ঈদ : আমার না আমাদের !

খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। আমাদের শহরগুলো তখন মুক্ত ছিল ইমারতের গগণচুম্বী শেকল থেকে। শাওয়ালের বাঁকা চাঁদ উঠত পশ্চিম আকাশের কোণে। সেই চাঁদ দেখতে ছেলেবুড়ো নির্বিশেষে ভিড় করত সবাই। পাড়ার যে ময়দান অথবা যে বাড়ির ছাদ থেকে সবচেয়ে ভালো চাঁদ দেখা যায় সেখানে সবাই একত্রিত হয়ে প্রথম শিহরিত হতো ঈদের আনন্দে! ঈদ!! আহ্ ঈদ!! অপার আনন্দের দিন! ঈদ আর অপূর্ব একফালি চাঁদ সমার্থক হয়ে গিয়েছিল।

সেই কবে থেকে ভাবুন তো ঈদ আমাদের জীবনে এই আনন্দের বার্তা বয়ে নিয়ে আসছে? সেই শৈশব যখন থেকে বুঝতে শিখেছি এই দিনটি মানেই মুক্ত স্বাধীন, সারাদিন শুধু এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে বেড়ানো, ইচ্ছেমতো ভালোমন্দ খাওয়া আর নতুন পোশাক, তখন থেকেই ঈদ শব্দটি শুনলেই আনন্দের অনুরণন।

ঈদে টেলিভিশনে ব্রেকিং নিউজ শুনে তখন কেউ সেমাই রান্নার আয়োজনে যেত না। পাড়া মহল্লাগুলো সেই সন্ধ্যায় যেন জেগে উঠত। বাড়ির ছোট মেয়েটি নামাতো তার ঈদের জামাটি, কেউ দেখে ফেললে পুরোনো হয়ে যাবে এই ভয়ে যা সে লুকিয়ে রেখেছিল বাক্সে। কার বাড়িতে মেহেদী গাছ আছে, কে ভালো মেহেদী পরাতে পারে হাতে, ভিড় লেগে যেত সেখানে। মেহেদী গাছওয়ালা বাড়ির মালিকও শেষ পাতাটি পর্যন্ত দিয়ে দিতেন খুশি মনে। পাড়ার সেই দক্ষ মেয়েটি— যেই আসত গভীর রাত পর্যন্ত তার হাতেই মেহেদী পরিয়ে দিত। পাড়ার ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে হয়তো চলত মুরুব্বীদের সালাম করতে, অগ্রীম ঈদীর বায়না করে রাখা-এই হলো উদ্দেশ্য। বড়রাও খুশি, সবার বাড়ির দ্বার উন্মুক্ত, “এসো এসো সবাই, ঈদের দিনে দ্বিধা কিসের! অগ্রীম দাওয়াত, কাল ঈদের নামায শেষে চলে এসো সবাই”।

ঈদের সকালে তাড়াতাড়ি গোসল, নামাযে যাওয়ার সময় পাশের বাড়ির ভাই না হয় ছেলে সবাইকে হাঁক ডাক দিতে দিতে চলল সবাই নামায পড়তে। ঈদের কোলাকুলি করতে করতে ফেরার পথেই দেখা যেত সব পাড়াপ্রতিবেশীর বাড়িতেই সেমাই খাওয়া শেষ। ঈদের নতুন একটা জামা থাকলেই চলত, একাধিক জামা বা হাল ফ্যাশনের জামাই হতে হবে এই ধারণা ছিল না ততটা। বাড়ির মহিলারা রান্না করতেন সেমাই, পায়েস, পিঠা, মাংস, পোলাও বড়জোর কোরমা। রান্নাও হতো অনেক বেশি করে এত লোক আসবে, খাবে, থালাবাটি ধুতে ধুতেই দিন শেষ মায়েদের। সন্ধ্যার দিকে তারা হয়তো বেরুতেন পাশের বাড়ির ভাবীর সঙ্গে ঈদ মোলাকাত করতে। বাড়ির অন্যরা হয়তো তখন পাড়া বেড়ানো শেষ করে শুরু করেছে আত্মীয় বন্ধুদের বাড়িতে বেড়ানো। রাতে পাড়াপ্রতিবেশীরা একত্রিত হয়ে টিভিতে বড়জোর একটু আনন্দমেলা কি ‘ইত্যাদি’ উপভোগ করা। এই তো ছিল ঈদ, সব ভেদাভেদ ভুলে ঈদের আনন্দে সবাইকে আপন করে নেয়া।

তারপর আমাদের জীবনে হঠাৎই চলে এল এক অদ্ভুত যন্ত্র, নাম তার টেলিভিশন। পরস্পরের হৃদ্যতার বাঁধন ছিঁড়ে সে হয়ে গেল একান্ত আপন। ঈদের দিনটিকেও সে দিল না ছুটি। গগণচুম্বী ইমারতগুলোর ফাঁকে একখন্ড আকাশ নেই মাটি থেকে যেখানে চাঁদ দেখা যাবে, টিভিতে ব্রেকিং নিউজ আর “ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ” গান শুনলেই আমরা প্রস্তুতি নেই ঈদের। টিউব মেহেদী কেনা থাকে আগে, বিউটি পার্লারগুলো বসে থাকে হাতে মেহেদী পরাতে। ঈদে এখন মাসাককলি, আনারকলি অথবা হাশমি পাঞ্জাবী, বাসাবি আর সপার্স ওয়ার্ল্ড এর ভিড়ে কোন জামা ফেলে কোনটা পড়ব কেনাই শেষ হয় না।

মুখোমুখি শুভেচ্ছা বিনিময়! সময় নেই, কি দরকার? আধুনিক ঈদও তার স্বমহিমায় উজ্জ্বল, ডিজিটালিজমের সাথে পাতিয়েছে মিতালী। আছে নেটওয়ার্ক জ্যাম করা এসএমএসের স্রোত। চাঁদ রাত থেকে টিভিতে শুরু হলো ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠানমালা যার বিজ্ঞাপন চলেছে পনের দিন আগে থেকেই। পাড়াপ্রতিবেশীর বাড়ি যাব!! কার বাড়ি যাব আবার, পাশের ফ্ল্যাটে কে আছে চিনিই না তাদের। কি প্রয়োজন? টিভি আছে, আছে মোবাইলের মাধ্যমে দেশজুড়ে কাছে থাকার সুযোগ। থাক বরং নিজে নিজেই ঈদ কাটাই। কিন্তু কিভাবে?

টিভির অনুষ্ঠানসূচী নিয়ে বসা হয় আগেই। আগে থেকেই নির্দিষ্ট করে রাখা কোন চ্যানেলে কী কী দেখব। কারণ চ্যানেল তো অনেক। তারপর শুরু হয় টিভি দেখার পালা। মহিলারা ঘর গুছিয়ে বসে থাকেন, হরেক পদের রান্না কিন্তু পরিমাণে অল্প, কে আসবে অত!! দূরদূরান্ত থেকে আত্মীয়স্বজনরা আসেও না তেমন, টেলিফোনেই সেরে নেয় আন্তরিকতা। এখন আবার নতুন করে নতুন প্রজন্মের ঈদ উদযাপনে যোগ হয়েছে ফেসবুক, মেহেদী পরা হাত ছবি তুলে আপলোড করে দাও ফেসবুকে, পৃথিবীর তাবৎ লোকজন তাতে লাইক দিতে থাকবে, বান্ধবীরা জিজ্ঞেস করতে থাকবে কে সাজিয়েছে এই হাত, রাতে বেকড পাস্তা রান্না করেই তার ছবি দিয়ে দিলেন বন্ধুদের জন্য। ভার্চুয়াল খাওয়াদাওয়া হয়ে গেল! নতুন পাঞ্জাবী দোস্ত, জোশ হইছে! অফুরন্ত অবসর পেয়েছি, এ কদিন ভালো করে চ্যাট করে নেই, না হয় খেলে নেই একটু অনলাইন গেমস।

আর কেউ কেউ আছেন, সামর্থ্য আছে তাই ঈদ উদযাপন করতে চলেই গেলাম দেশের বাইরে। ছুটি পাই না একটুও, এই কটা দিন পেলাম তাও আবার সবাইকে সময় দাও। যাই তার চেয়ে বিদেশ ঘুরে আসি। একটু নিজের মতো করে সময় কাটাই।

আমাদের কোয়ান্টাম পরিবারে কিঞ্চিৎ সুযোগ আছে একটু অন্যমাত্রায় ঈদ পালন করবার। গুরুজীর সাথে ঈদ মোলাকাত অনুষ্ঠানে যাই, তারপর সারাদিন আবারও গাধার বাক্সের সামনে। তবে কেউ কেউ যে এই আমিত্ব ভেঙে এগিয়ে যান নি তা কিন্তু নয়। এইতো গত বছরই কেউ কেউ শুরু করেছেন আত্মীয়পরিজনসহ চারপাশের চল্লিশ ঘরে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়। বহুদিন পর আপনজনদের কাছে যেতে একটু আড়ষ্টতা, তবুও সেই আত্মার টান, টিভি সেটের অফুরন্ত বিজ্ঞাপনের চেয়ে সুমধুর।

রাত এগারটায় হয়তো এক সহকর্মী এসে উপস্থিত- “ঈদে বাসায় কি রান্না হয়েছে ভাই? এই একটু চাখতে এলাম। সবার বাড়ি ঘুরে ঘুরে এই এখন আপনার বাড়ি আসবার সময় পেলাম। দেখি আপ্যায়ন করুন।” এমন একটা সারপ্রাইজ পেলে টিভি সেটের সামনের মানুষগুলো কিন্তু কম খুশি হয় না। ঈদের সত্যিকারের আনন্দবঞ্চিত মানুষগুলোকে আসুন না এবারের ঈদে এমনই সব অভাবিত আনন্দে ভরিয়ে তুলি। নিজের ঈদ আনন্দ তাতে বাড়বে বৈ কমবে না। টিভি সেটটাকে এবার পাশ কাটিয়ে সবাই দেখিই না কেমন হয়!

ঈদ বিষয়ে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি, পালনীয় আচার, নবীজি (স) ও সাহাবীদের ঈদ উদযাপন আর অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো জানতে দেখুন: ঈদ মোলাকাত