ফাস্টফুড ॥ ধেয়ে আসছে স্বাস্থ্য-বিপর্যয়

স্বাস্থ্যঘাতী ফাস্টফুড

গত কয়েক দশকেরও বেশি সময় ধরে পাশ্চাত্যে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে চলেছে খাদ্য-সংশ্লিষ্ট রোগের প্রকোপ। বিস্তার ঘটেছে জানা-অজানা খাদ্যবাহিত জীবাণুর। মাত্রাতিরিক্ত ওজনের হার বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। স্থুলতা থেকে উদ্ভূত সমস্যা নিরসনে ব্যয় হচ্ছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসবের নেপথ্যে রয়েছে রসনা তৃপ্তিদায়ক ফাস্টফুড-এর উত্থান। বিশ্বজুড়ে যার আরেক নাম ‘জাংক ফুড’।

যুক্তরাষ্ট্রে দিনে প্রায় দুই লাখ মানুষ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়। সে দেশের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)-এর হিসাব মতে, প্রতিবছর এক-চতুর্থাংশেরও বেশি আমেরিকান ফুড পয়জনিং-এর শিকার হন, যার অধিকাংশই কর্তৃপক্ষের গোচরে আসে না এবং যথাযথভাবে রোগনির্ণয়ও হয় না প্রায়শই। দু-একটা যা-ও হয়, সেটি প্রকৃত সংখ্যার নগণ্য অংশ মাত্র।

গত কয়েক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে খাদ্য-সংশ্লিষ্ট রোগের প্রকোপই শুধু বাড়ে নি, এ রোগগুলো শরীরে মারাত্মক ও দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিও করছে। খাদ্যে বিষক্রিয়ার প্রাথমিক অবস্থায় ডায়রিয়া ও পেটের পীড়া দেখা দেয় কিন্তু চরম পর্যায়ে এটি গুরুতর সংক্রামক ব্যাধিও ডেকে আনতে পারে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক খাদ্যবাহিত জীবাণু হৃদরোগ, কিডনি-বৈকল্য, স্নায়বিক জটিলতা, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করাসহ নানারকম দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

পুরো বিষয়টি আমাদের জন্যেও বয়ে আনছে সতর্কবার্তা। কারণ, পশ্চিমা ফাস্টফুড সংস্কৃতি এখন দেশের শুধু উচ্চবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, দ্রুত গতিতে এর বিস্তার ঘটেছে পুরো সমাজেই।

বার্গার ॥ খাবেন কিনা নিজেই সিদ্ধান্ত নিন

ফাস্টফুড বলতেই সবার আগে যে খাবারটি মনের চোখে ভেসে ওঠে, সেটি বার্গার। প্রতিদিন বেশ মজা করে বার্গার কিংবা মাংসের কিমা দিয়ে তৈরি মজাদার ফাস্টফুড খাচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু বার্গারের মাঝখানে থাকা ‘নির্দোষ’ মাংসের চপটিতে যদি গবাদি পশুর কিছু কাঁচা বিষ্ঠাও থাকে, তবে অবাক হওয়ার কিছু নেই। শুনুন তাহলে-

আমেরিকার সবচেয়ে নামী ব্র্যান্ডের ফাস্টফুডের কথাই ধরা যাক। সেখানে একটি বিফ বার্গারে যে মাংসের কিমা থাকে, তা কমপক্ষে এক ডজন গরু এবং কখনো কখনো শ-খানেক গরুর মেশানো মাংস থেকে বানানো। এসব গরু আবার একাধিক দেশ থেকে সংগৃহীত। এই কিমার সামান্য কণামাত্রও যদি ‘ই কলাই’ জীবাণু দ্বারা দূষিত হয় তাহলে আপনি অসুস্থ তো হবেনই, তা আপনার মৃত্যুরও কারণ হতে পারে।

‘ই কলাই’ হলো রোগ-সৃষ্টিকারী মারাত্মক একটি জীবাণু। যুক্তরাষ্ট্রে এটি ছড়ানোর প্রধান উৎস তাদের বড় বড় কসাইখানাগুলো, যেখানে শ্রমিকেরা যান্ত্রিক ছুরি ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতির মাধ্যমে পশু জবাই থেকে শুরু করে মাংস প্যাকেট করার কাজগুলো করে থাকে। আর মাংস প্রক্রিয়াজাত করার সময় এর সাথে মিশে যায় গবাদি পশুর বর্জ্যে বা গোবরে থাকা জীবাণুও।

যে গবাদি পশুর মাংস থেকে কিমা বানানো হচ্ছে, তারা কী খায় জানেন? ইউরোপ-আমেরিকাতে গবাদি পশু মাত্রই অন্য মৃত পশুর (শূকর কুকুর বেড়াল ইত্যাদি) প্রক্রিয়াজাত বর্জ্য ও অন্যান্য পশুভিত্তিক উপদ্রব্য (বাই প্রোডাক্ট) খেয়ে বাঁচে। এ-ছাড়া করাতগুঁড়ো ও পুরনো কাগজের মণ্ডও এদের খেতে দেয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, ১৯৯৭ সালের আগপর্যন্ত সে দেশে সরাসরি মৃত গবাদি পশুই খেতে দেয়া হতো নিয়মিতভাবে। বৃটেনে এ কারণেই ‘ম্যাড কাউ ডিজিজ’ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে পশুখাদ্য হিসেবে মৃত গবাদি খাওয়ানো নিষিদ্ধ হয়। তারপরও ওখানকার বড় বড় কসাইখানাগুলোতে যত গবাদি পশু দৈনিক জবাই করা হচ্ছে, তার অনেকগুলোই হাম ও ফিতাকৃমি রোগে আক্রান্ত। আর যে বিশাল মিশ্রণযন্ত্রে এসব মাংস পেষণ করা হয়, তাতে হরহামেশাই মাংসের সঙ্গে পোকামাকড়, আবর্জনা, মানুষের ঘাম এমনকি কখনো কখনো বমি পর্যন্ত গুলে একসঙ্গে বেরিয়ে আসে!

কোনো হরর সিনেমার চিত্রনাট্য নয় কিন্তু এগুলো। রীতিমতো ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত সত্য। মার্কিন সাংবাদিক এরিক শ্লোজার টানা তিন বছর গবেষণা ও অনুসন্ধান চালিয়ে একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ লিখেছেন-‘ফাস্টফুড নেশন’। ২০০২ সালে প্রকাশিত এ বইটিতে তিনি এসব তথ্য তাবৎ সূত্রসহ সবিস্তারে তুলে ধরেছেন, যা সবার সামনে উন্মোচন করে দিয়েছে আমেরিকার খাদ্যব্যবসার এক আশ্চর্য অন্ধকার দিক।

যুক্তরাষ্ট্রের ডজনখানেক কসাইখানা ঘুরে শ্লোজারের অভিমত হলো, গবাদি পশু জবাইয়ের পর তার চামড়া ছাড়ানো হয় যন্ত্র দিয়ে, কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই সে চামড়া নিখুঁতভাবে ছাড়ানো হয় না বলে কিমার জন্যে প্রস্তুতকৃত মাংসের ভেতর চামড়া, কাদামাটি ও কাঁচা বিষ্ঠা (!) নিয়মিতভাবেই ঢুকে পড়ে। আর পশুর পেট ও নাড়িভুঁড়ি পরিষ্কার করা হয় হাত দিয়ে।

মজার ব্যাপার হলো, যেসব শ্রমিক এসব কসাইখানায় কাজ করে তাদের অধিকাংশই অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত অতি নিম্ন বেতনভোগী ইমিগ্র্যান্ট। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বালাই তাদের অধিকাংশেরই নেই। হাত দিয়ে ছাড়াতে গিয়ে তারা অনেক সময়ই পশুর নাড়িভুঁড়ি এবং বিষ্ঠা মাংসের সঙ্গে গ্রাইন্ডারে ছুঁড়ে দেয়। কারণ, প্রত্যেক শ্রমিককেই অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ঘণ্টায় গড়ে ৬০টি পশুর মাংস কেটেছেঁটে গ্রাইন্ডারে ফেলতে হয়। এসময় মাংসের সঙ্গে আর কী কী ঢুকে পড়ছে, তার হিসাব রাখছে কে?

শ্লোজারের হিসাবে, যদি শুধু একটি মাত্র পশু থেকে দূষিত পদার্থ গ্রাইন্ডারে ঢুকে পড়ে, তাতেও বিপুল পরিমাণ কিমা দূষিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দলাইমলাই হয়ে সেই মাংস যখন বার্গারের কিমা হয়ে দোকানে হাজির হয়, তখন এর কোনটা দূষিত আর কোনটা স্বাভাবিক, সেটি বোঝার ক্ষমতা ওই শ্রমিকেরও নেই। কারণ, ততক্ষণে ওই বস্তুটি উচ্চ তাপে ভাজা (ডিপ ফ্রাই) ও সুগন্ধি ফ্লেভার দ্বারা ‘ধন্য’ হওয়ার মতো বেশ কয়েকটি পর্ব পেরিয়ে এসেছে। তখন এর ভেতরে ‘অন্যরকম কিছু’-র অস্তিত্ব টের পাওয়ার সাধ্য আছে কার?

আমেরিকাতে বড় আকারের একেকটি মিট প্রসেসিং প্ল্যান্টে দৈনিক কমপক্ষে আট লাখ পাউন্ড কিমা তৈরি হয়। যদি একটি ‘ই কলাই’ জীবাণু আক্রান্ত পশুর মাংসও সেই কিমায় থাকে, তাহলে এর দ্বারা অন্ততপক্ষে ৩২ হাজার পাউন্ড কিমা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সংশ্লিষ্টদের মতে, হ্যামবার্গার কিংবা মাংস দিয়ে তৈরি ফাস্টফুড খেয়ে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার প্রধানতম কারণ হলো মাংসে লেগে থাকা জীবাণুবাহী গোবর বা বর্জ্য, যাতে থাকে এই ‘ই কলাই’ নামক জীবাণুটি। এটি ছাড়াও গত দুই দশকে চিকিৎসকরা আরো প্রায় ডজনখানেক খাদ্যবাহিত জীবাণুর সন্ধান পেয়েছেন। সিডিসি অনুমান করছে, তিন-চতুর্থাংশ খাদ্যবাহিত বা খাদ্য-সংশ্লিষ্ট অসুস্থতা ও মৃত্যুর কারণই হচ্ছে এসব সংক্রামক জীবাণু, যেগুলোকে এখনো পুরোপুরি চিহ্নিত করা যায় নি।

বিপদটা যে শুধু ফাস্টফুড-শপে বার্গার খেতে গিয়েই ঘটতে পারে, তা নয়। কেতাদুরস্ত সুপার মার্কেট থেকে সুদৃশ্য প্যাকেটে মোড়া গরু বা মুরগির কিমা ঘরে আনলেও ঘটতে পারে একই বিপদ। দুটোই দূষিত হওয়ার সম্ভাবনা সমান। আর এসব দূষিত খাবার খেয়ে আমেরিকায় প্রতিদিন দুই লাখেরও বেশি মানুষ রোগগ্রস্ত হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে নয় হাজার রোগী। এদের মধ্যে দৈনিক মারা যাচ্ছে ১৪ জন। যারা অসুস্থ হচ্ছে বা মারা যাচ্ছে তাদের একটা বড় অংশ হচ্ছে স্কুলের ছাত্রছাত্রী অর্থাৎ শিশু-কিশোর।

ফাস্টফুড নিয়ে এমন আশ্চর্য সব খবর আর এর পরিণতি জানা সত্ত্বেও আমেরিকায় সরকারিভাবে তা নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। কিংবা বলা যেতে পারে, নেয়া যাচ্ছে না। কেননা, আমেরিকাতে ফাস্টফুড ইন্ডাস্ট্রি এখন এক বিশাল সাম্রাজ্য। মোট এক ডজন বহুজাতিক কর্পোরেশন এ সাম্রাজ্যের নেপথ্য নিয়ন্ত্রক। আসল খবর হলো, এ শিল্পের সাথে নানাভাবে অতি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ (নাকি স্বার্থযোগ?) রয়েছে সে দেশের রাজনৈতিক ও সরকারি ব্যবস্থাপনার। এ যেন ফাস্টফুড সাম্রাজ্যবাদ!

এসব কিন্তু আমেরিকার নামীদামী ব্র্যান্ডের ফাস্টফুডের কেচ্ছাকাহিনী, তা-ও কেবল এখন পর্যন্ত যেটুকু জানা গেছে। এর বাইরে যে আরো কী ঘটে চলেছে, তাই-বা কে জানে! খোদ আমেরিকার মতো দেশ-যেখানে সবকিছুর মান নিয়ন্ত্রণে এত কড়াকড়ি আর বিধিনিষেধ- সেখানেই যদি ঘটে চলে এমনতর সব কাণ্ডকীর্তি, তখন আমাদের দেশে কী হচ্ছে... থাক্।

‌আর এর সাথে ইদানীং যুক্ত হয়েছে কিছু বহুজাতিক চেইন ফাস্টফুড রেস্টুরেন্টের মনোহরী চিত্তজয়ী বিজ্ঞাপন। যেমন, আমাদের তৈরি সুস্বাদু খাবারে ব্যবহার করা হয়েছে কিছু ‘হিডেন স্পাইসেস’। অর্থাৎ গোপন মশলাপাতি। কিন্তু কেন এ গোপনীয়তা? ওসবের নাম জানলে স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে আপনি খাবারগুলো না-ও খেতে পারেন, তাই? এ কারণেই কি এমন নাটকীয় প্রলোভন?

বার্গারের আছে আরো বিস্ময়কর ‘গুণ’। বোস্টনের প্রখ্যাত ডানা-ফার্বার ক্যান্সার গবেষণা কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের অন্যতম সহযোগী প্রতিষ্ঠান। গত দশকের শুরুর দিকে দীর্ঘ গবেষণার পর তারা মানবদেহে একটি আণবিক উপাদানের সন্ধান পান। পিজিসি-১ বিটা। লিভারে সংঘটিত শরীরের স্বাভাবিক বিপাকক্রিয়ায় এর ভূমিকা রয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগের কথা হলো, এটি বার্গারের ফ্যাটকে সরাসরি ধমনীতে ব্লকেজ সৃষ্টি করতে বিশেষভাবে উদ্দীপ্ত করে।

গবেষকরা দেখেছেন, যখন মাংস ও ডেইরি প্রোডাক্টসহ বিভিন্ন খাদ্যের স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ট্রান্স ফ্যাট লিভারে হাজির হয় তখন পিজিসি-১ বিটা এক ধরনের বায়োকেমিক্যাল সংকেতের প্রবাহ সৃষ্টি করে চলে, যা লিভারকে এলডিএল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড উৎপন্ন করতে প্ররোচিত করে। উল্লেখ্য, এ দুটো উপাদানের মাত্রাধিক্য ধমনীতে ব্লকেজ সৃষ্টি করে, যা পরবর্তীতে হার্ট অ্যাটাকের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

গবেষকদের মতে, বার্গারের মতো অন্যান্য যেসব খাবারে স্যাচুরেটেড এবং ট্রান্স ফ্যাট আছে সেসব খাবার খেলেও রক্তে এলডিএলের মাত্রা বাড়বেই। আর ফাস্টফুড বলতে আমরা যা বুঝি তার সবকটিতেই স্যাচুরেটেড এবং ট্রান্স ফ্যাটের অস্তিত্ব আছে বেশ ভালো রকমেই।

ফ্লেভার : আসল রহস্য এখানেই

খাবারের ধরন হিসেবে ফাস্টফুড হলো প্রক্রিয়াজাত খাবার। আর প্রক্রিয়াজাত করতে গিয়ে খাবারের আসল স্বাদ ও গন্ধ হারিয়ে যায়। তাই কৃত্রিম ফ্লেভার দিয়ে স্বাদ-গন্ধ আসলের মতো রাখা হয়। এসব ফ্লেভারগুলো এতটাই শক্তিশালী যে, বলা হচ্ছে, একটা শুকনো কাঠকেও কেবল ফ্লেভার দিয়েই সুস্বাদু করে তোলা সম্ভব।

সন্দেহজনক বিষয় হচ্ছে, ফ্লেভার-শিল্পকে রাখা হয় খুবই গোপনীয়তার ভেতর। এজন্যে দেখা যায়, ফাস্টফুড পণ্যের নাম কিংবা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের নাম মানুষের মুখে-ঠোঁটে মুখস্থ থাকলেও এসব ফ্লেভার কারা তৈরি করে, সে বিষয়ে কেউই কিছু জানে না। বহুল প্রচলিত ব্র্যান্ডের সুনাম রক্ষার জন্যেই এ ধরনের গোপনীয়তা অত্যন্ত জরুরি। রেস্তোরাঁগুলো ক্রেতাদের এমন ধারণা দিতে চায় যেন খাবারের পুরো স্বাদটি তাদের রান্নাঘরেই তৈরি হয়েছে।

এ-ছাড়াও স্বাদ বৃদ্ধির জন্যে ফাস্টফুডে আরেকটি উপাদান ব্যবহার করা হয় হরদম। টেস্টিং-সল্ট। এর ভয়াবহতা ইতোমধ্যে সচেতন মানুষ মাত্রেরই জানা। প্রায় সব ধরনের ফাস্টফুডেই এটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

বাড়ছে স্থূলতা আর জীবনঘাতী রোগব্যাধি

পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চিকিৎসা-ব্যয়

ফাস্টফুডের বিকাশের সাথে সমান তালে বাড়ছে স্থূলতা। আর যে-কোনো শিল্পোন্নত দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে স্থূলতার হার অনেক বেশি। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ৬০-এর দশকে স্থূলতার যে হার ছিল সেটা এখন বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। আর শিশুদের ক্ষেত্রে এ হার ১৯৭০-এর চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। অর্থাৎ শিশুদের মধ্যে স্থূলতার হার প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় বাড়ছে আরো দ্রুত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক ইতিহাসে আমেরিকানরাই একমাত্র জাতি যারা এত দ্রুত এত মোটা হয়েছে। সিডিসি-র সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকার প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে লিঙ্গ বর্ণ বয়স শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্বিশেষে গণহারে সবার মধ্যে স্থূলতা বাড়ছে। ১৯৯১-এ ১৫% বা তার বেশি স্থূলতার হার ছিল মাত্র চারটি অঙ্গরাজ্যে। আর বর্তমানে এ সংখ্যা ৩৭টি অঙ্গরাজ্য ছাড়িয়ে গেছে।

স্থূলতার এমন হঠাৎ-বৃদ্ধির পেছনে কোনো জিনগত কারণ নেই। আমেরিকানদের জিন গত কয়েক দশকে রাতারাতি পাল্টেও যায় নি। পাল্টেছে তাদের খাওয়া এবং জীবনযাত্রার ধরন। কমেছে শারীরিক পরিশ্রম, বেড়েছে খাদ্যতালিকায় চর্বিজাত ও উচ্চ ফ্যাটযুক্ত খাবারের পরিমাণ। আর এসব খাবার সব জায়গায় এমন সহজলভ্য ও সুলভ হয়েছে ফাস্টফুড-শিল্পের আগ্রাসী বিকাশের ফলে।

ফাস্টফুডের প্রায় অপরিহার্য অংশ কোমল পানীয়ের উত্থান দেখলেই এর বিকাশ বোঝা যায়। গত চার দশকে কোমল পানীয় গ্রহণের পরিমাণ ওখানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে চারগুণেরও বেশি। অন্যদিকে স্বাস্থ্যকর খাবার প্রচলনের একাধিক উদ্যোগ কয়েকবারই ব্যর্থ হয়েছে। এর মূল কারণ, স্বাস্থ্যকর খাদ্যতালিকায় ফ্যাটের পরিমাণ কম। আর ছোটবেলা থেকেই ফ্যাটযুক্ত খাবারে রুচি ও আগ্রহ তৈরি হয়ে যাওয়ায় পরবর্তীতে সেটি ত্যাগ করা কঠিন হয়ে পড়ে বৈকি।

সিডিসি-র ধারণা অনুযায়ী, স্থূলতা থেকে সৃষ্ট নানা শারীরিক সমস্যা মোকাবেলায় আমেরিকানরা প্রতিবছর ব্যয় করে প্রায় ২৪ হাজার কোটি ডলার। হৃদরোগ, কোলন (মলাশয়) ক্যান্সার, পাকস্থলীর ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, স্ট্রোক, এমনকি বন্ধ্যাত্বের সাথে মেদস্থূলতার সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৯৯ সালে আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, অতিরিক্ত ওজনধারীদের মধ্যে প্রি-ম্যাচিউর ডেথ বা অকালমৃত্যুর হার অনেক বেশি। স্বাভাবিক ওজনধারীদের তুলনায় সেটি হতে পারে দ্বিগুণ থেকে চারগুণ পর্যন্ত বেশি।

স্থূলতার ‘মহামারি’ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন দেশে। বিস্ময়কর ব্যাপার, সত্তরের দশকের গোড়ায় আমেরিকার চেইন ফাস্টফুড শপ ম্যাকডোনাল্ডস জাপানে তাদের শাখা চালু করে, তারপর জাপানিদের অবস্থাও হতে শুরু করে আমেরিকানদের মতোই। পরবর্তী এক দশক না পেরোতেই জাপানে ফাস্টফুড খাওয়ার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় দ্বিগুণ-এ। সেইসাথে দ্বিগুণ হয়ে যায় শিশুদের স্থূলতার হারও। কারণ, ফাস্টফুড একবার খাওয়া শুরু করলে ছাড়া কঠিন। দিন দিন বাড়তেই থাকে এর আসক্তি। প্রমাণ খোদ আমেরিকানরাই। ফাস্টফুডের পেছনে ১৯৭০ সালে তাদের খরচ ছিল ছয়শ কোটি ডলার। ২০০১ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার কোটি ডলারে।

ফাস্টফুডে বুদ্ধিনাশ!

সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয়টি হচ্ছে, ফাস্টফুড শিশুর আইকিউ দুর্বল করে দিতে পারে। বিশেষত বয়স তিন বছর হওয়ার আগে থেকেই যেসব শিশু চিপ্স পিৎজা বিস্কিট বার্গার ইত্যাদি খেতে শুরু করে, তাদের আইকিউ দুর্বল হয়ে পড়ে। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত একটি গবেষণায় এর প্রমাণ পেয়েছেন একদল ব্রিটিশ গবেষক। ২০১০ সালে এ গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় এপিডেমিওলজি এন্ড কমিউনিটি হেলথ জার্নালে।

তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সী চার হাজার স্কটিশ শিশুর ওপর চালানো এ গবেষণার ফলাফলে বিজ্ঞানীরা বলেন, ফাস্টফুড খাওয়ার ফলে শিশুর মস্তিষ্কের ক্ষমতা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অন্যদিকে একই বয়সী যেসব শিশুকে ফলমূল ও শাক-সব্জিসহ ঘরে তৈরি তাজা পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো হয়, তাদের সঙ্গে ফাস্টফুড খাওয়া শিশুর আইকিউ-র ব্যবধান হতে পারে পাঁচ পয়েন্ট পর্যন্ত। গবেষকদের মতে, তিন বছর বয়সের আগে যেসব শিশু প্রচুর পরিমাণ ফাস্টফুড খায় পরবর্তীতে তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন ঘটালেও আইকিউ-র কোনো উন্নতি হয় না। তারা বলেন, একটি শিশুর জন্যে প্রথম তিন বছর পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় মস্তিষ্ক সবচেয়ে দ্রুত বাড়ে। তাদের মতে, যেসব শিশু ওই বয়সে চর্বি ও চিনিযুক্ত এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি খায়, তারা প্রয়োজন অনুযায়ী ভিটামিন ও পুষ্টি পায় না।

তাই এ বিষয়ে আমাদের আশু সচেতনতা জরুরি। একটি সুস্থ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যদি আমরা চাই। নিজেরা সচেতন হওয়ার পাশাপাশি এখন সময় এসেছে এ নিয়ে কথা বলার, সোচ্চার হওয়ার এবং ফাস্টফুডের ক্ষতিকর দিকগুলো সবার সামনে দৃঢ়তার সাথে তুলে ধরে সবাইকে সচেতন করার। কারণ, শারীরিকভাবে অসুস্থ একটি উত্তরপ্রজন্মের কাছ থেকে আমরা কখনো সুস্থ ও সমৃদ্ধ জাতি আশা করতে পারি না।

আমাদের ঘুম ভাঙবে কবে?

সঠিক খাদ্যাভ্যাস সম্বন্ধে যথাযথ জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গির অভাব এবং অবাধ বিজ্ঞাপনের প্রসার আমাদের দেশেও সবাইকে উৎসাহিত করছে পাশ্চাত্যের মতো বেশি বেশি ফাস্টফুড খেতে। উচ্চবিত্ত আর উচ্চ-মধ্যবিত্তই কেবল নয়, সাধারণ পরিবারগুলোর সন্তানেরা এমনকি পরিবারের সব বয়সী সদস্যরাও দ্রুত অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন এসব খাবারে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকালে এর ভয়াবহ পরিণতি আঁচ করা তেমন কঠিন কিছু নয়। ফাস্টফুড থেকে সৃষ্ট স্বাস্থ্য-জটিলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ওরা না হয় নিমেষেই খরচ করতে পারছে হাজার হাজার কোটি ডলার, কিন্তু আমাদের সে সুযোগ কোথায়?

তাই একমাত্র সচেতনতাই পারে এই সম্ভাব্য দুর্গতি থেকে আমাদের মুক্তি দিতে। এজন্যে চাই শুধু আমাদের ইচ্ছা। কারণ, ফাস্টফুডে উপকার বলে কিছু নেই বরং ক্ষতি অনেক। আমরা নিজেরা এসব না খাওয়া, আপ্যায়নের বেলায় এগুলো বর্জন করা এবং সর্বোপরি পরিবারে সমাজে সবাইকে সচেতন করে তোলাটাই এখন কর্তব্য। এ প্রসঙ্গে দেশের বিশিষ্ট চিকিৎসক বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি প্রফেসর ডা. এ কে আজাদ খান তার একটি নিবন্ধে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন-‘আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের এই ক্ষতিকর অবস্থা থেকে বাঁচাতে এখনই সচেতন হওয়া দরকার। এজন্যে প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে এই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। ভবিষ্যতে একটি সুস্থ জাতি উপহার দিতে হলে আমাদের এখন থেকেই উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।’

তথ্যসূত্র : মার্কিন সাংবাদিক এরিক শ্লোজার-এর আলোচিত গ্রন্থ ‘ফাস্টফুড নেশন’

           ডেইলি মেইল অনলাইন

           টাইম ম্যাগাজিন (২১ আগস্ট ও ৬ অক্টোবর, ২০০৯)