published : ১১ আগস্ট ২০২০
কোভিড-১৯ এ নাজেহাল সারা বিশ্বের মানুষ। বাঁচার প্রবল আকুতি থেকে যে যেভাবে পারছে, ভাইরাস সংক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকতে চাইছে। অথচ যেখানে স্রেফ সচেতনতা আর যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ হতে পারত এই রোগের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার, সেখানে অতি সচেতনতা শংকায় পরিণত হয়ে পরিস্থিতিকে করে তুলেছে আরো জটিল। আর এর নেপথ্যে রয়েছে কিছু ভুল ধারণা।
এ-রকমই কিছু ভুল ধারণা তুলে ধরা যাক। মিলিয়ে নিন, আপনার মধ্যেও রয়েছে কিনা এই ভুল ধারণাগুলো!
করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে বলা হচ্ছিল, সংক্রমণের লক্ষণ যাদের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, তাদের চেয়ে যাদের মধ্যে প্রকাশিত হয়নি তাদের মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা এখন বলছেন ভিন্ন কথা।
এ বিষয়ে পরিচালিত কিছু গবেষণার সূত্র ধরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, উপসর্গহীন সংক্রমিতের দ্বারা অন্য কারো সংক্রমিত হওয়ার ঘটনা অতি বিরল! আর এ-কারণেই কেবল উপসর্গযুক্ত ব্যক্তিদের পৃথকীকরণ (Isolation) ও তাদের সংস্পর্শে আসাদের কোয়ারেন্টিনে রাখার মাধ্যমেই কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব ব্যাপকভাবে কমানো সম্ভব।
করোনাভাইরাস শ্বসনতন্ত্রের জীবাণু (Respiratory pathogen) হওয়াতে এটি ছড়ায় হাঁচিকাশির মাধ্যমে। আর অ্যাসিম্পটোমেটিক রোগীদের তো এই উপসর্গই নেই!
তাছাড়া, যে-ভাইরাস একজনের দেহে প্রবেশ করে কোন লক্ষণই প্রকাশ করতে পারল না, সেটা অন্যের মধ্যে কতটা লক্ষণ প্রকাশ করতে পারবে সেটা তো সাধারণ বুদ্ধিতেই বোঝা যায়।
ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে অনেকেই ঘরের মধ্যে নিজেদের শুধু অবরুদ্ধ করেই রাখছেন না, ঘরের দরজা-জানালা পর্যন্ত বন্ধ রাখছেন কেউ কেউ। তাদের ধারণা, প্রবাহিত বাতাসের সাথে বাইরে ভেসে বেড়ানো ভাইরাস ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে।
অথচ আপনি কি জানেন, এতে করে ভালোর চেয়ে মন্দই আপনার বেশি হচ্ছে?
করোনাভাইরাস ছড়ায় সংক্রমিত ব্যাক্তির হাঁচিকাশির সাথে বেরিয়ে আসা ড্রপলেট বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণার মাধ্যমে, যা বাতাসে খুব অল্প সময় ভেসে থাকতে পারে। আর এই ভাইরাস কিছুটা ভারী বলে যেতে পারে না বেশি দূরেও।
তাই বাতাসের সাথে ভাইরাসের ঘরে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে দরজা-জানালা বন্ধ রাখার প্রয়োজন তো নেই-ই, উল্টো বদ্ধ ঘরের দূষিত বায়ু বাইরে বেরিয়ে যাবে যদি আপনি দরজা-জানালা খোলা রাখেন।
ড. বিজন শীল বলছেন, করোনার ভয়ে দরজা-জানালা বন্ধ রাখবেন না। কারণ বদ্ধ জায়গায় একবার করোনাভাইরাস ঢুকলে তা দ্রুত ছড়ায়।
গত বছর BMC Infectious Diseases জার্নালে প্রকাশিত একটি আর্টিকেলে উল্লেখ করা হয়, শুধুমাত্র বায়ু চলাচল বাড়ানোর মাধ্যমে যক্ষ্মার মত জীবাণুজনিত রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি ৭২ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনা গেছে।
এসি চলছে, বাইরের বাতাসের প্রয়োজন নেই- এটা মনে করে জানালা বন্ধ রাখাটাও ভুল! কারণ এতে করে বদ্ধ ঘরের ভেতরে ড্রপলেটস, যদি থেকে থাকে, তাহলে সেগুলো একই জায়গার মধ্যে ঘোরাঘুরি করবে।
তাই ঘরের দরজা-জানালা খোলা রাখুন। এতে বাইরের বিশুদ্ধ বাতাস ভেতরে প্রবেশ করবে; বেরিয়ে যাবে ভেতরের দূষিত বাতাস। বাতাসে ভাইরাস বহনকারী ড্রপলেটস থাকলে বেরিয়ে যাবে তা-ও!
বর্তমানে মাস্ক ব্যবহার করেন না এমন মানুষ বিরল। করোনাভাইরাস ঠেকাতে বিশেষজ্ঞরা শুরু থেকেই যে বিষয়গুলোর উপর গুরুত্ব দিয়ে আসছেন তার একটি- মাস্ক ব্যবহার।
কিন্তু অনেকের মনে প্রশ্ন, কোন ধরণের মাস্ক করোনারোধে সক্ষম? এন-৯৫, কেএন-৯৫, নাকি সার্জিকেল মাস্ক?
কাপড়ের মাস্ক আরামদায়ক বটে, কিন্তু এতে করোনাভাইরাস রোধ হয় তো?
অনেকের ধারণা, করোনা প্রতিরোধে উন্নতমানের এন-৯৫, কেএন-৯৫ এর মত 'বিশেষ' ধরণের মাস্ক-ই পরতে হবে। অথচ এ-ধরণের মাস্ক দীর্ঘক্ষণ ব্যবহারে শ্বাস-প্রশ্বাসে অস্বস্তিই তৈরি করে না, খরচও বাড়ায়।
কারণ এই 'বিশেষ' মাস্ক ধুয়ে ২/৩ বারের বেশি পরা যায় না। সার্জিকেল মাস্ক ব্যবহার করা যায় একবারই।
আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিকভাবে নিয়ম মেনে পরিষ্কার করা না হলে এই 'বিশেষ' মাস্কই হতে পারে সর্ষের মধ্যে ভুত, মানে করোনাভাইরাসের বাহক!
এ-ব্যাপারে দেশবরেণ্য অনুজীববিজ্ঞানী ড. বিজন শীল বলেছেন,
সাধারণ চলাচলের জন্যে এত দামি মাস্কের প্রয়োজন নেই, সূতি কাপড়ের তিন লেয়ারের (স্তরের) মাস্ক হলেই চলবে। কেউ চাইলে বাসাতেও বানিয়ে নিতে পারেন। এতে সুবিধা, প্রতিদিন অন্যান্য কাপড়ের সাথে তা ধুয়ে নিয়ে ইস্ত্রি করে আবার ব্যবহার করা যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল-সিডিসি-ও জনসাধারণের জন্যে সুতির মাস্ক বেশি কার্যকরী উল্লেখ করে বলছে, সার্জিকেল মাস্ক কিংবা এন-৯৫ মাস্ক শুধু যারা চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত আছেন, যেমন ডাক্তার, নার্স মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, তাদের জন্যে প্রয়োজন হয়, সাধারণ মানুষের জন্যে নয়।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, গেঞ্জি কাপড়ের মাস্ক করোনাভাইরাস ঠেকাতে সার্জিকেল মাস্কের চেয়েও বেশি সক্ষম। আর এই মাস্ক আপনি নিজেই তৈরি করতে পারেন।
আরেকটি বহুল প্রচলিত ভুল কথা! কিংবা বলা চলে বেনিয়াদের বিক্রি বাড়ানোর চাল।
করোনাভাইরাসের বাইরের আবরণটি চর্বির; আর এই আবরণটি সফলভাবে ভাঙতে পারে ক্ষার।
তাই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলো, সাবান-পানি দিয়ে অন্তত বিশ সেকেন্ড ধরে ভালোভাবে কচলে হাত ধুতে হবে। কারণ, সাবানের ক্ষার করোনাভাইরাসের চর্বির আবরণটি ভেঙে দিয়ে ভাইরাসকে নির্মূল করে। তাদের মতে, বার বার সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে অত্যন্ত কার্যকরী একটি উপায়।
আর ভাইরাস নির্মূলে সবচেয়ে বেশি কার্যকর হলো বেশি ক্ষারযুক্ত কাপড় কাচা সাবান, বা আমরা যাকে বলি 'বাংলা সাবান'।
এন্টি-ব্যাকটেরিয়াল বা মেডিকেটেড সোপ যে কার্যকর নয়, তা নয়। কিন্তু তুলনামূলক কম খরচে যদি সাধারণ সাবানে বেশি কার্যকরভাবে করোনাভাইরাস নির্মূল করা যায়, তাহলে এত দাম দিয়ে এন্টি-ব্যাকটেরিয়াল বা মেডিকেটেড সাবান, হ্যান্ড ওয়াশ এগুলো কিনে শুধু শুধু পয়সা অপচয় কেন করবেন?
আর ডার্মাটোলজিস্টরা বলছেন, অ্যালকোহলযুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজারের অতিরিক্ত ব্যবহার হতে পারে হাতের চামড়ার জন্যে ক্ষতির কারণ। তাছাড়া সুরক্ষা সামগ্রীর নামে বাজারে এখন যেসব মানহীন পণ্য বিক্রি হচ্ছে তার মধ্যে হ্যান্ড স্যানিটাইজারও আছে। রাস্তাঘাটে বিক্রি হওয়া এসব স্যানিটাইজার ইথাইল এলকোহলের বদলে মিথানল দিয়ে তৈরি এবং তার মধ্যে উড কালার বা টেক্সটাইল কালার মেশান হচ্ছে। স্বাস্থ্যের জন্যে এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
যে কারণে স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার শব্দের বদলে এখন সাবান বা সাবান গোলা পানি - এই শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে।
এই ধারণা থেকে অনেককেই দেখা যায় পিপিই পরে চলাচল করছেন। যার আসলে কোন প্রয়োজনই নেই!
কেন? কারণ, করোনাভাইরাস চামড়া দিয়ে শরীরে ঢোকে না, ঢোকে নাক ও মুখ দিয়ে; তাই এগুলোকে নিরাপদ রাখাটাই যথেষ্ট- বলছেন ডঃ বিজন শীল।
আসলে, পিপিই জরুরী যারা সরাসরি করোনারোগীদের স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন তাদের, অর্থাৎ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের; সাধারণ মানুষের এগুলো পরে চলাফেরা অহেতুক এবং অপ্রয়োজনীয়।
আর গণহারে সবাই যদি পরেন তাহলে যাদের এটা দরকার, অর্থাৎ ডাক্তার-নার্স, তারা এগুলো পাবে না।
হাঁচি বা কাশি দিলে ড্রপলেটস যতটা দূরে যেতে পারে অন্তত ততটা দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বিশেষজ্ঞরা এটাকেই বলছেন শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা।
কিন্তু কতটা হবে সেই দূরত্ব, এ নিয়ে আছে বিতর্ক।
কেউ কেউ মনে করেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচতে দুই মিটার বা ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। তবে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এ নিয়ে মতভেদ আছে।
একজন ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ব্রিটিশ সরকারকে সুপারিশ করেছেন, লোকজনকে দুই মিটার দূরে থাকার নীতি প্রত্যাহার করে নিতে।
আর লন্ডন স্কুল অব হাইজিন এন্ড ট্রপিকেল মেডিসিনের পরিচালক প্রফেসর পিটার পিওট বলছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে এক মিটার দূরে থাকাই যথেষ্ট।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারও একই অভিমত।
আক্রান্ত রোগীর শরীরে সেরে ওঠা রোগীর প্লাজমা দিলে ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে সাহায্য করে সেরে ওঠা রোগীর অ্যান্টিবডি- সংক্ষেপে এটাই হলো প্লাজমা থেরাপি।
বাংলাদেশে এখন অনেকেই কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলেই প্লাজমা থেরাপির দিকে ঝুঁকছেন। কখনো কখনো ডাক্তাররা প্রয়োজন না থাকলেও শুধুমাত্র রোগীর আত্মীয়-স্বজনের অনুরোধে দিচ্ছেন এই থেরাপি।
কিন্তু প্লাজমা থেরাপি আসলে কতটা প্রয়োজন? আর এই থেরাপি নিলেই কি আপনি সেরে উঠবেন?
আসুন দেখি বিশেষজ্ঞরা এ-ব্যাপারে কী বলছেন।
করোনায় প্রায় ৮০ ভাগ রোগী ভোগেন মৃদু অসুস্থতায়। পর্যাপ্ত বিশ্রাম, পুষ্টিকর খাবার আর পানীয় গ্রহণ এবং সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাসায় থেকেই তারা সুস্থ হতে পারেন। তাদের প্লাজমা নেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।
যাদের অক্সিজেনের মাত্রা ৯৩%-এর নিচে তাদের প্লাজমা দেয়াটা ঠিক আছে। তবে যারা সংকটাপন্ন বা আইসিইউ-তে আছে তাদের বেলায় এটার সফলতা তেমন বেশি না।
রক্তে পর্যাপ্ত অ্যান্টিবডি না থাকলে প্লাজমা দেওয়া যাবে না। কারণ প্লাজমা থেরাপির মূল চালিকাশক্তি হলো অ্যান্টিবডি। যদি রক্তে অ্যান্টিবডি কম আর রোগীর দেহে ভাইরাস বেশি থাকে তাহলে প্লাজমা থেরাপি ব্যর্থ হবে।
আর মনে রাখা দরকার যে, এটি আসলে পরীক্ষামূলক একটি চিকিৎসা পদ্ধতি। পরীক্ষামূলক নতুন ড্রাগের মতো গবেষণায় এনে এর কার্যকারিতার ব্যাপারে দৃঢ়ভাবে কিছু বলা সম্ভব।
বাজার থেকে শাক সবজি ফলমূল কিনে এনে রান্না বা খাওয়ার আগে পানি দিয়ে ভাল করে ধুয়ে নেয়া- এটা তো আমরা করিই! কিন্তু বিষয়টা যখন করোনাভাইরাস শোধনের, তখন শুধু পানি দিয়ে ধুলেই কি চলে?
ভরসা পান না অনেকেই! আর তাই এগুলোকে পরিষ্কার করেন ব্লিচিং পাউডার মেশানো পানি দিয়ে। কারো কারো ধারণা ভিনেগারে ডুবিয়ে রাখতে হবে পুরো এক ঘন্টা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এগুলোর কোনো প্রয়োজনই নেই!
আইইডিসিআর-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর এ বিষয়ে বলেন,
শাক ফলমূল সবজি- এসব থেকে করোনাভাইরাস ছড়ায় এ-রকম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত নেই। তবে, অতিরিক্ত সাবধানতা হিসেবে অনেকেই সাবান-পানি, ব্লিচিং পাউডার কিংবা ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে শাক বা ফলমূল পরিষ্কার করছেন। এটা একদমই উচিত না এবং এটা স্বাস্থ্যসম্মতও নয়।
তার মতে, শাক-সবজি, ফলমূল ইত্যাদি পানিতে ভিজিয়ে রেখে পাঁচ-ছয় মিনিট পরে প্রবাহমান পানিতে (যেমন ট্যাপ) ধুয়ে ফেলা-ই যথেষ্ট!
এটি কতটুকু সঠিক তা বোঝার জন্যে আসুন জেনে নিই কী প্রক্রিয়ায় একজন করোনারোগী সেরে ওঠেন।
যখন কোনো ভাইরাস আমাদের দেহে প্রবেশ করে তখন দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সেটাকে দমন করতে সক্রিয় হয় ওঠে। ন্যাচারাল কিলার (এনকে) সেল ভাইরাস-আক্রান্ত কোষগুলিকে সনাক্ত করে মেরে ফেলে।
সংক্রমণের মাত্রা যখন বেড়ে যায় তখন সাইটোটক্সিক টি-সেলের সংখ্যা ও কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এটি আক্রান্ত কোষকে শনাক্ত করামাত্র কোষ ঝিল্লিতে ছিদ্র তৈরি করে বিষাক্ত পদার্থ প্রেরণ করে। ফলে আক্রান্ত কোষটি অভ্যন্তরীণ ভাইরাসসহ ধ্বংস হয়ে যায়।
অন্যদিকে, বি সেল (B-cell) অ্যান্টিবডি তৈরি করে। দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আক্রমণকারী জীবাণুকে স্মরণে রাখে। ফলে একই জীবাণু যদি পুনরায় আক্রমণ করে, তো শরীর দ্রুত সেটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে সক্ষম হয়।
এ-জন্যে, হাম বা চিকেন পক্স-এ শরীর একবার আক্রান্ত হলে ভাইরাস দ্বিতীয়বার আর সংক্রমণ ঘটাতে পারে না।
কিন্তু একটি গবেষণায় তিন মাস পর থেকে দেহে অ্যান্টিবডি কমতে দেখা গেছে। যে-কারণে, যে-সব ভাইরাস খুব দ্রুত মিউটেশনের মাধ্যমে আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে তাদের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি কম কাজ করে।
তবে করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে এখন ঘটছে উল্টোটা। মানে মিউটেশনের মাধ্যমে এটি ক্রমশ দুর্বল হয়ে যাচ্ছে- বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স থেকে দেশের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এ-ভাইরাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার জন্য দায়ী বিপজ্জনক মিউটেশনগুলো দেশে সক্রিয় হতে পারেনি। (দৈনিক জনকণ্ঠে, জুলাই ২২, ২০২০)
তাই কোনো কোনো দেশে করোনায় দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার খবর শোনা গেলেও আমাদের দেশে এটা হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
অনেক ক্ষেত্রে করোনায় মৃতের দাফন বা শেষকৃত্যের সময় তার আত্মীয়-স্বজনেরা দূরে দূরে থাকেন এই ভুল ধারণার কারণেই।
অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, মৃতদেহ থেকে করোনাভাইরাস ছড়ানোর কোন আশংকা নেই!
এর কারণ ব্যাখ্যা করেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস জীবিত দেহ ছাড়া বাঁচতে পারে না। এটা ইনার্ট (নিষ্ক্রিয়) বডিতে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না, অক্সিজেন বা রক্ত পায় না বলে কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যায়।
মৃতদেহ থেকে করোনাভাইরাস ছড়ায়, এখন পর্যন্ত এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি- ডব্লিউএইচও-এর উদ্ধৃতিটি টেনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, মৃত ব্যক্তির দেহে তিন ঘণ্টা পর ভাইরাসটির কোনো কার্যকারিতা থাকে না। তাই কোভিড নির্ধারিত কবরস্থান ছাড়াও পারিবারিক কররস্থানেও এই মৃতদেহ দাফন করা সম্ভব।
আর যার যার ধর্ম বিশ্বাস বা রীতিনীতি অনুযায়ীই লাশের সৎকার করা যাবে, এমনটিই বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
করোনা নিয়ন্ত্রণে টেস্ট করাটা জরুরি, ঠিক। কিন্তু আপনিই ভাবুন তো, সবাইকেই যদি ধরে ধরে টেস্ট করাতে হয়, মানে বিশ্বের সাড়ে সাতশ' কোটি মানুষের প্রত্যেককেই- সেটি কি বাস্তবে সম্ভব?
এটা কার্যত অসম্ভব! তাছাড়া নির্বিশেষে সবাইকেই যদি টেস্ট করতে হয় তাহলে যাদের এই মুহূর্তে টেস্ট করা বেশি জরুরি তারা বাদ পরে যেতে পারে।
ভারতের পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট ও ন্যাশনাল কোভিড-১৯ টাস্কফোর্সের সদস্য কে শ্রীনাথ রেড্ডি বলছেন, টেস্টিং কোন মহৌষধ নয়। তার মতে, আপনাকে টেস্টিং অবশ্যই করতে হবে।কিন্তু সেটা করতে হবে বিচার বিবেচনা করে, লক্ষণ দেখে এবং এর একটা পরিস্কার ভিত্তি থাকতে হবে।"
তিনি আরও বলেন, এটা কেবল তখনই করা সম্ভব যখন কনট্যাক্ট ট্রেসিং এর ব্যবস্থা থাকবে
কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুমোদন দেয়া হয়েছে ইবোলার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ রেমডেসিভির। ওষুধ কোম্পানীগুলো এখন জোরালো প্রচারণা করে এমন একটা ধারণা দেবার চেষ্টা করছে, যে এটি ব্যবহার করলেই রোগী সুস্থ হয়ে যাবে।
কিন্তু কিছু গবেষণার সূত্র ধরে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষয়টা মোটেই সে রকম নয়!
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ-এর অধিভুক্ত The US National Institute of Allergy and Infectious Diseases (NIAID) ১০৬৩ জন রোগীর উপর একটি গবেষণা চালিয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোগীদের মধ্যে রেমডেসিভির সেবনকারীদের সুস্থ হতে লেগেছে গড়ে ১১ দিন। অথচ ওষুধ ছাড়াই সুস্থ হতে গড়পরতা সময় লেগেছে ১৫ দিনে! অর্থাৎ, পার্থক্য মোটে ৪ দিনের!
আর এই ওষুধ সেবনকারীদের মধ্যেও মৃত্যুর হার ৭.১%!
বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, রোগের জটিল অবস্থায় পৌছে যাওয়া মরণাপন্ন রোগীদের ক্ষেত্রে রেমডেসিভির কোন কাজ করবে না।
প্রায়ই বিশ্বের কোনো না কোনো প্রান্ত থেকে গবেষকরা দাবি করছেন, করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছেন তারা।
আর আপনিও আশায় বুক বেঁধে আছেন, ভ্যাকসিন চলে এলেই হলো, থাকবে না আর কোনো দুর্ভাবনা!
আচ্ছা, সাধারণ ফ্লু, মানে সর্দি-কাশি নিয়েও কি আপনি এভাবেই ভাবেন?
সাধারণ ফ্লু-তে প্রতি বছরই বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়। আমরাও কম-বেশি ভুগি এগুলোতে। কিন্তু এর কোনো ভ্যাকসিন নেই- তা নিয়ে কি কখনো হা-পিত্যেশ করি?
করি না, কারণ এগুলো এখন আমাদের জীবনের অংশে পরিণত হয়েছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারীবিদ প্রফেসর সুনেত্রা গুপ্ত বলেন, "ইনফ্লুয়েঞ্জার মত করোনাভাইরাসও একটা পর্যায়ে আমাদের জীবনের অংশে পরিণত হবে; এবং আশা করা যায় ইনফ্লুয়েঞ্জার চেয়েও কম মারাত্মক হবে তা।"
ভ্যাক্সিন একটা সময় আসবে ঠিকই, কিন্তু বাস্তবতা হলো বিশ্বের প্রায় সাড়ে সাতশ' কোটি মানুষের খুব সামান্য একটা অংশের কাছে এটা পৌঁছানো সম্ভব হবে।
অবশ্য সবার এটা প্রয়োজন হবেও না। জনসংখ্যার মধ্যে শুধুমাত্র যারা অরক্ষিত বা ঝুঁকিপ্রবণ, অর্থাৎ, বয়োবৃদ্ধ মানুষ, কিংবা ভুগছেন ক্রনিক ব্যধিতে তাদের সুরক্ষার জন্যে ভ্যাক্সিন লাগবে, এমনটাই অভিমত প্রফেসর গুপ্ত'র।
অন্যদিকে সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ মাত্তেও বাসেত্তি বলেন, "করোনাভাইরাস ক্রমশ তীব্রতা হারাচ্ছে। তার মতে, 'বাঘ' থেকে এটা এখন 'বুনো বিড়ালে' পরিণত হয়েছে এবং ভ্যাকসিন ছাড়াই এটি নির্মূল হতে পারে।"
তাই ভ্যাকসিন এলো কি এলো না বা পেলাম কি পেলাম না- এগুলো নিয়ে আফসোস-আক্ষেপ না করে নিজের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেয়াটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।