published : ২৮ মে ২০১৬
মেদস্থূলতা! সাম্প্রতিক কয়েক দশকে সারা পৃথিবীজুড়েই স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের কাছে এটি দেখা দিয়েছে এক মূর্তিমান আতঙ্করূপে। এদেশেও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে এর হার। সম্প্রতি বাংলাদেশের শহর এলাকাগুলোতে বসবাসরত নারী ও শিশুদের ওপর পরিচালিত একটি জরিপে এমন তথ্য মিলেছে। গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআর,বি)-র একদল গবেষক।
তারা বলেন, দেশে মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৭ জন অতিরিক্ত ওজনধারী, আবার এদের মধ্যে শতকরা চার জন ভুগছেন মেদস্থূলতায়। এছাড়াও সারা পৃথিবীতেই মেদস্থূলতার হার বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স এন্ড ইভাল্যুশন-এর একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৮০ সালের (শতকরা ২ জন) তুলনায় ২০১৩ সালে (শতকরা ৪ জন) এসে বিশ্বজুড়ে মেদস্থূলতার পরিমাণ বেড়েছে দ্বিগুণ।
এখানে উল্লেখ্য, প্রত্যেক মানুষের উচ্চতা ও ওজন অনুসারে মেদস্থূলতা পরিমাপের একটি সার্বজনীন পদ্ধতি হলো বিএমআই (বডি মাস ইনডেক্স)। বিএমআই নির্ণয়ের উপায় : দেহের ওজন (কিলোগ্রামে)/ উচ্চতা২ (মিটারে)। এভাবে কারো বিএমআই মান যদি ১৮.৫ থেকে ২৫-এর মধ্যে হয় তবে তিনি স্বাভাবিক ওজনধারী। ২৫-এর বেশি হলে তিনি অতিরিক্ত ওজনধারী। আর বিএমআই মান ৩০-এর বেশি হলে তিনি স্থূলকায় বা মেদস্থূল বলে বিবেচিত হবেন।
আইসিডিডিআর,বি-র উদ্যোগে দেশের সাতটি বিভাগীয় শহরে বছর দুয়েক আগে পরিচালিত এ স্বাস্থ্যজরিপে দেখা গেছে, পাঁচ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের মায়েদের শতকরা ৫২ জনই অতিরিক্ত শারীরিক ওজনের শিকার এবং এদের মধ্যে ১৫ জনই মেদস্থূল। আর এ শিশুদের শতকরা ১৪ জন অতিরিক্ত ওজনধারী এবং এদের মধ্যে শতকরা চার জন মেদস্থূল।
অবস্থাপন্ন পরিবারগুলোতে শিশু-মেদস্থূলতার হার শতকরা ২৭ ভাগ, অন্যদিকে দরিদ্র পরিবারগুলোতে এই হার শতকরা ৩ ভাগ। গবেষকরা জানান, মাতৃ ও শিশু-মেদস্থূলতার হার সবচেয়ে বেশি হলো ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে। তাদের মতে, এ গবেষণা-কার্যক্রমে পরিণত বয়সের পুরুষরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না যদিও, কিন্তু তাদের ক্ষেত্রেও মেদস্থূলতার চিত্রটা একই।
গবেষকরা সাবধান করে দিয়েছেন ওজনধারী এবং স্থূলকায়দের ক্ষেত্রে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, অস্টিওআর্থ্রাইটিস, লিভার ও গলব্লাডারের বিভিন্ন ধরনের জটিলতা এবং শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলক বেশি। এবং এসব জটিলতা থেকে তাদের অকালমৃত্যুর সম্ভাবনাও বেড়ে চলে সমানতালে।
যুক্তরাজ্য ভিত্তিক বিশ্বখ্যাত চিকিৎসা-সাময়িকী ল্যানসেট-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মেদবহুলতার কারণে সৃষ্ট হৃদরোগ-সংক্রান্ত জটিলতায় সারা বিশ্বজুড়ে শুধু ২০১০ সালেই ঘটেছে ৩.৪ মিলিয়ন মৃত্যু। বিশেষজ্ঞরা জানান, বেশিমাত্রায় উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাদ্যগ্রহণ এবং তুলনামূলক কম শারীরিক পরিশ্রমই পৃথিবীজুড়ে মেদবহুলতার অন্যতম প্রধান কারণ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক এসোসিয়েশনের সভাপতি প্রফেসর ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, মাত্রাতিরিক্ত চিনি ও ক্যালরিসমৃদ্ধ ফাস্টফুড ও কোমল পানীয়ের প্রতি শিশু-কিশোরদের আসক্তির ফলেই বাড়ছে তাদের মেদস্থূলতার হার। কিন্তু সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট কোনো দিক থেকেই নেই কোনো সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা। অন্যদিকে ক্রমশ কমছে শিশুদের যে-কোনো ধরনের পরিশ্রম ও খেলাধুলা করার সুযোগ, এমনকি অধিকাংশ স্কুলেই নেই কোনো খেলার মাঠ।
আইসিডিডিআর,বি-র সহযোগী বিজ্ঞানী ও গবেষক ড. আলিয়া নাহিদ পরামর্শ দেন-স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও সুস্থ খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে স্কুলগুলোতে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দেয়াটা খুব জরুরি। আর শহরবাসীদের খেলাধুলা ও পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রমের অভ্যাস করতে হবে। এটি বিভিন্নভাবে হতে পারে, যেমন : শহরের রাস্তাগুলোর এক পাশে সাইকেলের একটি লেন থাকতে পারে, যা নাগরিকদের শারীরিক পরিশ্রমে উদ্বুদ্ধ করবে।
তিনি এসব ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, শুধু উন্নত দেশগুলোতেই নয়, এর পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও সমানে বাড়ছে মেদবহুলতার হার। আর দেহের অতিরিক্ত ওজনের ফলে নানাভাবে বাড়ে অসংক্রামক ব্যাধির (হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি) সম্ভাবনা।
তাই আমাদের সচেতন হওয়ার সময় এখনই। মেদস্থূলতা এবং এ-সংক্রান্ত রোগ-ব্যাধি জটিলতা প্রতিরোধে ভুল খাদ্যাভ্যাস ও অপরিমিত জীবনযাপনের বদলে চাই বৈজ্ঞানিক খাদ্যাভ্যাস ও পরিশ্রমঋদ্ধ সুস্থ জীবনাচার।
তথ্যসূত্র : দ্য ডেইলি স্টার, ২১ মার্চ ২০১৫
ভোজনরসিক হবেন না। শুধু খিদে লাগলেই খাবেন। কিছুটা খিদে রেখেই খাওয়া শেষ করবেন।
(তথ্যসূত্র : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)
অঞ্চলভেদে অতিরিক্ত ওজন ও মেদস্থুলতার হার |
||
শহর |
মা (%) |
শিশু (%) |
ঢাকা |
৫৭ |
২২ |
চট্টগ্রাম |
৬৪ |
১৩ |
সিলেট |
৫৭ |
১৯ |
বরিশাল |
৫৫ |
১৭ |
খুলনা |
৫৫ |
১৫ |
রাজশাহী |
৪৩ |
১০ |
রংপুর |
৩৫ |
৭ |
তথ্যসূত্র : আইসিডিডিআর, বি |