মাত্র ৬ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যেই পূরণ হয়ে যায় রক্ত

চিকিৎসাবিজ্ঞান এখন উন্নত। চিকিৎসাপ্রযুক্তিও সম্ভব করছে এমন অনেক অসম্ভবকে, কয়েক দশক আগেও যা ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু কৃত্রিম উপায়ে রক্ত তৈরির কোনো উপায় এখনো জানা যায় নি। অন্য কোনো প্রাণীর রক্তও মানুষকে দেয়া যায় না। একজন মানুষের প্রয়োজনে আরেকজন মানুষ রক্ত না দিলে তার সামনে আর কোনো বিকল্প নেই।

মজার ব্যাপার হলো, আপনার দেয়া যে রক্তটুকু আরেকটি মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে, আপনার নিজের জন্যে কিন্তু তা অপ্রয়োজনীয়, বাড়তি। কারণ ৫০ কেজি ওজনের পূর্ণবয়স্ক একজন পুরুষের শরীরের ১৩০০ মিলিলিটার রক্তই বাড়তি, নারীদের ক্ষেত্রে এটা ৮০০ মিলিলিটার। আর রক্ত দিতে এলে একজন ডোনারের কাছ থেকে নেয়া হয় মাত্র ৩৫০-৪০০ মিলিলিটার রক্ত, যা এই বাড়তি রক্তের অর্ধেকেরও কম। আর এ ক্ষয় পূরণ হয়ে যায়ও খুব দ্রুত।

রক্ত দেয়ার সময় একজন ডোনারের দেহ থেকে নেয়া হয় এক পাইন্টেরও কম পরিমাণ রক্ত (৩৫০-৪০০ মিলি), যা একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের শরীরে মোট রক্তের শতকরা ১৩ ভাগেরও কম। তবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, নতুন রক্তকণিকা এবং রক্তরস উৎপাদনের মাধ্যমে রক্তের ক্ষয়পূরণের এক অসাধারণ ক্ষমতা আছে মানবদেহের।

লোহিত কণিকার কথাই ধরুন। প্রতি মুহূর্তে দেহে লক্ষ লক্ষ লোহিত কণিকা তৈরি হয়, আবার ধ্বংস হয়। রক্ত দেয়ার পর বেরিয়ে যাওয়া লোহিত কণিকা পূরণ করার জন্যে দেহ যেভাবে তৎপর হয়ে ওঠে, তার প্রক্রিয়াটা এরকম—রক্ত দেয়ার পর কিডনিতে পেরিটিউবুলার সেল বলে একধরনের সেল আছে যা বুঝতে পারে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেছে (কারণ লোহিত কণিকাই অক্সিজেন ধারণ করে)। সাথে সাথে সে এরিথ্রোপ্রোটিন নামে এক ধরনের প্রোটিন নিঃসরণ শুরু করে। রক্ত দ্বারা পরিবাহিত হয়ে এই প্রোটিন পৌঁছে যায় বোনম্যারো পর্যন্ত। বোনম্যারো তখন স্টেমসেল উৎপাদন শুরু করে। আর স্টেমসেলই হলো মূল উপাদান, যা লোহিত কণিকা, শ্বেতকণিকা এবং অনুচক্রিকা তৈরি করে থাকে। শ্বেতকণিকা বা অনুচক্রিকার বদলে বেশি বেশি লোহিতকণিকা তৈরি করতে হবে – এ উদ্দীপনাও স্টেমসেলকে দিতে থাকে এরিথ্রোপ্রোটিন।

অপেক্ষা কেন?

রক্ত দেয়ার ছয় থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যেই সাধারণত হিমোগ্লোবিনেের মাত্রা আগের অবস্থায় ফিরে যায়। প্রশ্ন হলো, কেন এ সময়টা লাগে? আসলে শ্বেতকণিকা বা অনুচক্রিকার ক্ষয়টা পূরণ হয়ে গেলেও লোহিতকণিকার ক্ষয় পূরণ হতে কিছুটা সময় লাগে। আর লোহিত কণিকার সাথে সুস্থতার একটা সম্পর্ক আছে। কারণ লোহিত কণিকায় থাকে হিমোগ্লোবিন অণু, যার প্রধান কাজই হলো সারাদেহে অক্সিজেন বয়ে নিয়ে যাওয়া। আর হিমোগ্লোবিনে থাকে আয়রন, রক্ত দেয়ার সময় যা কিছুটা হারায়। এটা পূরণ করার জন্যে তখন একদিকে দেহের লৌহভাণ্ডার বেশি বেশি ব্যবহৃত হয়, অন্যদিকে খাবার এবং পানীয় থেকে তৈরি হতে থাকে বেশি বেশি আয়রন।

সাধারণভাবে, পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের দেহে লৌহ কম থাকে। আর লৌহ কম থাকা মানে হিমোগ্লোবিন কম থাকা এবং এটা যদি দীর্ঘমেয়াদী হয়, তাহলে এনিমিয়াও দেখা দিতে পারে। এসব কারণেই বলা হয়, একবার রক্ত দেয়ার পর পুরুষদের কমপক্ষে ১২ সপ্তাহ এবং মহিলাদের কমপক্ষে ১৬ সপ্তাহ অপেক্ষা করা উচিত। আর তাছাড়া রক্ত দেয়ার আগে ডোনারদের, বিশেষ করে নারী রক্তদাতাদের জন্যে আমাদের রয়েছে আবশ্যকীয় হিমোগ্লোবিন টেস্ট এবং সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, নির্দিষ্ট মাত্রার ওপরে হিমোগ্লোবিন না থাকলে তার রক্ত নেয়া হবে না।

কোন কোন খাবার খেলে আয়রন বাড়ে

আমাদের শরীরের লোহাগুলো সাধারণত দুটি প্রোটিনের আকারে জমা থাকে—ফেরিটিন এবং হিমোসিডিরিন। আর এই প্রোটিনগুলো থাকে লিভার, বোনম্যারো এবং মাসলে। দেহের লোহা যদি বেশি বেশি ক্ষয় হতে থাকে এবং খাবার-পানীয় ইত্যাদির মাধ্যমে পুনরায় তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়াটা সক্রিয় না থাকে, তাহলে দেহে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।

বেশকিছু খাবার আছে, যা নিয়মিত খেলে দেহে লৌহের চাহিদা সহজেই পূরণ হতে পারে। যেমন, মাছ, মাংস, ডিম, সবুজ শাকসবজি, ডাল, লাল চাল, শিম ইত্যাদি। আর তাছাড়া ভিটামিন সি লোহাকে ধরে রাখতে সাহায্য করে। তাই এসব খাবার খাওয়ার পরে আপনি যদি এক গ্লাস ভিটামিন সি-যুক্ত ফলের রস খান, তাহলে এসব খাবারের লোহার পুরোটাই আপনার দেহ গ্রহণ করবে।

পানি খেতে হবে প্রচুর

দেহের মোট ওজনের অাট ভাগই রক্ত। আর রক্তের ৫৫ ভাগই হলো রক্তরস বা প্লাজমা, যার ৯০ ভাগই আসলে পানি। সুতরাং আপনি যে রক্ত দেন তার ওজন এক পাইন্টের কম হলেও আসলে এর অর্ধেকটাই পানি। এজন্যেই রক্ত দেয়ার আগে এবং পরে আমরা পর্যাপ্ত পানি খেতে বলি (অন্তত ৫০০ মিলিলিটার)। তাহলেই রক্ত দেয়ার পর ক্ষয়টা দ্রুত পুষিয়ে যায়।

জ্ঞান হারিয়ে ফেলা

রক্তদানের পর কাউকে কাউকে অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখি আমরা। এটা হয় সাধারণত লো ব্লাড প্রেশারের কারণে। ঘাড়ের ধমনীতে ব্যারোরিসিপটর নামে বিশেষ একধরনের নার্ভসেলের কারণে রক্ত দেয়ার পর পরই দেহে খবর হয়ে যায় যে, রক্তচাপ কমে গেছে। এই শূন্যতা পূরণের জন্যে রক্তকণিকাগুলো তখন সংকুচিত হয় এবং রক্তচাপকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। আর রক্ত দেয়ার পর পরই কেউ যদি দ্রুত উঠে যান বা হাঁটতে শুরু করেন, তখন আকস্মিক রক্তচাপ নেমে যাওয়ার ফলে কারো কারো শরীরটাকে হালকা মনে হতে পারে, অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে ইত্যাদি। এটাকে এড়ানোর জন্যে যা করতে পারেন তাহলো, রক্ত দেয়ার পর পরই না উঠে কিছুক্ষণ সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে পারেন। খেয়াল রাখতে হবে, এসময় মাথার নিচে যেন কোনো বালিশ বা উঁচু কিছু না থাকে। কারণ মাথাটাকে রাখতে হবে হার্টের লেভেলে, যাতে হার্ট থেকে ব্রেনে পর্যাপ্ত রক্ত যেতে পারে। আর নামার আগে কিছুক্ষণ পা ঝুলিয়ে বিছানায় বসে থাকতে পারেন। আর তারপরও যদি আপনার কোনো অসুবিধা হয়, তো সেটা দেখার জন্যে আমাদের রয়েছেন উপস্থিত চিকিৎসকদের টিম।