published : ১২ এপ্রিল ২০২৫
কোয়ান্টাম মেথড হলো সুস্থতা, সাফল্য ও সুখের ২৮টি সূত্রে গাঁথা একটি টুলবক্স, কম্প্যাক্ট সুইস নাইফের মতোই যা জীবনকে সুন্দর করার জন্যে যে-কোনো সময়, যে-কোনো প্রয়োজনে ব্যবহার করা যেতে পারে। মেডিটেশনের এত বহুমুখী ব্যবহারের কথা কোয়ান্টাম বলছে প্রায় ৩ দশক ধরে।
২৯ নভেম্বর ২০২৪ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সর্বসম্মতিক্রমে ২১ ডিসেম্বরকে ঘোষণা করা হয় বিশ্ব মেডিটেশন দিবস। শারীরিক, মানসিক ও আবেগিকভাবে ভালো থাকার জন্যে মেডিটেশন চর্চার গুরুত্বেরই এ এক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
এই ঘোষণার আগেই কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন ২০২৫ সালকে ঘোষণা করে ‘দ্য ইয়ার অব মেডিটেশন’। এরই প্রেক্ষিতে এই সিরিজ আর্টিকেল, যা মূলত কোয়ান্টাম মেথড বইয়ের আলোচনাগুলোর অ্যাডাপ্টেশন।
DNA-এর পূর্ণরূপ হচ্ছে Deoxyribonucleic Acid. এটি হলো প্রতিটি জীবকোষের কেন্দ্রবিন্দু। সকল প্রাণীর বিকাশের মূলে রয়েছে এই জেনেটিক কোড তথা DNA। যাকে বলতে পারেন চেতনা। মানবদেহে এই ডিএনএ-র কাজের সংখ্যা সাত লক্ষ। একটি সেলের ডিএনএ-তে যে তথ্য রয়েছে তাকে ভাষান্তর করে লিপিবদ্ধ করতে লাগবে এক হাজার খণ্ড বিশ্বকোষ।
মাতৃগর্ভে একটি ডিম্বাণু এবং একটি শুক্রাণুর মিলনের পর ডিম্বাণুর ডিএনএ ও শুক্রাণুর ডিএনএ মিলে সৃষ্টি হয় নতুন ডিএনএ। এই ডিএনএ কোডেই লিপিবদ্ধ হয় নতুন ডিএনএ কীভাবে পর্যায়ক্রমে পূর্ণাঙ্গ মানব-শিশুতে পরিণত হবে এবং ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কীভাবে শরীরের কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
এই ডিএনএ নিজে নিজে ভাগ হয়ে ক্রমাগত জীবকোষের সংখ্যা বৃদ্ধি করে, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি করে। এককথায় ডিএনএ-কে বলা যায় প্রাণের ব্লু-প্রিন্ট।
ধরুন আপনি বাজার থেকে একটি গাড়ির ব্লু-প্রিন্ট কিনে এনে গ্যারেজে রেখে দিলেন। ব্লু-প্রিন্টটি নিজে নিজে গাড়ির ইঞ্জিন তৈরি করল, বডি তৈরি করল, সিট ও সিট কভার তৈরি করল, ড্রাইভিং প্যানেল, চাকা, উইন্ডশিল্ড ইত্যাদি তৈরি করে গাড়িতে রঙ স্প্রে করে চকচকে ঝকঝকে করে ফেলল। তারপর পেট্রোল ট্যাঙ্কি তৈরি করে পেট্রোল ভরে নিজে নিজেই চলা শুরু করল। প্রাণের বিকাশে ডিএনএ-র ভূমিকা কার্যত একরমই।
মানবদেহের ৫০-৭০ ট্রিলিয়ন সেলের প্রতিটিতেই রয়েছে তিন বিলিয়ন জেনেটিক বিটের পুরো সেট। প্রতিটি সেলের ডিএনএ-ই একটি অপরটির কার্বন কপি। তা সত্ত্বেও তাদের কাজ ও আয়ুষ্কাল ভিন্ন।
যেমন ব্রেনের নিউরোন এবং নাকের ওলফ্যাক্টরি সেল দেখতে একই রকম। কিন্তু নিউরোনের আয়ু বহু বছর হলেও ওলফ্যাক্টরি সেল পরিবর্তিত হয় চার সপ্তাহে। পাকস্থলীর আস্তর পরিবর্তিত হয় পাঁচ দিনে এক বার, ত্বক পাঁচ সপ্তাহে, রক্তের লোহিত কণিকা ৪ মাসে, হাড়ের সেল প্রতি তিন মাসে। লিভার সেলের বদলাতে কয়েক বছর লাগে। ব্রেন সেল বদলায় না।
প্রতিবছর আমাদের শরীরের শতকরা ৯৮ ভাগ এটম বা পরমাণু পরিবর্তিত হয়। তা সত্ত্বেও দেহের কোনো অঙ্গের আকার বা পরিচয় কোনোভাবেই নষ্ট হয় নি।
এই ডিএনএ তৈরি করেছে জৈব ঘড়ি। আর এই জৈব ঘড়িই নিয়ন্ত্রণ করছে জাগরণ, নিদ্রা, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, শরীরের তাপ, রক্তচাপ, যৌনতা ও বিভিন্ন হরমোনের প্রবাহে জোয়ারভাটায় প্রাণের সকল ছন্দ। প্রতিটি সেলের অভ্যন্তরে সেকেন্ডে কয়েক হাজার বার যে রাসায়নিক ক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়, তা-ও শরীরের এই মূল ঘড়ির ছন্দ ও নির্দেশনা অনুসরণ করে।
ডিএনএ-কে আপনি আরেক অর্থে বলতে পারেন আপনার জেনেটিক স্মৃতিভাণ্ডার। আপনি এখন ঠান্ডা বা অন্য কোনো রোগ থেকে নিরাময় লাভ করতে পারছেন, কারণ লক্ষ বছর আগে থেকে যে এন্টিবডি ব্যাক্টেরিয়া ও ভাইরাস-এর সাথে যুদ্ধ করতে শিখেছে, সেই এন্টিবডির স্মৃতি ও তথ্য আপনার থাইমাস গ্ল্যান্ডে সংরক্ষিত আছে।
বাতাসের অক্সিজেন পরমাণু হচ্ছে বস্তু। কিন্তু দম নেয়ার সময় সেকেন্ডের হাজার ভাগের কম সময়ের মধ্যে এই অক্সিজেন পরমাণুই ফুসফুসের প্রায় স্বচ্ছ পর্দা অতিক্রম করে রক্তের হিমোগ্লোবিনের সাথে যুক্ত হয়। সাথে সাথেই তা হয়ে ওঠে 'জীবন্ত'। হিমোগ্লোবিনের রঙ কালচে নীল থেকে পরিবর্তিত হয় উজ্জ্বল লাল রং-এ।
প্রতিবার দম নেয়ার সাথে সাথে শরীরের পাঁচ ট্রিলিয়ন লোহিত কণিকা বাতাসের মুখোমুখি হয়। প্রতিটি রক্ত কণিকায় রয়েছে ২৮০ মিলিয়ন হিমোগ্লোবিন অণু। প্রতিটি হিমোগ্লোবিন অণু ৮টি করে অক্সিজেন পরমাণুকে ধরতে ও পরিবহন করতে পারে। প্রতিবার দমের সাথে যে সংখ্যক অক্সিজেন পরমাণু শরীরে প্রবেশ করছে সংখ্যায় প্রকাশ করলে তা হবে ১১-এর পর ২১টি শূন্য!
শরীরের ভেতরে কত বিচিত্র তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ছে মুহূর্ত আগের প্রাণহীন বস্তু অক্সিজেন! অক্সিজেন এটম একটি নিউরোট্রান্সমিটার-এর সাথে যুক্ত হয়ে আপনার একটি সুখকর চিন্তার অংশে পরিণত হতে পারে। আবার এড্রিনালিন অণুর অংশ হয়ে আপনার মধ্যে আতঙ্ক বিস্তার করতে পারে। গ্লুকোজের সাথে মিশে ব্রেন সেলের খাবারে পরিণত হতে পারে। আবার শ্বেত কণিকার অংশ হয়ে আক্রমণকারী ব্যাক্টেরিয়াকে প্রতিহত করতে গিয়ে আপনার জন্যে আত্মবিসর্জন দিতে পারে।
আর এসব কিছুই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ডিএনএ-তে সংরক্ষিত তথ্যভাণ্ডার দ্বারা। এই ডিএনএ-ও প্রাথমিকভাবে কার্বন, নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন এটমের এক সূক্ষ্ম সমন্বয়।
দেহ হচ্ছে এই চেতনার বাসস্থান। এই চেতনাকে যদি আপনি পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে দুটি ডিএনএ থেকে যেভাবে পরিপূর্ণ মানবদেহ লাভ করেছেন, একইভাবে পরিপূর্ণ সাফল্যও লাভ করতে পারবেন। কারণ, মনের শক্তি এই চেতনারই একটা রূপ মাত্র।
সফল মানুষেরা মনের এই শক্তিকে উপলব্ধি করেছেন, সৃজনশীলভাবে কাজে লাগিয়েছেন। ফলে তারা স্মরণীয়-বরণীয় হয়েছেন। আর সাধারণ মানুষ মনের এই শক্তিরহস্য সম্পর্কে সচেতন নয়; তাই তারা হতাশা নেতিচিন্তা ও রি-অ্যাকটিভ কাজকর্ম দ্বারা নিজেদের অনন্ত সম্ভাবনাকে নষ্ট করছে।
এককথায় বলা যায়, প্রতিভাবানদের সাফল্যের মূল রহস্য নিহিত রয়েছে মনের শক্তি সম্পর্কে সচেতনতা, এর ওপর অবিচল বিশ্বাস ও আস্থা এবং একাগ্রচিত্তে ক্রমাগত এর সৃজনশীল প্রয়োগের মধ্যে। আর এই কাজগুলো করার মাধ্যমে আপনিও হতে পারেন প্রতিভাবানদের মতোই সফল মানুষ।
[আর্টিকেলটি কোয়ান্টাম মেথড বইয়ের ‘মন : শক্তিরহস্য’ অধ্যায় থেকে অ্যাডাপ্টেড। পুরো চ্যাপ্টারটি পড়তে বইটি সংগ্রহ করুন অথবা ই-বুক পড়ুন এই লিংকে]