যে থাকে ঘরে করোনা ধরে তারে!

রাজনীতিবিদ্যায় 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' নামে একটি তত্ত্ব আছে, যেখানে বলা হয়েছে বিজিত বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে শাসনের জন্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করতে হবে।

কারণ বৃহৎ শক্তিকে সহজে বশে আনা যায় না। কিন্তু যখনই তাদের মধ্যে বিভক্তি আনা হয় তখনই তারা দুর্বল হয়ে অধীন হয়ে পড়ে।

আর একটি জাতির মধ্যে বিভক্তির জন্যে বিচ্ছিন্নকরণের চেয়ে ভালো হতে পারে না আর কিছুই।

আসলে মানবজাতি যখন চিন্তাচেতনায় একত্র থাকে, তাদের মধ্যে সঙ্ঘবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। আর এই সঙ্ঘবদ্ধতার শক্তি অজেয় সব ধরণের বাঁধা বিপত্তির কাছে- সেটা হোক সামাজিক কিংবা প্রাকৃতিক।

কিন্তু এই করোনালগ্নে গৃহবন্দি হয়ে আমরা আমাদের সঙ্ঘবদ্ধতার শক্তিই হারিয়ে ফেলছি। আর পরিণামে বশ্যতা স্বীকার করছি মাইক্রোস্কোপিক অণুজীব করোনাভাইরাসের কাছে।

"ঘরে থাকুন, নিরাপদ থাকুন!"

কোভিড-১৯ প্যান্ডেমিকের শুরু থেকেই অনেকটা যেন আপ্তবাক্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এই কথাটি।


ঘরে থেকেও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন বরিস জনসন! (ছবিসূত্র- দ্য টেলিগ্রাফ)

কিন্তু ঘরে থাকলেই কি করোনাভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকা যায়?

যায় না!

বরং এই ঘরে থাকা-ই বুমেরাং হয়ে আঘাত হেনেছে আমাদের সুস্থতায়। বাড়িয়ে তুলেছে করোনাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি।

কয়েকটি বাস্তব ঘটনা :

১. ঢাকার এক বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধার।

স্ত্রী-সন্তান মালয়েশিয়া প্রবাসী। কাজেই বাসায় থাকেন একা। আর লকডাউনের শুরু থেকেই ছিলেন স্বেচ্ছা-গৃহবন্দী।

ঘর ভরেছিলেন নিত্য প্রয়োজনীয় সব পণ্যে, যাতে কোনো কাজেই আর বেরুতে না হয়!

কিন্তু করোনা নিজের ঘরের ভেতরেই তাকে আক্রমণ করেছে। সেখানেই তিনি মারা গেছেন।

কোয়ান্টাম দাফনকর্মীরা তার লাশ নিয়ে এসেছিলেন বিলাসবহুল এপার্টমেন্টে তার নিজের ফ্ল্যাট থেকেই।

২. জনাব সারোয়ার আলম (ছদ্মনাম) থাকেন ঢাকায় আড়াইশ'র বেশি ফ্ল্যাট নিয়ে গড়া এক এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে। লকডাউনের একদম শুরুতেই সর্বোচ্চরকম বিচ্ছিন্নতা বজায় রেখেছিলেন তিনি।

সিকিউরিটি গার্ডের জন্যে পিপিই পরা ছিল বাধ্যতামূলক। মেহমান, ডেলিভারি ম্যান, এমনকি ছুটো গৃহকর্মীরও ভেতরে ঢোকার অনুমতি পর্যন্ত ছিল না।

কিন্তু এত কঠোর নিয়মের মধ্যে থেকেও করোনায় আক্রান্ত হলেন তিনি নিজেই!

এটা শুনে সিকিউরিটি গার্ড পিপিই খুলে ফেলল! তার উপলব্ধি- নয়তলায় বসে এত আলাদা থাকার পরও যদি এই স্যারের করোনা হয়, তাহলে পিপিই পরা না পরা তো সমান!"

৩. দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক গ্রুপের মালিক পাঁচ ভাইসহ পরিবারের ছয় সদস্য করোনা-পজিটিভ হন ১৭ মে। পরবর্তীতে মারা যায় এক ভাই।

অথচ ২৫ মার্চ করোনাজনিত সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকে নিজের বাড়িতেই ছিলেন সবাই!

৪. তারকা-মহাতারকা, রাজনৈতিক বা ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব, যাদের গৃহে ছিল নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা, লকডাউন-কোয়ারেন্টিন-আইসোলেশন যারা মেনেছিলেন সর্বোচ্চ আন্তরিকতার (!) সাথে- তারা কি পেরেছেন করোনামুক্ত থাকতে?

যুক্তরাজ্যের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন থেকে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, অস্কারজয়ী অভিনেতা টম হ্যাংকস থেকে বলিউড সুপারস্টার অমিতাভ বচ্চন, টেনিস খেলোয়াড় নোভাক জকোভিচ থেকে স্প্রিন্টার উসাইন বোল্ট- করোনা সংক্রমণ থেকে বাদ যান নি কেউই!

অথচ অন্য অনেকের চেয়ে জনবিচ্ছিন্ন তারা-ই ছিলেন বেশি।

লকডাউনের পুরোটা সময় ঘরে থেকেও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার এমন নজির আছে হাজার হাজার।

একসাথে থাকলেই করোনা হয় না!

অন্যদিকে, সব সময়ই যেমনটা বলা হয়েছে, যে করোনা থেকে বাঁচতে পৃথক থাকতে হবে, জনে জনে ৩-৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, না হলেই বিপদ- বাস্তবে কিন্তু ঘটতে দেখা গেছে উলটোটা!

করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, কোভিড-১৯ এ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বস্তিবাসী ও নিম্ন আয়ের মানুষদের ক্ষতি হবে বেশি। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এদের মধ্যে করোনায় আক্রান্তের হার অনেক কম।


ঘনবসতিপূর্ণ বস্তিগুলোয় করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর খুব একটা শোনা যায় না (ছবিসূত্র- দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড)

দ্য ডেইলি স্টার-বাংলা গত ২৬ জুলাই "ঢাকার ঘিঞ্জি বস্তিতে করোনা রোগী নেই!" শীর্ষক একটি প্রতিবেদন ছাপে, যেখানে প্রতিবেদক রাজধানী শহর ঢাকার ২০ টি বস্তি সরেজমিন পর্যবেক্ষণসূত্রে লিখেছেন, অতি ঘনবসতি, ঠাসাঠাসি করে এক ঘরে পরিবারের সবাই থাকা, মাস্ক বা হ্যান্ড গ্লাভস না পরা- অর্থাৎ করোনা সংক্রমণের কথিত ঝুঁকি তৈরির সবগুলো উপাদান থাকা সত্ত্বেও সেখানে করোনারোগী তেমন একটা নেই।

উপরন্তু করোনা নিয়ে তাদের নেই কোনো মাথাব্যথাও!

অন্যদিকে, কলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের এক জরিপে দেখা গেছে- কলকাতা শহরের করোনা পজিটিভদের ৮৫ শতাংশ-ই পাকা বাড়ি, ফ্ল্যাটবাড়ি বা বহুতল ভবনের বাসিন্দা।

স্বাস্থ্য বিভাগের প্রশাসক বোর্ডের সদস্য অতীন ঘোষ বলেন,

''মাত্র ১৫% বস্তি এলাকার মানুষ। বস্তি এলাকায় একজন করোনা রোগী পাওয়া গেলে তার দুই তিন মাসের মধ্যে নতুন রোগী পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে পাকাবাড়ি বা বহুতলে একজন রোগী পাওয়ার পরে তা দ্রুত অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে।"


বহুতল ভবনে একবার সংক্রমণ হলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে (ছবিসূত্র- টাইমস অব ইন্ডিয়া)

করোনা অতিমারির উচ্চমাত্রার সময়টিতেও বস্তিতে করোনার প্রাদুর্ভাব এত কম থাকার কারণ হিসেবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা যে-সব বিষয়ের কথা বলছেন সেগুলোর মধ্যে আছে- জীবিকার তাগিদে তাদের উদয়াস্ত কর্মচাঞ্চল্য, তুলনামূলক বেশি কায়িক পরিশ্রম, করোনা নিয়ে নিরুদ্বেগ, লো-ফ্যাট ও হাই-ক্যালোরি খাবার কম খাওয়া (অবশ্য ফাস্টফুড, প্রসেসড ফুড খাবার খাওয়ার সামর্থ্যই বা তাদের কোথায়!)


শ্রমজীবী মানুষদের জন্যে একেকটি কর্মহীন দিন মানে অন্নহীন দিনও (ছবিসূত্র- ডেইলি স্টার)

আর, অন্নসংস্থানে তাদের ঘর থেকে বেরোতেই হয়। কারণ একেকটি কর্মহীন দিন তাদের জন্যে অন্নহীন দিনও।

কী হয় দিনের পর দিন ঘরবন্দি থাকলে?

আপনি যখন ঘরবন্দী থাকছেন তখন হয়ত সরাসরি করোনা সংক্রমিতদের সংস্পর্শ থেকে নিরাপদ থাকছেন। কিন্তু এই জনবিচ্ছিন্ন থাকাটাই আপনাকে অনেক বেশি অরক্ষিত করছে অন্যান্য সংক্রমণের ব্যাপারে।

এর একটি কারণ হতে পারে ভিটামিন ডি-এর ঘাটতির ফলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার দুর্বল হয়ে পড়া।

ত্বকে রোদের আলোয় উৎপন্ন হয় এই ভিটামিন। প্রকৃতির সবচেয়ে বড় এই উৎস থেকে প্রাপ্ত ভিটামিন ডি হাড় ও দাঁতকে মজবুত করে, ইমিউন সেলকে করে জোরদার। ফলে বাড়ে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা।

কিন্তু আপনি যখন ঘরের মধ্যে শুয়েবসে থাকছেন তখন আপনি বঞ্চিত হচ্ছেন প্রাকৃতিক ভিটামিন ডি থেকে, হাতছাড়া করছেন বিনামূল্যে ইমিউন সিস্টেমকে জোরদার করার সুযোগ।

করোনাভাইরাস মোকাবেলায়ও ভিটামিন ডি অত্যন্ত কার্যকর!

শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরক্ষা গড়ে তোলে আমাদের ফুসফুসের ম্যাক্রোফেজ। এগুলো ক্যাথেলিসিডিন (cathelicidin) নামে এক প্রকার এন্টিমাইক্রোবিয়াল পেপটাইড নিঃসরণ করে সরাসরি ব্যাকটিরিয়া ও ভাইরাসকে মেরে ফেলে।

সেই সাথে বি ও টি সেলের মত ইম্যিউন সেলগুলোর কার্যকারিতাও বাড়ায়।

ফুসফুসের ম্যাক্রোফেজগুলোকে সক্ষম করার মাধ্যমে কোভিড-১৯ এর মত সংক্রমণকেই প্রতিহত করে ভিটামিন ডি।

তার মানে হলো, যারা এখন করোনার ভয়ে গৃহবন্দী জীবন যাপন করছেন তারা আসলে ভিটামিন ডি থেকে নিজেদের বঞ্চিত করার মাধ্যমে করোনাসংক্রমণের ঝুঁকি-ই বাড়াচ্ছেন!

আর এটা কেবল বৈজ্ঞানিক তত্ত্বই নয়, বরং বাস্তবেও এর প্রভাব দৃশ্যমান

স্পেন ও ইতালিসহ ইউরোপের যেসব দেশে করোনায় মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি, গবেষণায় দেখা গেছে সেসব দেশের লোকেদের শরীরে ভিটামিন-ডি এর মাত্রা সবচেয়ে কম।

এই ঘাটতির কারণ হলো, দেশগুলোর জলবায়ু রোদপ্রধান হলেও অত্যধিক সানস্ক্রিন ব্যবহারের কারণে এমনিতেই তারা ভিটামিন-ডি থেকে বঞ্চিত।

উপরন্তু করোনা অতিমারির সময়টাতে তারা কঠোর লকডাউন মেনে দীর্ঘদিন ঘরের মধ্যে থেকেছে বলে পায়নি পর্যাপ্ত সূর্যকিরণ।


করোনায় পশ্চিমাদের অত্যধিক মৃত্যুর অন্যতম কারণ শরীরে ভিটামিন ডি-এর স্বল্পতা (ছবিসূত্র- ভিটামাইন্ড.নিউজ)

এসব দেশে করোনায় মৃত্যুর আরো কারণ থাকলেও ভিটামিন ডি'র ঘাটতিকেই বড় করে দেখছেন ট্রিনিটি কলেজ ডাবলিনের গবেষক রোজ কেনি। কোভিড-১৯ মোকাবেলায় ভিটামিন ডি-র সাথে দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার যোগসূত্রের শক্তিশালী প্রমাণ পাওয়া গেছে- এমনটাই বলছেন তিনি।

কারণ, একদিকে কোভিড-১৯-এ Interleukin-6 নামে যে প্রদাহের ফলে রোগীর তীব্র শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় (যা করোনায় মৃত্যুর প্রধানতম কারণগুলোর একটি), তার জন্যে দায়ী বায়োকেমিকেলের মাত্রা কমায় ভিটামিন ডি।

অন্যদিকে, করোনাভাইরাস লাংস সেলের যে ACE2 Receptor কে ব্যবহার করে ফুসফুসে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটায় সেটাকে পরিবর্তন করে এই ভিটামিন।

এতে করোনাভাইরাসের পক্ষে শরীরে প্রবেশ করাটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।

কাজেই ঘরের বাইরে না আসা মানে ভিটামিন ডি'র সর্বোৎকৃষ্ট ও সবচেয়ে নিরাপদ উৎস 'রোদ' থেকে নিজেকে বঞ্চিত করছেন আপনি। ফলশ্রুতিতে পরোক্ষভাবে বাড়াচ্ছেন করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি।

ফিরতে হবে প্রকৃতির কাছে!

বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, বৃক্ষরাজিমণ্ডিত প্রাকৃতিক পরিবেশে কয়েকদিন কাটালে আমাদের দেহের ন্যাচারাল কিলার সেলের সংখ্যা এবং কার্যকারিতা- দুটোই বাড়ে।

এর একটি কারণ হলো, প্রকৃতির সান্নিধ্যে গেলে আমাদের দেহ-মনের স্ট্রেস কমে।

করোনালগ্নে দীর্ঘদিন লকডাউনে থাকায় এবং মুহূর্মুহূ করোনা ঘটন-অঘটন সংবাদের কারণে অনেকের উপর যে উচ্চমাত্রার স্টেস পড়েছে তা ইমিউন সিস্টমের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর। স্বাভাবিক কর্মচঞ্চল জীবনে ফেরার মাধ্যমে আপনি এই স্ট্রেস কাটাতে পারেন- বলছেন যুক্তরাজ্যের লিভারপুল জন মুরস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক নিল ওয়ালশ।


উন্মুক্ত স্থানে প্রাতঃভ্রমণে স্ট্রেস কমে (ছবিসূত্র- ডেইলি সান)

ঘরে বসে ব্যায়াম করার মাধ্যমেও আপনি স্টেসমুক্ত হতে পারেন। তবে পার্ক, বনভূমি বা সবুজ প্রান্তর, অর্থাৎ উন্মুক্ত স্থানে চলাফেরা বা ব্যায়াম করলে স্ট্রেসমুক্তির জন্যে তা আরো ভালো।

কারণ বহু গবেষণায় এটা দেখা গেছে যে, বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশে চলাফেরা মানুষের হার্টরেট ও রক্তচাপ কমায়। সেই সাথে স্ট্রেস হরমোন 'কর্টিসল' নিঃসরণকেও স্বাভাবিক করে।

তাই যত বেশি প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকবেন তত কমবে আপনার হৃদরোগ, টাইপ-টু ডায়বেটিস ও অকালমৃত্যুর ঝুঁকি।

আর, খোলামেলা পরিবেশে আসলে, মানুষের সাথে মেলামেশা করলে কমবে আপনার স্ট্রেস ও একাকিত্ব-নিঃসঙ্গতার অনুভূতি।

কারণ, Attention Restoration Theory অনুসারে, উন্মুক্ত পরিবেশ আমাদের মনোযোগকে স্ট্রেস থেকে সরিয়ে আনে, ভারাক্রান্ত মস্তিষ্ককে সুযোগ করে দেয় বিশ্রাম গ্রহণ ও নির্ভার হওয়ার।

ঘরের বাইরে আসুন, ঠিক করুন আপনার দেহঘড়ির ছন্দায়ন

ইম্যিউন সিস্টেমকে কর্মক্ষম রাখার জন্যে প্রয়োজন পর্যাপ্ত ঘুম। আর ভালো ঘুমের জন্যেই জরুরী দিনের বেলায় ঘরের বাইরে চলাফেরা।

আসলে দীর্ঘদিন লকডাউনে থেকে থেকে সার্কাডিয়ান রিদম বা দেহছন্দ ব্যহত হয়েছে অনেকেরই। ঘুমসহ আমাদের বহু ধরণের জৈবিক প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রক এই দেহঘড়ির ছন্দায়নের জন্যেই আপনার গৃহবন্দিত্বমুক্তি প্রয়োজন।

আর, আমাদের দেহঘড়ির ছন্দায়ন সবচেয়ে ভালো হয় দিনের বেলায়, যখন আমরা বাইরে থাকি তখন।

আমাদের চোখের পিছনের অংশে একগুচ্ছ আলোকসংবেদী কোষ আছে। যখন দিনের উজ্জ্বল আলো এই কোষগুচ্ছে পড়ে তখন তা যোগাযোগ করে Suprachiasmatic Nucleus নামক ব্রেইন টিস্যুর সাথে। এই টিস্যুই হলো দেহের মাস্টার ক্লক।

এই সংযোগায়নের ফলে দেহঘড়ি ছন্দে ফেরে। হয় সুখকর নিদ্রা।

অন্যদিকে ঘরের আবছা আলো বা কৃত্রিম আলোয় এই সংযোগায়ন যথাযথভাবে হয় না। ফলে ব্যহত হয় দেহছন্দ, সেই সাথে ব্যহত হয় ঘুমও- বলছেন 'আলো ও স্বাস্থ্য' বিষয়ক গবেষক প্রফেসর মারিয়ানা ফিগুয়েইরো।

তার গবেষণায় উঠে এসেছে, চাকুরিজীবীদের মধ্যে যারা কর্মস্থলে হেঁটে যাতায়াত করেন তারা সকালের উজ্জ্বল আলোর মধ্যে থাকেন বেশি। রাতে তাদের সহজে গভীর ঘুম হয় এবং অল্প আলোয় বেশিক্ষণ থাকা লোকেদের চেয়ে ঘুমে ব্যাঘাতও তাদের হয় কম।

এ-ছাড়াও, সকালের উজ্জ্বল আলো আমাদের মুডের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে ও বিষন্নতা রোধ করে।


লকডাউনে দিনের পর দিন ঘরে থাকায় স্লিপ প্যাটার্ন নষ্ট হয়েছে অনেকের (ছবিসূত্র- হেল্পগাইড)

অন্যদিকে, দীর্ঘদিন ঘরে অবরুদ্ধ থাকার ফলে দেহছন্দে ব্যাঘাত ও ঘুম কমে যাওয়ার দরুন ইম্যিউন সিস্টেমের তৎপরতা কমে যায়। যারা ঘরে থেকে অফিস (work from home) করেন তাদের মধ্যে এটা এখন বেশি দেখা যাচ্ছে।

তবে এটা বলা মুশকিল যে এই উপকারগুলো পেতে আপনাকে কতক্ষণ বাইরে থাকতে হবে

দেহঘড়ির ছন্দায়নে প্রয়োজন সকালের আলো। আর ভিটামিন ডি সংশ্লেষণ সবচেয়ে ভালো হয় দুপুরের আলোয়, যখন সূর্যালোকে অতিবেগুনি রশ্মি সবচেয়ে বেশি থাকে।

তাই অন্য কোনো ব্যস্ততা না থাকলে দিনে যখনই সময় পান ঘর থেকে বাইরে আসুন, উপভোগ করুন বাইরের পরিবেশ।

আর ভোরে ঘুম থেকে উঠে ঘুরে আসুন অন্য কোথাও না হলেও অন্তত বাড়ির ছাদ কিংবা উঠান থেকে। প্রাণবন্ততা নিয়ে শুরু করা দিনটিতে আপনি সারাক্ষণই থাকতে পারবেন তরতাজা।

করোনাকে সঙ্গী করেই চলবে জীবন-

এখন এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারীবিদ প্রফেসর সুনেত্রা গুপ্ত বলেন, "ইনফ্লুয়েঞ্জার মত করোনাভাইরাসও একটা পর্যায়ে আমাদের জীবনের অংশে পরিণত হবে; এবং আশা করা যায় ইনফ্লুয়েঞ্জার চেয়েও কম মারাত্মক হবে তা।"

আমরা যেমন সাধারণ ফ্লু নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাই না, ওষুধ বা বিশ্রাম নিতেও ব্যস্ত হন না অনেকে, এবং এক সপ্তাহ বা দশ দিনে স্বাভাবিকভাবেই সেরে উঠি, তেমনটাই হবে করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে।

আমাদের দেশে যে ইতোমধ্যেই সেটা হয়েছে তা দেশের বস্তিগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায়।

সেখানকার মানুষ হয়ত করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু পেটের তাগিদে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রাকৃতিকভাবেই তারা ঠিকই সেরে উঠছেন কোনো রকম জটিলতা ছাড়া।

কিন্তু আপনি যখন করোনা নিয়ে অহেতুক আতঙ্কের মধ্যে থাকবেন, গৃহবন্দি দিন কাটাবেন তখন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হতে থাকবে- এটা এখন বিশেষজ্ঞরাই বলছেন।

তা-ছাড়া, বাইরে না এসে করবেনই বা কী! এমন তো নয়, যে এক বা দুই সপ্তাহ কিংবা এক মাস ঘরে থাকলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

অনির্দিষ্টকাল ঘরে থেকে বরং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকেই আপনি ভঙ্গুর করছেন।

তাই করোনাকে সহজভাবে গ্রহণ করুন; মনোযোগ দিন নিজের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে জোরদার করার দিকে। কারণ ভেতরের প্রতিরোধ না থাকলে বাইরের প্রতিরক্ষা বেশিক্ষণ কাজ করতে পারে না।

সেই সাথে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাইরে আসুন, শুরু করুন স্বাভাবিক কর্মব্যস্ত জীবন।