published : ২৭ জুন ২০২৩
ঈদ- ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জীবনে আনন্দ বয়ে আনে বছরে দুই ধর্মীয় উৎসব। কিন্তু নিজে আনন্দ করার, পরিবার প্রিয়জন আত্মীয়-প্রতিবেশীদের সাথে আনন্দ ভাগ করার, অভাবীর মুখে হাসি ফোটাবার উপলক্ষ ঈদ যেন অর্থ হারিয়েছে অনেকের জীবনে কিছু ভুল কাজ বা অপসংস্কৃতির কারণে।
ঈদকে ঘিরে এমন কিছু অপসংস্কৃতি:
ঈদ সালামি হিসেবে অর্থ আদায় একটি বহুল প্রচলিত অপসংস্কৃতি; এক প্রকার জুলুমও। তাই ঈদ সালামি দেয়া ও নেয়ার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসুন। পাশাপাশি এ-ব্যাপারে পরিচিতদের সচেতন করুন এবং শিশু-কিশোরদের নিরুৎসাহিত করুন।
কারণ সালামির নামে শিশুদের হাতে টাকা চলে গেলে আপনার শিশু লোভী ও অপচয়কারী হয়ে বেড়ে উঠতে পারে।
ওদের জন্যে সালামির চেয়ে অনেক বেশি কল্যাণকর আপনার শুভকামনা ও দোয়া। ঈদ উপলক্ষে প্রিয়জনকে উপহারসামগ্রী আপনি দিতেই পারেন; তবে তা অবশ্যই অপরপক্ষের প্রয়োজন ও আপনার সামর্থ্যের মধ্যে থেকে।
শহরে কিংবা গ্রামে ঈদ ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে ফুটতে থাকে আতশবাজিসহ বিভিন্ন ধরণের পটকা বাজি। চোখ ধাঁধানো আলো আর কান ফাটানো শব্দে কিছু মানুষ আনন্দ পেলেও বৃহৎ পরিসরে নানান ক্ষতির কারণ হয় এসব বাজি।
আপনার ক্ষণিকের আনন্দ কারণ হতে পারে বড় ক্ষতির (ছবিসূত্র- www.jagonews24.com)
সব রকম আলোর বাজিতেই রয়েছে বিষ। যেমন, যেসব বাজি পুড়লে সাদা আলো হয়, তাতে সাধারণত অ্যালুমিনিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যাডমিয়াম বা টাইনেনিয়ামের যৌগ থাকে। কমলা আলোয় ব্যবহার করা হয় লোহা ও বিভিন্ন ধরনের কার্বনেট যৌগ; হলুদ আলোর জন্যে সোডিয়াম; নীল আলোর জন্যে তামা, লাল আলোর জন্যে স্ট্রোনসিয়াম যৌগ। এ ছাড়াও, কমবেশি সীসা থাকে অধিকাংশ বাজিতেই।
বিষাক্ত এই রাসায়নিক পদার্থগুলোর প্রতিটিই শরীরের জটিল রোগের কারণ হয়ে উঠতে পারে- বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাছাড়া, পটকা বাজি ফোটার সময় যে তীব্র শব্দ উৎপন্ন হয় তাতে ঘুমে ব্যাঘাত ও অস্বস্তি হয়; ফেটে যেতে পারে কানের পর্দাও। এমনকি বাজির শব্দে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে শিশুমৃত্যুর ঘটনাও দেশে ঘটেছে।
সবচেয়ে বড় কথা, খরচের কথা চিন্তা করলে বাজি পোড়ানোর মাধ্যমে আপনি আসলে পোড়াচ্ছেন টাকা!
ঈদ বিনোদনের নামে ৫/৭/১০ দিনব্যাপী ঈদ আয়োজনে ভরপুর থাকে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। অনুষ্ঠানগুলো এমন চক্রাকারে সাজানো যে আপনি এসব দেখে টানা এতগুলো দিন অনায়েসেই কাটাতে পারবেন। সময় অপচয়ের পাশাপাশি এসব অনুষ্ঠানের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে মনের ওপরও। টানা ঘরবন্দী, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তার শারীরবৃত্তীয় ক্ষতি তো আছেই।
দেখা গেছে, ঈদের পর অধিকাংশ কর্মজীবীরাই বিরক্তি নিয়ে প্রথম কর্মদিবস পার করেন। এর মূল কারণ তারা ছুটি কাটিয়েছেন টিভির সাথে, পরিবারের সাথে নয়।
ঈদ এলেই অনেকে ঝাঁপিয়ে পড়েন কেনাকাটায়। স্মার্টফোন টিভি ফ্রিজ ইত্যাদি ভোগ্যপণ্যে ‘ফাটাফাটি মূল্যহ্রাস’এর ‘ধামাকা অফারে’ চলে কেনার অসুস্থ প্রতিযোগিতা। সীমিত আয়ের মানুষ, বিশেষত চাকুরিজীবীরা তাদের ঈদ বোনাসের টাকাটাই শুধু খরচ করে ফেলে না, ০% ইএমআই-এর টোপে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন কেউ কেউ।
কিছুদিন হাতে রেখে কেনাকাটা করলে ঈদের আগে এই ভিড় এড়াতে পারবেন (ছবিসূত্র-The Business Standard)
আবার এক শ্রেণীর মানুষ, যাদের হাতে আছে অঢেল টাকা, কেনাকাটার জন্যে যান দেশের বাইরে। দেখা যায় দেশে উৎপাদিত পণ্যই তারা কয়েকগুণ দাম দিয়ে কিনে আনছে বিদেশ থেকে!
অথচ পরিমিত ব্যায়ের মাধ্যমে অর্থ সাশ্রয় করে দরিদ্র আত্মীয়-প্রতিবেশী ও অভাবীদের মুখে হাসি ফোটানোর মধ্যেই রয়েছে ঈদ আনন্দের সার্থকতা।
কয়েক বছর ধরেই ‘অনলাইন কোরবানি’ এক নতুন ফ্যাশন! যা নষ্ট করছে ধর্মীয় সংস্কৃতিকে।
ঈদুল আজহা হলো আত্মত্যাগের উপলক্ষ। কষ্টার্জিত অর্থে দেখেশুনে পছন্দ করে পশু কিনে কোরবানি করার মাধ্যমে আমরা আসলে আমাদের পশুসত্ত্বাকেই কোরবানি দেই। কাজেই প্রক্রিয়াটা হতে হবে ধর্মীয় রীতি অনুসরণ করে।
বোখারী শরীফের একটি হাদিসমতে, নবীজী (স) কোরবানির পশু নিজেই জবেহ করতেন। অনলাইনে আপনার নামে যে পশুটি কোরবানি হবে, না আপনি তার বৈশিষ্টগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছেন, না পারছেন নবীজীর (স) দেখানো পদ্ধতিটি অনুসরণ করে কোরবানি করতে।
তাছাড়া, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ হিসাব করে সেটার ওজন এবং কতটা মাংস পাওয়া যাবে- স্রেফ এই বিবেচনায় দরদাম করে পশু ক্রয়ে কোরবানি ব্যাপারটা ‘স্রষ্টার সন্তুষ্টির নিয়তে ত্যাগ’ থেকে পর্যবসিত হচ্ছে স্রেফ ‘মাংস আহরণে!’
ঈদের ছুটি আমাদের সুযোগ করে দেয় সামাজিকভাবে একাত্ম হওয়ার। অনেকেই অপেক্ষা করে থাকেন প্রিয়জন দীর্ঘ বিরতির পর ঘরে ফিরবে বলে। আমাদের সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় করার এ এক চমৎকার উপলক্ষ। কিন্তু এই চমৎকার উপলক্ষটিই অনেকে এখন নষ্ট করছে ঈদে দেশ-বিদেশে ট্যুরের মাধ্যমে।
ঈদে সরগরম হয়ে ওঠে দেশের ট্যুরিস্ট স্পটগুলো (ছবিসূত্র-সময় টিভি)
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালে ঈদের ছুটিতে দেশের বাইরে গিয়েছেন প্রায় ১০ লাখ মানুষ। দেশের ট্যুরিস্ট স্পট ও রিসোর্টগুলোও জমজমাট হয়ে ওঠে এই সময়টায়। পিছনে পড়ে যায় প্রিয়জনের সান্নিধ্যে পাওয়ার আকুতি।
এই অপসংস্কৃতিগুলোর কবলে যদি আপনি পড়ে থাকেন তাহলে উদ্যোগী হোন এগুলো থেকে বেরিয়ে আসার। তাহলেই ঈদ সবার জন্যে সত্যিকারের সার্থকতা নিয়ে আসবে আপনার জীবনে।