়াদের

সারা পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র ‘সঙ্ঘ’ হিসেবে দাঁড়িয়েছিলাম

আসলে সারা পৃথিবীতে ‘সঙ্ঘ’ হিসেবে আমরাই একমাত্র ছিলাম যারা এই আতঙ্ক প্রচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলাম! যারা সঠিক ও যৌক্তিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের আলোয় প্রতিটি বিষয়কে ব্যাখ্যা করেছে।

বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কোনো ব্যক্তি হয়তো বলেছেন, কিন্তু সঙ্ঘ হিসেবে আমরাই ছিলাম একমাত্র।

নতুন ওয়েবসাইট ‘করোনা জয়’

এপ্রিলের শুরুতেই তৈরি হলো নতুন সাইট ‘করোনা জয়’। উদ্দেশ্য- করোনা পরিস্থিতিতে সারাবিশ্বের মানুষ যে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে, তা থেকে তাকে মুক্ত করে ইতিবাচক করা। মানসিকভাবে উজ্জীবিত করা।

করোনা-সংক্রান্ত গুরুজীর আলোচনা, আর্টিকেল, ভিডিও, অনুভূতি ও আপনার করণীয়- সব মিলিয়ে ‘করুন জয় করোনা ভয়’ নামে নতুন এই সাইটটি সেই উদ্দেশ্য যথাযথভাবেই পূরণ করেছে।

এছাড়া কোয়ান্টাম ওয়েবসাইটে প্রতিদিনই এসেছে কোনো না কোনো কন্টেন্ট। ২২টি আর্টিকেল, ২৩টি স্পিচ, ১২টি নতুন মেডিটেশন এবং ১১টি ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে এটুকু সময়েই।

১২৭ দিন ক্যাম্পে অবস্থান : যে-কোনো কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি

২৬ মার্চ থেকেই গুরুজীসহ ফাউন্ডেশনের জরুরি সেবা কর্মীরা শান্তিনগর কার্যালয়ে অবস্থান করতে শুরু করেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় এক জোরালো উদ্দীপনা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আমাদের অকুতোভয় মুক্তিসেনারা। তেমনি উদ্দীপনা, সাহস আর সর্বস্ব ত্যাগের আকুতি অনুভব করেছেন আমাদের করোনা যোদ্ধারাও।

গুরুজী ১২৭ দিন ক্যাম্পে অবস্থান করেন। কর্মীরাও কেউ কেউ ১৩৫, ১৪০ বা ১৫০ দিন পর তাদের বাসায় ফিরেছেন। করোনা যুদ্ধের সহায়ক সামাজিক শক্তি হিসেবে যে-কোনো জায়গায় যে-কোনো কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার মানসিক প্রস্তুতি তাদের ছিল।

চিকিৎসাকর্মীদের পিপিই সরবরাহ

চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী- করোনা মোকাবেলায় সম্মুখসারীর এই যোদ্ধাদের জন্যে জরুরী ছিল পারসোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম-পিপিই)। কিন্তু ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণার প্রেক্ষিতে কে কোথায় কীভাবে এগুলো পাবেন বা নেবেন তা নিয়ে তৈরি হয় বেশ অনিশ্চয়তা। এতে ব্যাহত হচ্ছিল দেশের হাসাপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোর করোনা চিকিৎসাসেবা।

পরিস্থিতি অনুধাবন করে এগিয়ে আসে কোয়ান্টাম। দ্রুত উদ্যোগ নিয়ে দুদিনের মধ্যেই সংগ্রহ করে উন্নত মানের কয়েক হাজার পিপিই সেট।


কমপ্লিট পিপিই সেট। দেশে করোনা বিস্তারের শুরুতে যখন এটি বাজারে অপ্রতুল হয়ে পড়েছিল তখন কোয়ান্টাম নিজেরা তৈরি করে দাফনকর্মীদের ব্যবহার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণের উদ্যোগ নেয়

২৮ মার্চ থেকে ২ এপ্রিলের মধ্যে সারাদেশের পাঁচ শতাধিক চিকিৎসক এবং ২২টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে পৌঁছে দেয় চাহিদা মোতাবেক পিপিই।

এক ঘন্টার জন্যেও বন্ধ হয় নি রক্তদান কার্যক্রম

এ-সময় দেশের অন্য সব স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রম বন্ধ ছিল। ফলে কোয়ান্টাম ল্যাবকে নিতে হয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। করোনার এ-সময়টাতে এক ঘণ্টার জন্যেও বন্ধ হয় নি আমাদের ব্লাড ল্যাব।


লকডাউনের মধ্যেও দেশে রক্তের প্রধান যোগানদাতা ছিল কোয়ান্টাম

রক্তের জন্যে যিনি এসেছেন, তাকে বসিয়ে রেখে হলেও কোয়ান্টিয়াররা মোটর সাইকেল নিয়ে পিপিই পড়ে চলে গেছেন ডোনারের বাসায়। ডোনারকে পিপিই পড়িয়ে নিয়ে এসেছেন ল্যাবে। রক্ত নেয়ার পরে বাসায় পৌঁছেও দিয়ে এসেছেন।

গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে দিনের পর দিন কোয়ান্টিয়াররা নিরলসভাবে এই কাজ করেছেন। ফলে রক্তের জন্যে যারা এসেছেন, তাদের ৮০ শতাংশকেই আমরা রক্ত দিতে সক্ষম হয়েছি।

রক্তের কম চাহিদার প্রেক্ষাপটে কাজ করেও সরবরাহ হয় ৮৫ হাজার ৩৫৭ ইউনিট।

করোনা শহিদ দাফন কার্যক্রম– আতঙ্কমুক্তিতে সমাজকে নেতৃত্বদান

করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে মৃত স্বজনের দাফন বা শেষকৃত্য করতে অস্বীকৃতি জানানোর মতো অমানবিক ঘটনা ঘটছিল দেশজুড়ে। অসহায় মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে এগিয়ে আসে কোয়ান্টাম। ৭ এপ্রিল থেকে শুরু করে কোভিড-১৯ দাফন কার্যক্রম। WHO নির্ধারিত সংক্রামক রোগে মৃতদেহ দাফনের নিয়মাবলি অনুসরণ করে এই কার্যক্রমকে বিস্তৃত করে দেশব্যাপী।

দিনে ২৪ ঘন্টা সপ্তাহে ৭ দিনের এই সেবা চলেছে এমনকি দুই ঈদের দিনগুলোতেও। দিনে-রাতে যখনই লাশের তথ্য সংবলিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এসএমএস পেয়েছে, দাফন টিমের স্বেচ্ছাসেবকেরা ছুটে গেছে রোদ-বৃষ্টি ঝড়-বাদল উপেক্ষা করে।


কাকডাকা ভোর কিংবা গভীর রাত, যখনই কোনো বেওয়ারিশ লাশের খবর পেয়েছে ছুটে গিয়েছে আমাদের করোনা যোদ্ধারা

প্রত্যেকের শেষকৃত্য যাতে নিজ নিজ ধর্মীয় প্রথা বা বিধান মেনে করা হয় সে-জন্যে প্রতিটি মূল ধর্মের স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে করা হয় আলাদা আলাদা টিম। যে-কারণে এই কাজে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব ধর্মের মানুষেরই আস্থা ছিল কোয়ান্টামের ওপর।

পুরুষ ও নারীদের জন্যেও ছিল পৃথক টিম।

দাফনের কাজে ব্যবহৃত বডিব্যাগ কোয়ান্টাম নিজস্ব উদ্যোগেই তৈরি করে, যার মান নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলও করেছেন ভূয়সী প্রশংসা!

৭ এপ্রিল থেকে ৩১ ডিসেম্বর- এই নয় মাসে মোট ২৬৫৬ জন করোনা-মৃতের শেষকৃত্য করে কোয়ান্টাম। যার মধ্যে ছিল- দাফন ২২৬৫ জন, সত্কার ৩৬৬ জন, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ২০ জন এবং সমাধি ২৩ জন।

হাজারো সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রাধা শ্যাম সুন্দর মন্দির ইসকন-এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক অধ্যাপক, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ এবং সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব, রাজশাহীর সায়েন্স ল্যাবরেটরির মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক-প্রফেসর ইমেরিটাসের মতো বিশিষ্ট সমাজ মানস ও গুণীজনের শেষ বিদায়ের সঙ্গী ছিল কোয়ান্টাম।


দিনাজপুরে করোনা শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জলিলকে দাফন করেছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন

এ-কাজে কোয়ান্টাম ছিল পথিকৃৎ

করোনাকালে অনেক দেশেই মাটিতে গর্ত করে ক্রেন দিয়ে লাশ ফেলা হয়েছে। কোথাও কোথাও কবরে লাশ নামানো হয়েছে লাঠি দিয়ে। কোথাও বা কাপড়ে পেঁচিয়ে।


করোনা আতংকে বহু দেশে এভাবেই অশ্রদ্ধাভরে হয়েছে শেষকৃত্য (ছবিসূত্র- দ্য ফেডেরাল নিউজ)

কিন্তু করোনা মৃতদের কোয়ান্টাম শুধু ‘শহিদ’ আখ্যা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে নি, মর্যাদা কীভাবে দিতে হয় তারও পথিকৃৎ হয়েছে।

ফলে যত্নে গোসল, কবরে নেমে মৃতকে শোয়ানো- করোনা-মৃতকে ঘিরে মমতার পরশে এই শেষ বিদায় জানানোর দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে যে অল্প কয়েকটি জাতি স্থাপন করতে পেরেছে বাংলাদেশ তাদের অন্যতম।

‘করোনা শহিদ’ তালিকা সংগ্রহ

"মহামারিতে মৃত ব্যক্তি শহিদ" (বোখারী, মুসলিম, নাসাঈ, আবু দাউদ) হাদিসের প্রেক্ষিতে করোনা মৃতকে ‘শহিদ’ আখ্যা দিয়ে কোয়ান্টাম নেয় এক মহতী উদ্যোগ- ‘করোনা শহিদ’ তালিকা ও বিবরণ সংগ্রহ করে ওয়েবসাইটে প্রকাশ।

একইসাথে ঘোষণা করা হয় তাদের জন্মদিন ও মৃত্যুদিবসে ধ্যানতীর্থ কোয়ান্টামমের জাবলে রাজিউনে তাদের জন্যে দোয়া ও প্রার্থনা করা হবে।

পুরো জাতিকেই ফরজ তরকের জন্যে গোনাহগার হতে হতো

দাফন একটি 'ফরজে কিফারা'। মানে সমাজের কিছু মানুষ যদি এই দায়িত্ব পালন করে, তো পুরো সমাজ দায়ভার থেকে মুক্ত হয়। কিন্তু যদি কেউই তা না করে তাহলে সমাজের সবাই-ই হবে গোনাহগার।

তাই করোনা শহিদদের সম্মানজনক শেষ বিদায়ের মাধ্যমে কেবল তাদের স্বজনদেরই নয়, প্রকারান্তরে পুরো জাতিকেই ফরজ তরকের দায় থেকে মুক্ত করেছে কোয়ান্টাম।

দাফন ফান্ডে সর্বস্তরের অংশগ্রহণ

বাঙালি যে দাতার জাতি করোনাকালে ফাউন্ডেশনের দাফন ফান্ডে সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তা আরেকবার প্রমাণ হলো। সমর্থ-সচ্ছল মানুষরা যেমন উদারহস্তে দান করেছেন, তেমনি যতটুকু সাধ্য আছে ততটুকু নিয়ে এগিয়ে এসেছেন সাধারণ মানুষও।

এক গৃহকর্মী শুনছিলেন, তার গৃহকর্ত্রী ফোনে কারো সাথে দাফন ফান্ডে দান নিয়ে কথা বলছেন। ফোন শেষে গৃহকর্ত্রীর কাছে আবেদন জানালেন, এই ফান্ডে তিনিও কিছু দান করতে চান। বেগম সাহেব কি তা নেবেন?

আসলে করোনা প্যান্ডেমিকে একটি চরম সত্য আমাদের সামনে উঠে এসেছে- একজন মৃত আসলে নিঃস্ব! জীবিত অবস্থায় তার কোটি কোটি মূল্যমানের সম্পদও তখন আর তার নয়। নিজের কোনো সেবার বিনিময়ে মূল্য প্রদানের কোনো ক্ষমতা তার নেই।

কোভিড-১৯ দাফন কার্যক্রমটি তাই ছিল সম্পূর্ণ ফ্রি। বহু কোটি কোটিপতির দাফন-কাফনের সংস্থান হয়েছে অচেনা অজানা সাধারণ মানুষের দানের অর্থে।

স্বেচ্ছাসেবীরাই ছিল আমাদের শক্তি

দাফন কাজে আমাদের শক্তির জায়গা ছিল স্বেচ্ছাসেবী কোয়ান্টিয়াররা, মানবতার ক্রান্তিলগ্নে সৃষ্টির সেবার কাজটিকে যারা গ্রহণ করেছিল অসাধারণ পুণ্যের কাজ মনে করেই। কারণ আতঙ্কের ডামাডোলে নিজেকে ঝুঁকির মুখে ফেলে যে কাজ তা স্রেফ পেশাদার লোক বা চাকরিজীবীদের দিয়ে করা সম্ভব নয়।


ওয়াইএমসিএ ভবনে দাফনকর্মীদের জন্যে পিপিই বানাতে ব্যস্ত দাফন টিমের স্বেচ্ছাসেবীরা

আর কোয়ান্টাম যখন লাশ দাফনের কাজ শুরু করে তখনো দেশের অন্য সংগঠনগুলো কাজ শুরুই করে নি। কারণ করোনায় মৃতের লাশ দাফনে যে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় সে-ব্যাপারে প্রশিক্ষণ তাদের ছিল না। ছিল না পর্যাপ্ত লোকবলও।

কোয়ান্টামের দেখানো পথ অনুসরণ করে আস্তে আস্তে আরো কিছু সংগঠন লাশ দাফনে এগিয়ে আসে। তবে সেটাও ছিল কেবল দিনের বেলায়। অঞ্চল ভেদে। মানে কেউ ঢাকায় কেউ নারায়ণগঞ্জে কেউ কুমিল্লায় আর কেউ চট্টগ্রামে।

কিন্তু কোয়ান্টাম দাফন সেবা বিস্তৃত ছিল সারাদেশে। বিশেষত উত্তরবঙ্গে এ-কাজে কোয়ান্টামই ছিল একমাত্র সংগঠন। সেখানে অন্য কোনো সংগঠন সেভাবে কাজ করার সুযোগ পায় নি।

পরিশেষে...

প্রতিবাদ নয়, কোয়ান্টাম বিশ্বাসী প্রতিকারে। আর প্রতিকূলতার মুখে হাল ছেড়ে না দিয়ে পরিস্থিতিকে কল্যাণের পথে চালিত করার নীতিতে সবসময়ই অটল।

করোনাকালে কোয়ান্টাম যা করেছে তা ছিল এই বিশ্বাসেরই বাস্তবায়ন।

কোভিড-১৯ দাফন কাজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে শুরু হয়েছে সার্বজনীন দাফন সেবা কার্যক্রম- যে-কোনো মৃতকেই মমতার পরশে শেষ বিদায় জানানোর কাজ। এ-কাজে বনশ্রী ও কাকরাইলে স্থাপিত হয়েছে দুটি হাম্মাম।

করোনার শুরুতে আমরা যেমনটা ওয়াদা করেছিলাম- যে-কোনো পরিস্থিতিতে মানুষের পাশে থাকার, সেটা করার তওফিক দেয়ার জন্যে আমরা স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ।

কৃতজ্ঞ আপনাদের প্রতিও, যারা আতঙ্কবাদীদের জোর প্রচারের মুখেও আস্থা রেখেছিলেন কোয়ান্টামের প্রতি।