published : ১৩ ডিসেম্বর ২০১৫
এই অস্বচ্ছ লাল তরল পদার্থটি শরীরের অভ্যন্তরীণ এক পরিবহন মাধ্যম। এটি বাহিত হয় শিরা বা ধমনীর মধ্য দিয়ে। দেহের প্রতিটি টিস্যুতে পৌঁছে দেয় খাবার ও অক্সিজেন। টিস্যুর বৃদ্ধি ও ক্ষয়রোধের জন্যে এ খাবার ও অক্সিজেন অপরিহার্য। এছাড়া দেহের বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে নিঃসরিত হরমোন রক্তের মাধ্যমেই পৌঁছে যায় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে, নিশ্চিত করে ঐ অঙ্গের কর্মক্ষমতাকে। রক্ত টিস্যুর বর্জ্যগুলো বের করে দেয়। কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে বয়ে আনে ফুসফুসে, দেহের বাইরে বের করে দেয়ার জন্যে। বাড়তি উপাদানগুলোকে পরিবহন করে নিয়ে যায় কিডনিতে, যাতে দেহের বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে। দেহের তাপমাত্রা ঠিক রাখতে রক্ত সাহায্য করে। দেহের অন্যান্য তরল পদার্থগুলোর ভারসাম্য বজায় রাখতেও সহায়তা করে। যখন দেহ রোগাক্রান্ত হয়, তখন রক্তই প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে জীবাণুর বিরুদ্ধে। দেহের অভ্যন্তরস্থ এসিড এবং ক্ষারের স্বাভাবিক মাত্রা বজায় রাখাও রক্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
প্রতি ফোঁটা রক্তে রয়েছে ২৫০ মিলিয়ন বা ২৫ কোটি লোহিতকণিকা, চার লাখ শ্বেতকণিকা ও ২৫ মিলিয়ন বা আড়াই কোটি প্লাটিলেট। এ কণিকগুলো অনুজ্জ্বল হলদে রঙের এক তরল প্লাজমার মধ্যে ডুবে থাকে। লোহিতকণিকাগুলো ফুসফুস থেকে হৃৎপিণ্ড হয়ে সারা দেহে অক্সিজেন বয়ে নিয়ে যায় এবং সারা দেহের কোষ থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ফুসফুসে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। শ্বেতকণিকা দেহ-আক্রমণকারী জীবাণুকে ধ্বংস করে। আর জখমস্থানে রক্তকে জমাট বাঁধতে সহায়তা করে প্লাটিলেট। প্লাজমা এসব রক্তকণিকাগুলোকে সারা দেহে বয়ে নিয়ে বেড়ায়। পাশাপাশি রাসায়নিক পদার্থ ও পুষ্টি সরবরাহ করে দেহের বিভিন্ন অংশে।
প্রতি ২৪ ঘন্টায় একজন মানুষের হৃৎপিণ্ড ১২ হাজার মাইল রক্তবাহী শিরা ও ধমনীর মধ্য দিয়ে অাট হাজার গ্যালন রক্ত পাম্প করে। হৃৎপিণ্ড সবসময়ই রক্ত পাম্প করছে। স্বাভাবিক অবস্থায় পাম্প করা রক্তের শতকরা ১৫ ভাগ সরাসরি চলে যায় মস্তিষ্কে, ২৫ ভাগ যায় কিডনিতে। পেশিগুলোতে যায় ২০ ভাগ। হৃৎপিণ্ডের নিজেরও পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহ প্রয়োজন হয়।
চাইলেই একজন মানুষের শরীর থেকে আরেকজন মানুষের শরীরে রক্ত সঞ্চালন করা যাবে না। তার কারণ মানুষের রক্তের বিভিন্ন গ্রুপ রয়েছে। রক্তের লোহিতকণায় ও রক্তরসে রাসায়নিক উপাদানগত কিছু তারতম্য রক্তের এই শ্রেণি বিভাগের কারণ। বিভিন্ন ধরনের রক্তগ্রুপ থাকলেও রক্ত সঞ্চালনের ক্ষেত্রে কেবল ABO গ্রুপ ও Rh ফ্যাক্টর গুরুত্বপূর্ণ।
রক্তের লোহিতকণার আবরণে বিশেষ বিশেষ ধরনের যৌগিক পদার্থ থাকে, যাকে বলে এন্টিজেন। দুই ধরনের এন্টিজেন রয়েছে। একটির নাম A অপরটির নাম B।
রক্তের লোহিতকণার আবরণে শুধু A এন্টিজেন থাকলে রক্তের গ্রুপ হবে A, শুধু B এন্টিজেন থাকলে রক্তের গ্রুপ হবে B, A ও B উভয় এন্টিজেন থাকলে রক্তের গ্রুপ হবে AB আর A বা B কোনো এন্টিজেন-ই না থাকলে রক্তের গ্রুপ হবে O.
লোহিতকণার আবরণে যেমন এন্টিজেন থাকে তেমনি রক্তরসে থাকে এন্টিবডি, সাধারণত দুই ধরনের এন্টিবডি দেখা যায়- Anti-A এবং Anti-B ।
বিপরীতধর্মী Antigen ও Antibody পরস্পরকে ধ্বংস করে। এজন্যে যার রক্তকণায় A এন্টিজেন (Blood Group-A) রয়েছে, তার রক্তরসে আছে Anti-B Antibody। তেমনি যার রক্তকণায় B Antigen (Blood Group-B) রয়েছে তার রক্তরসে আছে Anti-A Antibody।
যার রক্তকণায় A ও B উভয় Antigen-B রয়েছে (Blood Group-AB) তার রক্তরসে কোনো Antibody নেই। আর যার রক্তে AB কোনো Antigen-B নেই (Blood Group-O) তার রক্তরসে Anti-A এবং Anti-B উভয় Antibody-B রয়েছে।
রক্তসঞ্চালনের ক্ষেত্রে দাতা ও গ্রহীতার একই রক্তগ্রুপ হতে হবে। রক্তগ্রহীতাকে ভিন্ন গ্রুপের রক্ত দেয়া হলে Antigen ও Antibody এর প্রতিক্রিয়ায় রক্তকণাগুলো ভেঙে গিয়ে তাল পাকিয়ে যায় ও রক্তনালী বন্ধ হয়ে গিয়ে বিপদ, এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে।
O গ্রুপের রক্তকণায় কোনো Antigen নেই। তাই O গ্রুপের অল্প পরিমাণ রক্ত যে-কোনো গ্রুপের মানুষের শরীরে দেয়া যায়। তাই O গ্রুপের দাতাকে সার্বজনীন দাতা বলে। AB গ্রুপের রক্তরসে কোনো Antibody নেই। তাই অন্য যে-কোনো গ্রুপের অল্প পরিমাণ রক্ত AB গ্রুপের মানুষের শরীরেও দেয়া যায়। তাই AB গ্রুপের মানুষকে সার্বজনীন গ্রহীতা বলে।
তবে সবসময় সঠিক গ্রুপের রক্তসঞ্চালনই নিরাপদ। অত্যন্ত জরুরি অবস্থা ছাড়া কখনোই সার্বজনীন দাতা বা সার্বজনীন গ্রহীতার ধারণার প্রয়োগ ঘটানো হয় না।
রক্তসঞ্চালনের ক্ষেত্রে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ রক্তগ্রুপ হলো রেসাস গ্রুপ বা রেসাস ফ্যাক্টর। রেসাস ম্যাকাকাস (Rhesus Macaqus) প্রজাতির ভারতীয় বানরের রক্তের লোহিত কণার আবরণে এক বিশেষ ধরনের যৌগ থাকে। যে মানুষের রক্তের লোহিতকণায় অনুরূপ যৌগ থাকে তাদের রক্তকে আরএইচ পজিটিভ বলা হয় আর যাদের রক্তে এই ধরনের যৌগিক পদার্থ থাকে না তাদের রক্তকে আরএইচ নেগেটিভ বলা হয়।
রক্তের গ্রুপ বলতে ABO কোনটি এবং তার সঙ্গে Rh Positive না Rh Negative বলতে হয়।
বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর রক্তের গ্রুপভিত্তিক হার | |||
---|---|---|---|
A= ২২.৪৪% | B= ৩৫.২০% | O= ৩৩.৯৭% | AB= ৮.৩৯% |
বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর রক্তের রেসাস ফ্যাক্টর হার | |
---|---|
Rhesus Positive = 97.44% | Rhesus Negative = 2.56% |
রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রয়োজন হয় সাধারণত নিম্নোক্ত ক্ষেত্রগুলোতে :
কৃত্রিম উপায়ে রক্ত তৈরি করা যায় না এবং অন্য কোনো প্রাণীর রক্ত মানুষের শরীরে সঞ্চালন করা যায় না। একজন মানুষের প্রয়োজনে আরেকজন মানুষ রক্ত না দিলে রক্ত পাওয়ার অার কোনো বিকল্প নেই।
বিভিন্ন চিকিৎসার ক্ষেত্রে রক্তের বিভিন্ন উপাদানের প্রয়োজন হয়। সবক্ষেত্রেই সঞ্চালন করার দরকার হয় না। যেমন, অগ্নিদগ্ধ রোগীকে শুধু রক্তরস দিলে চলে। রক্তস্বল্পতার রোগীকে শুধু রক্তকণা বা প্যাকড্ সেল (Packed Cell) অথবা শুধু লোহিতকণা পৃথক করে দেওয়া যায়। হিমোফিলিয়া রোগীদের ফ্যাক্টর এইট ও থ্যালাসেমিয়া রোগীদের লোহিত রক্তকণা সঞ্চালন করতে হয়।
এক ইউনিট রক্ত থেকে বিভিন্ন উপাদান পৃথক করে যার যে উপাদান প্রয়োজন, তাকে সেই উপাদান সঞ্চালন করলে এক ইউনিট রক্তে একাধিক রোগীর প্রয়োজন মিটতে পারে।
রক্তদান কতটা নিরাপদ এটা নিয়ে কারো কারো মধ্যে সংশয় আছে। আসলে দৈহিকভাবে রক্তদানের কোনো ঝুঁকি নেই। একজন পুরুষের শরীরে ওজনের কেজিপ্রতি ৭৬ মিলিলিটার এবং নারীদের শরীরে ওজনের কেজিপ্রতি ৬৬ মিলিলিটার রক্ত থাকে। সবারই কেজিপ্রতি ৫০ মিলিলিটার রক্ত সংবহনের কাজে লাগে, বাকিটা উদ্বৃত্ত। অর্থাৎ পুরুষের ওজনের কেজিপ্রতি ২৬ মিলিলিটার ও নারীদের ওজনের কেজিপ্রতি ১৬ মিলিলিটার রক্ত উদ্বৃত্ত। ফলে ৫০ কেজি ওজনের একজন পুরুষের উদ্বৃত্ত রক্তের পরিমাণ 50Í26=1300 মিলি এবং একই ওজনের একজন নারীর শরীরে উদ্বৃত্ত রক্তের পরিমাণ 50Í16=800 মিলি। স্বেচ্ছা রক্তদানে একজন দাতার কাছ থেকে ৩৫০ থেকে ৪০০ মিলিলিটার রক্ত সংগ্রহ করা হয়, যা তার শরীরের উদ্বৃত্ত রক্তের অর্ধেকেরও কম। ফলে রক্তদানে শারীরিক ক্ষতি হওয়ার কোনো আশঙ্কাই নেই।
রক্ত মূলত দুটো উপাদানে বিভক্ত—রক্তকণা বা কোষীয় অংশ এবং রক্তরস বা জলীয় অংশ। তিন ধরনের রক্তকণিকা রয়েছে—লোহিত কণিকা, শ্বেত কণিকা এবং অনুচক্রিকা। রক্তের শতকরা ৪৫ ভাগই রক্তকণিকা। বাকি ৫৫ ভাগ রক্তরস বা প্লাজমা, যার শতকরা ৯২ ভাগই জল।
রক্তকণার মধ্যে লোহিতকণা কোষে অক্সিজেন নিয়ে যায় আর কার্বন-ডাই-অক্সাইড ফিরিয়ে তা নিয়ে আসে হৃৎপিণ্ডে। শ্বেতকণা বিভিন্ন ধরনের জীবাণুর আক্রমণ থেকে শরীরকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। অনুচক্রিকা রক্তক্ষরণের ক্ষেত্রে রক্তকে জমাট বাঁধিয়ে রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে সাহায্য করে। প্লাজমা মূলত কণাগুলোকে বহন করে আর খাদ্য ও বাহ্য পদার্থ (ভিটামিন, হরমোন ইত্যাদি) পরিবহন করে। রক্তকণাগুলোর প্রত্যেকটির নির্দিষ্ট আয়ু আছে। সবচেয়ে বেশিদিন বাঁচে লোহিত কণা, আয়ু ১২০ দিন মাত্র। বিভিন্ন ধরনের শ্বেতকণার আয়ু ভিন্ন ভিন্ন, দুই থেকে ১০ দিন। অনুচক্রিকা দুই দিন পর্যন্ত বাঁচে।
এজন্যে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলেন, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিয়মিত তিন থেকে চার মাস অন্তর রক্তদান করতে পারে। এতে শারীরিক ক্ষতির কোনো আশঙ্কা নেই; বরং তা রক্তদাতার শারীরিক সুস্থতাকেই বাড়িয়ে দেয়।