করোনা-বাঘ এখন নেহাত করোনা-বেড়াল : করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কবাদীদের কিছু আতঙ্ক তত্ত্ব বনাম বাস্তবতা

৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯ : চীনের উহানে ভাইরাল নিউমোনিয়া প্রকোপের খবর প্রথমবারের মতো আসে দেশটির সংবাদমাধ্যমে।

জানুয়ারি, ২০২০ : সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে চীনজুড়ে

১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগটির নামকরণ করে করোনাভাইরাস ডিজিজ-২০১৯ বা কোভিড-১৯।

পরবর্তী কয়েক মাস। বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়তে থাকে করোনাভাইরাস।

তবে তার চেয়েও দ্রুত ছড়াতে থাকে আরেকটি ভাইরাস- করোনা-আতঙ্ক ভাইরাস।

সোশ্যাল মিডিয়া, ইন্টারনেট আর নিউজে প্রতিদিন আসতে থাকে একের পর এক আতঙ্কের খবর। কখনো বিশেষজ্ঞের বরাতে, কখনো গবেষণা বা স্বাস্থ্য সংস্থার বরাতে।

আতঙ্কবাদীদের প্রচারণায় করোনা-অণুজীব যেন পরিণত হয় করোনা-বাঘে। দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। খেয়ে ফেলবে টুকরো করে!

কিন্তু আজ ছ’মাস! ভাইরাসটি সম্পর্কে জানা গেছে অনেককিছুই। করোনা-বাঘ থেকে তা পরিণত হয়েছে নেহাত বেড়ালে!

আতঙ্ক তত্ত্ব-১ : বিশ্বজুড়ে এবছর ৩০০ থেকে ৫০০ কোটি মানুষ আক্রান্ত হবে করোনাভাইরাসে!

মার্চের শুরুতেই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারিবিদ মার্ক লিপসেটের লেখা এক গবেষণা নিবন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়, বিশ্বজুড়ে এ বছর ৩০০ থেকে ৫০০ কোটি মানুষ আক্রান্ত হবে করোনাভাইরাসে!

যুক্তরাষ্ট্রে ২২ লাখ মানুষ মারা যাবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়। বলা হয়, সব রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা করতে পারলেও না কি মারা যাবে ১২ লাখ মানুষ!

অথচ আজ সংক্রমণের এই সপ্তম মাসে পৃথিবীজুড়ে ভাইরাসটিতে আক্রান্তের সংখ্যা ২ কোটিও ছাড়ায় নি। যাদের মধ্যে আবার ১ কোটি মানুষ সুস্থও হয়ে গেছেন!

সুনামির মতো ধেয়ে আসছে ভারতে

ভারতে না কি সুনামির মতো ধেয়ে আসছে করোনা। ৩০ কোটি ভারতীয় করোনায় আক্রান্ত হবে বলে বলেন একজন বিশেষজ্ঞ রামানান লক্ষ্মীনারায়ণ। সেন্টার ফর ডিজিস ডায়নামিক্স, ইকোনমিক্স এন্ড পলিসির পরিচালক।

“If the same mathematical models applied in the US or UK were applied to India, the country could be dealing with about 300 million cases, of which about four to five million could be severe.”

অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যে যে হারে আক্রান্ত বা মৃতের ঘটনা ঘটছে সেই একই গাণিতিক মডেলকে যদি ভারতের প্রেক্ষাপটেও প্রয়োগ করা হয় তাহলে ৩০ কোটির মতো আক্রান্তের ঘটনা ঘটতে পারে ভারতে যাদের মধ্যে প্রায় ৫০ লক্ষের মতো মৃতের ঘটনা ঘটতে পারে।

দশ লক্ষ জনসংখ্যায় ভারতে মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র ২০ বা ২১

অথচ আজ সংক্রমণের সপ্তম মাসে ভারতের সংক্রমণ ১২ লক্ষও ছাড়ায় নি।

ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশনের সিনিয়র ফেলো স্বামিকা রাভি বলেন, বেশিরভাগ করোনা আক্রান্তই কিন্তু সেরে উঠছেন এবং বেশ দ্রুতই সেরে উঠছেন।

আর মৃত্যুর হারও অনেক কম। প্রতি দশ লক্ষ জনসংখ্যায় ভারতে মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র ২০ বা ২১। যেখানে বেলজিয়ামে সেই একই সংখ্যা ৯০০-র কাছাকাছি। পশ্চিম ইউরোপ, স্পেন ফ্রান্স বা ইটালির চেয়ে এক্ষেত্রে ভারতের অবস্থা অনেক গুণে ভালো!

আসলে ড. লক্ষ্মীনারায়াণের মতো বিশেষজ্ঞরা যে জায়গাটায় ভুল করেছেন তা হলো আমেরিকা বা যুক্তরাষ্ট্রের মডেলকে ভারত বা উপমহাদেশের সাথে তুলনা করে।

বাংলাদেশ : আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যু হার মাত্র ১%

বলা হলো, পরীক্ষা করা হোক না হোক ঢাকায় সাড়ে সাত লাখ মানুষ ইতোমধ্যেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে গেছে

আরেকটি পূর্বাভাসে বলা হলো, বাংলাদেশ এক লক্ষ মানুষ মারা যাবে করোনায়।

অথচ আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট সোয়া দুই লক্ষ মানুষ আক্রান্ত যাদের মধ্যে সোয়া লক্ষই সুস্থ হয়ে গেছেন। এবং আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুর হার মাত্র ১%। এবং মারা যাওয়াদের ৪৪ ভাগেরই বয়স ৬০ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে, যারা আগে থেকেই নানা জটিলতায় ভুগছিলেন।

এত বড় বড় পূর্বাভাস কেন ব্যর্থ হচ্ছে!

প্রশ্ন হলো- ভারতে বা বাংলাদেশে করোনামৃত্যু নিয়ে বিশেষজ্ঞদের এত বড় বড় পূর্বাভাস কেন ব্যর্থ হচ্ছে?

কারণ মিউটেশন। ভাইরাস যখন তার মিউটেশন ঘটায় তখন কিছু কিছু ভুলও হয়। আর ভুল যত বেশি হয় ততই ভাইরাস হারায় তার শক্তি ও কার্যকারিতা

“A lot of people think that a mutation is a bad thing. All that it is when the virus replicates, it makes mistakes. We hope that as a result of multiple infections and multiple mistakes, these viruses actually lose their potency and become ineffective in infecting humans.” - Dr. Bharat Pankhania, senior clinical lecturer, University of Exeter

বাংলাদেশের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পাশ্চাত্যের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার চেয়ে বেশি

একথা এখন এক প্রমাণিত সত্য যে বাংলাদেশের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পাশ্চাত্যের মানুষের তুলনায় বেশি।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ইমিউনোলজি বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল বলেন,

“অনেকে বলেছিলেন বাংলাদেশে মৃত্যু এত বেশি হবে যে পথে-ঘাটে লাশ পড়ে থাকবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয় নি। এদেশের মানুষের ইমিউন সিস্টেম এই প্রতিরক্ষা বলয় তৈরি করেছে।

বাংলাদেশের আবহাওয়া, খাবার, নানা রোগ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে এদেশের মানুষের ইমিউন সিস্টেমকে সবসময়ই সক্রিয় থাকতে হয়। আমি ল্যাবরেটরিতে কারো কারো দেহে ভাইরাসের আধিক্য দেখে বিস্মিত হয়ে পড়ি!

নানারকম ভাইরাসের সঙ্গেই এদেশের মানুষ বসবাস করে। ফলে নতুন কোনো ভাইরাস যদি শরীরে ঢুকতে চায় তখন এই সিস্টেম তাতে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে।”

একই কথা বললেন, অক্সফোর্ডের এপিডেমিওলজিস্ট ড. সুনেত্রা গুপ্তা-

there are many more coronaviruses floating around in the subcontinent and maybe we indirectly have very high level exposure to a range of pathogens which could buttress our immunity against this…

… We are sure that that would be the case in India and I think, again the fact that we are regularly exposed to these viruses, we stand as in, put as in a good position to deal with coronaviruses- the new virus. (The Telegraph)

বন্ধ হচ্ছে করোনাভাইরাসের জন্যে স্থাপিত দেশের মেক-শিফট হাসপাতালগুলো

বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা ২২৬টি করোনাভাইরাসের সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন করেন। আর তা করতে গিয়ে তারা দেখেন- বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের D-614G নামের যে মিউটেশনটি সক্রিয়, তা সেরকম বিপজ্জনক নয় যা দেখা গিয়েছিল মারাত্মকভাবে আক্রান্ত দেশগুলোতে!

এসব কারণেই বাংলাদেশে মৃদু থেকে মাঝারি সংক্রমণের প্রবণতাই দেখা গেছে বেশি। ফলে গুরুতর অসুস্থদের জন্যে যেসব অস্থায়ী হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়েছিল তার কয়েকটিকে বন্ধ করে দেয়ার প্রক্রিয়াই চলছে এখন।

আতঙ্ক তত্ত্ব-২ : কীভাবে ছড়ায় করোনাভাইরাস? কোথায় কতক্ষণ জীবিত থাকে?

করোনাভাইরাস নিয়ে সবচেয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিল সম্ভবত ভাইরাসটি কীভাবে ছড়ায় তা নিয়ে।

প্রথমে বলা হলো- আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি থেকে বাতাসের মাধ্যমে।

তারপর বলা হলো- তার স্পর্শ লেগেছে এমন জায়গা থেকে যেখানে তিন দিন পর্যন্তও না কি ভাইরাসটি জীবিত থাকতে পারে।

একটু পর পর হাত ধুতে বলা হলো। নাকে-মুখে হাত না দিয়ে কীভাবে থাকতে হবে তা শেখানো হলো।

বলা হলো, টয়লেট ফ্লাশ করলে বা এসির বাতাস থেকেও ছড়াতে পারে এই জীবাণু! এমনকি কোরবানির যে মাংস ফ্রিজে রাখা হবে তাতে যদি ভাইরাস থাকে তাহলে তা দু'বছর পর্যন্তও থেকে যেতে পারে।

সবচেয়ে আতঙ্ক তৈরি হলো যখন বলা হলো- দেহে ভাইরাস আছে, কিন্তু উপসর্গ নেই, এমন লোকরাও করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে! বিশেষজ্ঞরা বললেন, হয়তো এই ‘নীরব বিস্তারকারীরাই’ এই ভাইরাস এত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার জন্য দায়ী!

আমাদের দেহ প্রতিনিয়তই মোকাবেলা করছে অসংখ্য ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া

প্রশ্ন হলো- যদি এত সংক্রামকই হবে তাহলে এতদিন ধরে এতগুলো দেশে ছড়িয়ে পড়ার পরও কেন ভাইরাসটি এখনো পৃথিবীর জনসংখ্যার সাতশ ভাগের মাত্র দেড়ভাগের বেশিকে আক্রমণ করতে পারে নি?

আসলে প্রতিদিন নিজের অজান্তেই আমরা মুখোমুখি হচ্ছি অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, এলার্জেন, ফাঙ্গির।

চোখে দেখতে না পাওয়া এসব অণুজীবকে প্রতিনিয়তই আমাদের শরীর তার সহজাত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়ে মোকাবেলা করছে। আর আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো।

উপসর্গহীন রোগীদের দ্বারা সংক্রমণের ঘটনা খুব বিরল- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশেষজ্ঞ

আর উপসর্গহীন রোগীদের ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ মারিয়া ভ্যান কারখভ খুব স্পষ্টভাবেই বলেন, “বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি, উপসর্গহীন রোগীদের দ্বারা সংক্রমিত হবার ঘটনা বেশ বিরল।”

“We have a number of reports from countries who are doing very detailed contact tracing. They are following asymptomatic cases, they are following contacts and they are not finding secondary transmission on what is very rare.

But from the data we have it still seems to be rare that an asymptomatic person actually transmits onwards to a secondary individual.” -Maria Van Karkhove

আতঙ্ক তত্ত্ব-৩ : সেরে ওঠা কোভিড রোগীরা বছরের পর বছর নতুন করে আক্রান্ত হতে পারে!

জুলাইয়ের প্রথম দিকে লন্ডনের কিংস কলেজের একটি গবেষণা বলে যে সেরে ওঠা কোভিড রোগীরা বছরের পর বছর নতুন করে আক্রান্ত হতে পারে। কারণ তাদের দেহে এন্টিবডির সক্ষমতা তিনমাস পর থেকে দ্রুত কমে যেতে পারে।

বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট ড. বিজন কুমার শীল দিয়েছেন এর উত্তর-

কারো শরীর থেকে এন্টিবডি কমে যাওয়ার অর্থ এই নয় যে তিনি আবার করোনা আক্রান্ত হয়েছেন।

একজন মানুষ করোনা আক্রান্ত হবার পর দু্টো পরিবর্তন ঘটে তার শরীরে-

১. কিছু বায়োম্যাটার তৈরি হয়। যেটাকে ‘এন্টিবডি’ বলে যা পরবর্তীতে এই রোগ প্রতিরোধে কাজ করে।

২. মেমোরি সেল তৈরি হয় দেহে। এবং আক্রান্ত হওয়ার ১৪-১৫ দিনের মধ্যেই এটা ঘটে। এরপর যদি আপনি এই ভাইরাসের সামনে পড়েন, যা ইমিউন সিস্টেম শনাক্ত করে তবে এই মেমোরি সেলগুলো ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এন্টিবডি তৈরি করা শুরু করে দেয়।

-ড. বিজন কুমার শীল

করোনাভাইরাস হয়তো হতে যাচ্ছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনেরই অংশ!

আর অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এপিডেমিওলজিস্ট ড. সুনেত্রা গুপ্তা বলেন আরো স্বাভাবিক বাস্তবতার কথা-

"Well I think the coronavirus pandemic will end naturally. It will settle but it will not end by going away. It will end by becoming part of our lives just like influenza, hopefully with a lower death toll than influenza."

অর্থাৎ “করোনাভাইরাস আসলে ইনফ্লুয়েঞ্জার মতোই আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হতে যাচ্ছে। কিন্তু এর ক্ষতিকারক প্রভাব হবে ইনফ্লুয়েঞ্জার চেয়েও কম!”

আমরা জানি, ইনফ্লুয়েঞ্জা জটিলতার কারণে প্রতি বছর বিশ্বে ৬,৫০,০০০ মানুষ মারা যায়!

আতঙ্ক তত্ত্ব-৪ : করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ আসতে পারে!

বিশ্বব্যাপী মহামারির নানা উদ্ধৃতি দিয়ে এক শ্রেণির বিশেষজ্ঞ বলার চেষ্টা করেছেন যে, করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় একটা ঢেউ আসতে পারে। এবং তাতে প্রথম দফার চেয়েও বেশি মানুষ মারা যাবে!

তারা বলেছেন, আগামী শীত মৌসুমেই নাকি ইউরোপে দ্বিতীয় দফায় দেখা দেবে এ মহামারি।

প্রথমত, করোনাভাইরাস দ্বিতীয় দফা শুধু নয়, হয়তো হতে যাচ্ছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনেরই অংশ, যেমনটি একটু আগে আমরা বলেছি।

দ্বিতীয়ত, ২০০২-২০০৩ সালে সার্স এবং মার্সের যে প্রকোপ দেখা দিয়েছিল তার কারণও ছিল করোনাভাইরাস। সার্স বা মার্সের কিন্তু দ্বিতীয় দফা প্রাদুর্ভাব ঘটে নি।

আতঙ্ক তত্ত্ব-৫ : আক্রান্তদের নতুন নতুন উপসর্গ, এমনকি সেরে ওঠার পরও উপসর্গ!

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর নানা দেশের নানা বয়সী মানুষ যখন আক্রান্ত হচ্ছিলেন তখন নতুন নতুন উপসর্গও দেখা দিচ্ছিল।

কিন্তু মিডিয়া তথ্যগুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করছিল যেন উপসর্গগুলো প্রাণসংহারি!

বাস্তবতা হচ্ছে, শারীরিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে নানা দেহে নানা উপসর্গ হতেই পারে। অন্য রোগেও যেমন হয়।

কিন্তু উপযুক্ত পথ্য, ওষুধ এবং শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার মাধ্যমেই তা আবার সেরেও ওঠে।

আতঙ্ক তত্ত্ব-৬ : সামাজিক দূরত্ব না শারীরিক দূরত্ব?

মার্চের শেষাশেষি ‘সোশ্যাল ডিসটেন্সিং’ বা ‘সামাজিক দূরত্ব’ বলে একটি শব্দ শুনতে শুরু করে বিশ্ববাসী-

পরস্পরের সাথে এক মিটার বা তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখা যাতে হাঁচি-কাশি বা কথা বলার সময় ছিটে আসা থুতুর সাথে ভাইরাসের ড্রপলেট গায়ে না পড়ে!

এই ব্যাখ্যার কোথাও কি সামাজিক বা সোশ্যাল শব্দ ব্যবহারের প্রাসঙ্গিকতা ছিল? ছিল না।

বরং এটা পুরোপুরিই ফিজিকেল ডিসটেন্সিং বা শারীরিক দূরত্বের ব্যাপার ছিল!

কিন্তু বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে গেল শব্দটি! প্রয়োগ করা হতে লাগল সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়া বা করার ক্ষেত্রে।

পৃথিবীর নানা দেশে নানা সমাজে করোনা আক্রান্তদের প্রতি যে অমানবিকতা, নিষ্ঠুরতার কথা শোনা গেছে, তার মূলেও ছিল সম্ভবত এ শব্দটি।

আতঙ্ক তত্ত্ব-৭ : মৃতদেহ থেকে ভাইরাস ছড়ায়!

মৃতদেহ থেকে ভাইরাস ছড়ায়-এই আতঙ্কে পৃথিবীর বহুদেশে মৃতদেহকে ঘিরে দেখা দেয় নানা জটিলতা।

মৃত্যুর পর ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাশ পড়ে থাকে হাসপাতালে, ভয়ে কেউ কাছে আসে নি, আত্মীয়-পরিজনরা পর্যন্ত পালিয়ে গেছে ফেলে, কবরস্থান বা শশ্মানে লাশ নিতে দেওয়া হয় নি বা মৃতদেহের সাথে ঘটেছে অবমাননা- এমনি নানা ঘটনা।

অথচ মার্চের ২৪ তারিখে ডব্লিউএইচও একটি গাইডলাইন প্রকাশ করে-‘Infection Prevention and Control for the safe management of a dead body in the context of COVID-19

এতে তারা বলে, ...dead bodies are generally not infectious. ...

To date there is no evidence of persons having become infected from exposure to the bodies of persons who died from COVID-19

অর্থাৎ “মৃতদেহ থেকে ভাইরাস ছড়ায় না। করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এমন কারো থেকে সংক্রমণের খবর এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে নেই।”

তারা আরো বলে, It is common myth that persons who have died of a communicable disease should be cremated, but this is not true. Cremation is matter of cultural choice and available resources.

অর্থাৎ সংক্রামক রোগে মারা গেলে তাকে দাহ করতে হবে- এ ধারণা ভুল। দাহ করার ব্যাপারটি নির্ভর করে তার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের ওপর।

আতঙ্ক তত্ত্ব-৮ : করোনাভাইরাসের টিকা/ভ্যাকসিন

করোনাভাইরাসের টিকা বা ভ্যাকসিন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে প্রথম থেকেই। বলা হচ্ছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ৮০টির বেশি গবেষণা সংস্থা নাকি এ নিয়ে কাজ করছে। ২০২০ এর সেপ্টেম্বরের আগেই চলে আসবে টিকা।

প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে বিজ্ঞানীরাই বলেন, যে-কোনো টিকা বা ভ্যাকসিন আবিষ্কার –এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া, মোট চারটি ধাপে এ কাজ সম্পন্ন হয়-

১. গবেষণা

২. ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা নিরীক্ষা

৩. পর্যালোচনা ও অনুমোদন এবং

৪. উৎপাদন ও বিতরণ

এবং এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে কখনো কখনো ১৫ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে, সেখানে করোনাভাইরাসের টিকা মাত্র নয় মাসে হয়ে যাচ্ছে, এ দাবী কতটুকু নির্ভরযোগ্য?

আর যদি তা হয়ও তাহলে যে ভাইরাসের ভ্যাকসিন এত সহজে আবিষ্কার হতে পারে, সে ভ্যাকসিনের আদৌ প্রয়োজন আছে কি না সে প্রশ্নই তুলছেন বিজ্ঞানীদের আরেকটি মহল।

তারা বলছেন, করোনাভাইরাস প্রাকৃতিকভাবেই নিয়ন্ত্রিত হবে। এর জন্যে ভ্যাকসিনের কোনো প্রয়োজন নেই।

"coronavirus has downgraded from Tiger to Wild Cat and could die out without vaccine"

- Professor Matteo Bassetti, Infectious Disease Specialist

কিছু মানুষকে কখনোই করোনাভাইরাস কাবু করতে পারবে না

আর বিজ্ঞানীরা এখন দেখছেন, কিছু মানুষ আছে যাদের করোনাভাইরাস কখনোই কাবু করতে পারবে না। কারণ তাদের দেহে আছে হেল্পার টি-সেল যা তৈরি হয়েছিল কোনো একসময় একই ধরনের অন্য ভাইরাস মোকাবেলা করতে গিয়ে।

আর সার্স নিয়ে গবেষণাকারী ড. বিজন শীল দিয়েছেন আরো চমকপ্রদ তথ্য-

২০০৩ সালে আমি সার্স নিয়ে কাজ করি সিঙ্গাপুরে। সার্সের সঙ্গে বর্তমান করোনাভাইরাসের ৮০ ভাগেরও বেশি মিল রয়েছে।

সেসময় গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, বাংলাদেশ ও এই অঞ্চলের মানুষের দেহে ACE-2 এনজাইমের পরিমাণ কম থাকায় ভাইরাসটি কম আক্রমণ করছে বা তারা আক্রান্ত হলেও কম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

কিন্তু চাইনিজ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ACE-2 এনজাইমের পরিমাণ বেশি থাকায় তারা সহজেই আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন।

এছাড়া বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসের কারণে ইমিউন সিস্টেম সক্রিয়। এ দুটো বিষয় বাংলাদেশের মানুষকে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি সুরক্ষিত রেখেছে।

ইতালির মানুষের ACE-2 এনজাইমের পরিমাণ তুলনামূলক কম থাকলেও তাদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল থাকায় তারা বেশি আক্রান্ত হয়েছেন।

-ড. বিজন কুমার শীল

শুরু করুন আতঙ্কমুক্ত স্বাভাবিক জীবন

কাজেই আতঙ্কে না ভুগে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ান। মেডিটেশন, যোগ ও প্রাণায়াম করুন। সুস্থ খাদ্যাভ্যাস-জীবনাচার গড়ুন। লালন করুন সঠিক জীবনদৃষ্টি। আপনি সুস্থ থাকবেন। সুখী হবেন।

শুরু করুন আতঙ্কমুক্ত স্বাভাবিক জীবন। করোনা-বাঘ এখন নেহাত করোনা-বেড়াল।