করোনাভাইরাস : আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যেভাবে বাড়াতে পারেন

published : ১১ এপ্রিল ২০২০

গত তিনটি মাস ধরে যে ভাইরাসটি পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের জীবনকে হয়রান করে তুলেছে, যার কারণে এখন পৃথিবীর বহু মানুষ ঘরে কোয়ারেন্টিন হয়ে আছেন, তার প্রতিরোধ কীভাবে করা যাবে-এটা সম্ভবত এখন পৃথিবীর সবচেয়ে জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন!

এককথায় এর জবাব দেয়া মুশকিল। ধন্বন্তরী সমাধান দেয়াও সম্ভব নয়।

কিন্তু যুগের পর যুগ প্রকৃতির যেসব খাবারকে বা প্রক্রিয়াকে মানুষ তার রোগ প্রতিরোধ-ক্ষমতার বাড়াবার কারক হিসেবে খুঁজে পেয়েছে, সেগুলোর দিকে একটু ফিরে তাকালে কেমন হয়?

বিশেষত, যখন রোগটির প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধকেই ‘সহজ এবং কার্যকর’ বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে এ খাবারগুলো বা প্রক্রিয়াগুলো কাজ করবেই- এমন গ্যারান্টি দেয়া হচ্ছে না।

কিন্তু বিশ্বাস রাখুন- নিয়মিত এ খাবারগুলো খেলে এবং করণীয়গুলো অনুসরণ করলে আপনি অবশ্যই দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার একটা চমৎকার মাত্রায় নিজেকে আবিষ্কার করবেন।

রসুন- রোগ প্রতিরোধের মহাতারকা

রসুনের ছোট ছোট কোয়ার ভেতরে রোগ প্রতিরোধের এত অসাধারণ ক্ষমতা লুকিয়ে রয়েছে যে তিন হাজার বছর আগে গ্রীক চিকিৎসক ‘হিপোক্রেটাস’ (যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনকও বলা হয়) পর্যন্ত তার রোগীদের সুস্থ থাকার জন্যে প্রতিদিন একটা করে রসুন খেতে বলতেন।

তবে আস্ত রসুন নয়, রসুনের একটা ছোট কোয়াও এজন্যে যথেষ্ট হতে পারে।

কারণ রসুনের একটা কোয়ার ভেতরে থাকে-

  • ৫ মিগ্রা ক্যালসিয়াম
  • ১২ মিগ্রা পটাসিয়াম
  • ১০০ এরও বেশি সালফিউরিক উপাদান যা ব্যাকটেরিয়া ও ইনফেকশন তাড়াতে আদর্শ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আহত যেসব সৈনিকদের গ্র্যাংগ্রিন হতো তাদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতো এই রসুন।

ফ্লু বা ঠান্ডার অসুখবিসুখে রসুন দারুণ কার্যকর! একটা গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিত রসুন খেলে ফ্লু-র প্রকোপকে ৬৩% কমিয়ে ফেলা যায়। আর আক্রান্ত হলেও ৭০% ক্ষেত্রে উপসর্গগুলো সেরে যায় অল্পতেই।

এমনকি ফ্লু বা জ্বর-ঠান্ডার জন্যে ডাক্তারের কাছ থেকে আমরা যে ওষুধ খাই, রসুন তার চেয়েও ভালো।

কারণ এসব এন্টিবায়োটিক ওষুধ দেহের ভালো ও খারাপ- দুই ধরনের ব্যাকটেরিয়াকেই ধ্বংস করে ফেলে। ফলে দেহে উপকারি ব্যাকটেরিয়ার কার্যকারিতা হ্রাস পায়।

যে কারণে দেখবেন এন্টিবায়োটিক ওষুধ খেলে হজমের সমস্যা হয়, গ্যাস হয়, অনেকের লুজ মোশন বা পাতলা পায়খানাও হয়।

কিন্তু রসুন আপনার দেহের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াগুলো মেরে ফেলে ঠিকই, কিন্তু ভালো ব্যাকটেরিয়াকে রাখে সুরক্ষিত।

যে কারণে রসুনকে বলা হয়- Immunity Boosting Superstar বা রোগ প্রতিরোধের মহাতারকা।

তবে রসুনের এই উপকারগুলো পেতে হলে রসুন খেতে হবে কাঁচা। কারণ রান্না করলে বা শুকালে রসুনের সালফার এনজাইমগুলো কমে যায়। আর এই সালফারের ভেতরেই থাকে রসুনের ‘এন্টিবায়োটিক’ প্রভাব।

কিন্তু রসুন নিয়ে একটা সমস্যা হলো এর গন্ধ। গন্ধটা হয়তো পুরোপুরি দূর করা যাবে না। তবে কিছু উপায় আছে যাতে আপনি এর তীব্রতাকে কমাতে পারেন-

  • তাজা, পুষ্ট রসুন নেবেন, মিইয়ে যাওয়াগুলো নয়
  • রসুনকোষের খোসা ছাড়িয়ে নিন, সবুজ অঙ্কুর থাকলে সেটাও খসিয়ে ফেলুন
  • রসুনের কোষটি ভালোভাবে পানিতে ধুয়ে নিন
  • খাওয়ার পর দাঁত ব্রাশ করুন

কালোজিরা এবং কোভিড-১৯ আক্রান্ত নাইজেরিয়ার গভর্নর

সম্প্রতি কোভিড-১৯ পজিটিভ পাওয়ার পর আইসোলেশনে চলে যান নাইজেরিয়ার ওয়ু প্রদেশের গভর্নর সেয়ি মাকিন্দি। সপ্তাহখানেক পর যখন তার আবার পরীক্ষা করা হয়, তখন নেগেটিভ আসে।

সেয়ি মাকিন্দি বলেন, কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার অস্ত্র ছিল তিনটি– গাজর, ভিটামিন সি এবং মধু দিয়ে কালোজিরার তেল।

তিনি বলেন, এসময়টা তার চেষ্টা ছিল যথাসম্ভব তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলা, আর সেটাই ফল দিয়েছে।

করোনাভাইরাস থেকে আরোগ্যলাভের এ ঘটনা নাইজেরিয়াজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ৯ এপ্রিল দ্য গার্ডিয়ানে খবরটি প্রকাশিত হয়।

কালোজিরা- মনে করা হচ্ছে কোভিড-১৯-কে প্রতিহত করতে পারবে

সম্প্রতি কেম-আর্কাইভে প্রকাশিত এক গবেষণায় কালোজিরার উপকরণ কীভাবে কোভিড-১৯ কে প্রতিহত করতে পারে, তা প্রকাশের পর থেকেই এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়।

“Identification of Compounds from Nigella Sativa as New Potential Inhibitors of 2019 Novel Coronavirus (COVID-19): Molecular Docking Study” শিরোনামের এ প্রতিবেদনটি লেখেন গবেষক সেলিম ও মিসউম। মলিকুলার ডকিং পদ্ধতি ব্যবহার করে তিনি কালোজিরার মধ্যে এমন কিছু উপাদান পান যাকে মনে করা হচ্ছে যে তা কোভিড-১৯ প্রতিরোধ করতে পারবে।

কালোজিরার ওষুধি গুণের সন্ধান মানুষ পেয়েছে আজ থেকে অন্তত দু’হাজার বছর আগে। মাথাব্যথা, দাঁতব্যথা থেকে শুরু করে উচ্চরক্তচাপ, রক্তক্ষরণ এবং ফুসফুসের যে-কোনো সংক্রমণ (এজমা, কফ, ব্রংকাইটিস, ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু) কালোজিরা এত কার্যকর যে একে বলা হয় হাব্বাত উল বারাকা বা আশীর্বাদের বীজ।

টক দই-উপকারি ব্যাকটেরিয়া

দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় পরিপাকতন্ত্রের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি হয়তো জানেন, ইমিউন সেলের শতকরা ৭০ ভাগই অবস্থান করে পরিপাকতন্ত্রের গায়ে।

এখান থেকেই তৈরি হয় সেসব এন্টিবডি ও কোষ যা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াগুলোকে শনাক্ত করে ও মেরে ফেলে।

যেহেতু খাবারের সাথে পাকস্থলীতে নানা ধরনের জীবাণুও ঢোকে, পাকস্থলীর আবরণের একটা কাজই তাই এগুলোকে শরীরে ঢুকতে না দেয়া।

এছাড়া পাকস্থলীর ভেতরে রয়েছে কিছু উপকারি ব্যাকটেরিয়াও। যাদের কাজ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে চাঙ্গা রাখা। এদেরকে বলা হয় প্রো-বায়োটিক।

প্রো-বায়োটিক আছে, এমনসব খাবার খেয়েও আপনি এই উপকারি ব্যাকটেরিয়াকে সাহায্য করতে পারেন। যেমন, টকদই, পনির, জলপাই ইত্যাদি।

পেঁপে-১৫৭% ই পেয়ে যান

পেঁপেতে আছে প্রচুর ভিটামিন সি। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের একদিনে যে পরিমাণ ভিটামিন সি-র প্রয়োজন হয়, তার ১৫৭%-ই পাওয়া যায় একটি পেঁপের মধ্যে। এছাড়া এতে আছে পটাশিয়াম, ভিটামিন বি, ফোলেট ইত্যাদি, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়ায়।

ব্রোকোলি-প্রকৃতির অন্যতম স্বাস্থ্যকর সবজি

ভিটামিন সি-র এক দারুণ উৎস ব্রোকোলি। সাধারণভাবে ভিটামিন সি বলতে আমরা টক ফলকে বুঝি। কিন্তু বিস্ময়কর হলো- ব্রোকোলিতে যে পরিমাণ ভিটামিন সি আছে তা অনেক টকফলের চেয়েও বেশি।

যেমন ১০০ গ্রাম ব্রোকোলিতে আছে ৮৯ মিগ্রা ভিটামিন সি।

এছাড়াও এতে আছে ভিটামিন এ, ই এবং অনেক ধরনের এন্টি-অক্সিডেন্ট ও ফাইবার যা ব্রোকোলি-কে প্রকৃতির অন্যতম স্বাস্থ্যকর সবজিতে রূপান্তরিত করেছে।

তবে এ খাবারটির পুষ্টিগুণ তত অক্ষুণ্ন থাকবে যত একে কম রান্না করা যাবে। কাঁচা খেতে পারলে তো খুবই ভালো। কিন্তু সেটা না পারলে স্রেফ ভাঁপে সেদ্ধ করে খান।

পালংশাক-হালকা রান্না করে খাওয়া ভালো

পালংশাকেও ভিটামিন সি আছে প্রচুর। আছে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, ভিটামিন এ, ফোলেট এবং আরো অনেক ধরনের এন্টি-অক্সিডেন্ট ও বিটা ক্যারোটিন যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়ায়।

পালংশাকের সুবিধা হলো এটা দামে সস্তা এবং আমাদের দেশে পাওয়াও যায় সারাবছর।

তবে ব্রোকোলির মতো এটাও যত কম রান্না করা যায় তত ভালো। অবশ্য একেবারে কাঁচা না খেয়ে হালকা রান্না করে খাওয়া ভালো, কারণ তাতে ভিটামিন এ-সহ অন্য উপকরণগুলো বের হয়ে আসে।

টক ফল

টকফলে যে ভিটামিন সি থাকে তা আমরা জানি। কিন্তু ভিটামিন সি যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় তা কি জানি?

একটি গবেষণায় দেখা গেছে- পর্যাপ্ত ভিটামিন সি খেলে ফ্লু-র উপসর্গগুলো দ্রুত সেরে যায় এবং ফুসফুসে কোনো সংক্রমণ হলে তা-ও সারাতে সাহায্য করে।

যে কারণে চীনের যে শহরটি থেকে এই কোভিড-১৯ এর প্রকোপ শুরু হয় সেই উহানের জংগান হাসপাতালের একদল চিকিৎসাবিজ্ঞানী হাসপাতালে আসা করোনা রোগীদের যাদের বেশিমাত্রায় ফুসফুস সংক্রমণ হয়েছিল, তাদের সারিয়ে তুলতে ভিটামিন সি প্রয়োগ করেছিলেন।    

তবে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে আমাদের শরীর ভিটামিন সি ধরে রাখতে পারে না। তাই আপনাকে প্রতিদিনই নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে এই ভিটামিন গ্রহণ করে যেতে হবে।

আদা-রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ভারসাম্য ঠিক করে

অনেক ধরণের অসুস্থতায়ই আদা কাজের হলেও গলাব্যথা, ফ্লু, জয়েন্ট পেইন- ইত্যাদি অসুখে আদা খুবই কার্যকর। বমি বমি ভাব কাটাতেও আদা সাহায্য করে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যখন কম থাকে, আদার প্রভাব তা বাড়িয়ে দেয়। আর যদি বেশি থাকে, তো কমিয়ে দেয়।

অর্থাৎ প্রতিরোধ ক্ষমতারও যে ভারসাম্য দরকার, আদা তা নিশ্চিত করে।

এমনকি গবেষণায় দেখা গেছে যেসব ব্যাকটেরিয়া ড্রাগ-রেসিস্ট্যান্ট হয়ে পড়েছে, মানে ওষুধ খেয়েও কাজ হচ্ছে না- সেসব ক্ষেত্রেও আদা কার্যকর।

ক্যাপসিকাম-ফলের দ্বিগুণ ভিটামিন সি

এদেশে মধ্যবিত্ত ভোক্তাদের মধ্যে ক্যাপসিকাম খাওয়ার চলটা বেশ কম।

কিন্তু জানেন কি- কমলা, আঙুর ও অন্যান্য বিদেশি যেসব টকফল আমরা অনেক দাম দিয়ে কিনে খাই, সেগুলোর চেয়েও ক্যাপসিকামে বেশি ভিটামিন সি থাকে?

অন্তত দ্বিগুণ!

কাজেই দাম বেশি দেখেই কেনার সিদ্ধান্ত নাকচ করার আগে একবার ভাবুন- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে আখেরে আপনি কিন্তু বেশিই বাঁচাচ্ছেন!

আপেল- উপকারি ব্যাকটেরিয়ার খাবার

আপেলে ভিটামিন এ, বি, সি, ই- কী নেই! তাছাড়া এতে আছে পেকটিন বলে একটি উপাদান, যা এক ধরনের ফাইবার এবং কাজ করে প্রিবায়োটিকের মতো। প্রিবায়োটিক হলো দেহের উপকারি ব্যাকটেরিয়ার খাবার। যা সরাসরি আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে কাজ করে।

গ্রীন টি-জীবাণুর সাথে লড়াইকারী উপাদান তৈরিতে সাহায্য করে

গ্রিন টি এবং ব্ল্যাক টি – দুটোতেই ফ্ল্যাভোনয়েড নামের এন্টি-অক্সিডেন্টটি প্রচুর পরিমাণে আছে। তবে গ্রিন টিতে আছে ইজিসিজি নামের আরেকটি শক্তিশালী এন্টি-অক্সিডেন্ট যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়াতে সাহায্য করে। ব্ল্যাক টিতে অবশ্য এই উপাদানটি নষ্ট হয়ে যায় তা প্রক্রিয়াজাত করতে গিয়ে।

এছাড়া গ্রিন টিতে আছে এমাইনো এসিড ‘এল-থিয়ানিন’ যা রক্তের টি-সেলের মধ্যে জীবাণুর সাথে লড়াইকারী উপাদান প্রস্তুতে সাহায্য করে।

ফাস্ট ফুড-দেহের শত্রু

একটা জিনিস খেয়াল করুন- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যে যে খাবারগুলোর কথা বলা হলো, তার কোথাও কিন্তু প্রক্রিয়াজাত খাবার বা ফাস্ট ফুড- এসবের কথা বলা হয় নি।

ফাস্ট ফুড রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর কিরকম প্রভাব ফেলে তা উঠে এসেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পুষ্টি জার্নালে প্রকাশিত পাশ্চাত্য ডায়েট সম্পর্কিত এক গবেষণায়-

"ফাস্ট ফুড ও প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি বেশি খাওয়ার ফলে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে বহুতর স্বাস্থ্য সমস্যা- এলার্জি, ইনফেকশন আর প্রদাহ তার অন্যতম।"

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের অনকোলজি বিভাগের প্রধান ড. জাফর মাসুদের একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য।

“এখন বাংলাদেশে বয়স্কদের তুলনায় তরুণরা ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি।

যে-সব ক্যান্সার ৫০-৬০ বছর বয়সের পরে হওয়ার কথা, তা ৩০ বছরের একজন মানুষের হতে দেখা যাচ্ছে।

এর একটি বড় কারণ তরুণদের খাদ্যাভ্যাস। বেশিরভাগ তরুণেরই ফাস্টফুডের প্রতি আসক্তি রয়েছে।

ফাস্টফুডে নাইট্রেটের পরিমাণ বেশি থাকে। ফাস্টফুড বানাতে ব্যবহৃত হয় সংরক্ষিত মাংস বা বেশি রান্না করা মাংস।

এসব উপাদানে তৈরি বার্গার, হটডগ বা ক্যানে সংরক্ষিত নানান উপাদানে অতিরিক্ত মাত্রায় ক্যান্সার সৃষ্টিকারী নাইট্রেড থাকে। যা পরে নাইট্রাস ইউরিয়ায় পরিবর্তিত হয়। এ থেকে মলাশয় ও মলদ্বারের ক্যান্সার হয়।”

তার মানে রোগ প্রতিরোধ তো দূরের কথা, উল্টো প্রাণঘাতী সব রোগেরই জন্ম দেয় ফাস্টফুড।

কাজেই আপনি যদি কোভিড-১৯ নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন, তাহলে ফাস্টফুড খাবার কথা ভুলেও ভাববেন না।

চিনি এবং চিনিজাত খাবার-রোগ প্রতিরোধের বাধা

একটি ল্যাব পরীক্ষায় দেখা গেছে- চিনি হোয়াইট ব্লাড সেলের কার্যক্রমকে ব্যহত করে। আর হোয়াইট ব্লাড সেলই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়ায়।

তাছাড়া অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে- রক্তে উচ্চমাত্রায় চিনি ইনফেকশন এবং অন্যান্য জটিলতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

তবে শুধু মোটা দাগে চিনিকেই এ তালিকার একমাত্র দায়ী হিসেবে ভাবলে ভুল হবে। সাদা চাল, সাদা ময়দা ইত্যাদি যেসব প্রক্রিয়াজাত শর্করা আমরা প্রতিদিন খাই তাও কিন্তু প্রকারান্তরে চিনিই।

ভালো ঘুম

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ঘুমের ভূমিকাও কিন্তু কম নয়। গবেষণায় দেখা গেছে-ঘুম কম হলে সাইটোকিনস নামের এক ধরনের প্রোটিন দেহে বেশি উৎপন্ন হয়। আর দেহে ইনফেকশন ও প্রদাহ বাড়াতে এই সাইটোকিনসের ভূমিকা আছে।

১৫৩ জন স্বেচ্ছাসেবীকে নিয়ে এর একটি গবেষণা চালানো হয়েছিল। স্বেচ্ছাসেবীদের দেহে ‘রাইনোভাইরাস’ নামে এক ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস ঢুকিয়ে দেয়া হয়।

দেখা গেল- যারা সাত ঘণ্টার কম ঘুমিয়েছেন, তাদের ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার হার, যারা আট ঘণ্টার বেশি ঘুমিয়েছেন তাদের চেয়ে তিনগুণ বেশি হয়েছে।

কতক্ষণ ঘুমানো দরকার?

প্রশ্ন হলো- কতক্ষণ ঘুমানো দরকার?

বলা হয়, বয়স্কদের জন্যে ৭-৮ ঘণ্টা, টিন এজারদের জন্যে ৯-১০ ঘণ্টা এবং তার চেয়ে কম বয়সীদের জন্যে ১০ ঘণ্টার বেশি ঘুমোনো উচিত।

তবে যারা নিয়মিত দুবেলা মেডিটেশন করেন, তারা ৬ ঘণ্টা ঘুমালেও চলে।

টিভি, ইউটিউব, ফেসবুক

কিন্তু এখন ঘুমের একটা বড় শত্রু হলো সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইন্টারনেটকেন্দ্রিক আসক্তি ও বিনোদন।

গভীর রাত পর্যন্ত এগুলোতে সময় কাটাবার পর মানুষ যখন ঘুমুতে যাচ্ছে, তখন না পাচ্ছে ঘুমের পর্যাপ্ত সময়, না হচ্ছে ভালো ঘুম।

বিশেষত, এখন বাসায় থাকার এই সময়টা অনেকেই করোনাভাইরাস নিয়ে নানারকম খবরাখবর টিভিতে, ইউটিউবে বা ফেসবুকে দেখার জন্যে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকছেন।

এই অপর্যাপ্ত ঘুম প্রকারান্তরে তাকে কিন্তু করোনার হুমকির মুখেই ফেলছে। যদি সত্যিই তিনি রোগটির সংক্রমণে পড়েন, তা প্রতিরোধের শক্তি কিন্তু তার এভাবেই কমে যাচ্ছে।

নির্দিষ্ট সময় ঘুমোতে যান

স্বাস্থ্যবিদরা বলেন, ভালো ঘুমাভ্যাস হলো প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া। এবং সেটা যদি রাত সাড়ে এগারটা হয় তাহলে খুব ভালো।

আর চেষ্টা করুন রাত ১২:৩০-২:৩০ সময়টা ঘুমন্ত থাকতে। কারণ আপনার দেহের ‘ঘুম-জাগরণ ছন্দ’ চায় এসময়টা আপনি ঘুমিয়ে থাকুন।

আর সন্ধ্যার পর চেষ্টা করবেন মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ বা কম্পিউটার স্ক্রিনে অর্থাৎ ব্লু-স্ক্রিনের কাছে যত কম যাওয়া যায়। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, ব্লু-স্ক্রিন মানুষের ঘুমকে ডিস্টার্ব করে দেয়।

বরং চেষ্টা করুন- সন্ধ্যার পর এসময় বাসায় প্রযুক্তিহীন কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকতে। যেমন বই পড়ুন বা হাতের কোনো কাজ করুন ইত্যাদি।

শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকুন

যারা নিয়মিত ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম করেন তাদের ইনফেকশনে ভোগার প্রবণতা কম- গবেষণা তা-ই বলে।

কিন্তু যারা হাঁটাহাঁটি করতেন বা পার্কে ব্যায়াম করতেন, এসময় সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা হয়তো বিকল্প খুঁজছেন যে এখন কী করবেন।

তাদের জন্যে এবং সবার জন্যেই এখন সবচেয়ে ভালো ব্যায়াম হলো কোয়ান্টাম ব্যায়াম-যোগ ব্যায়ামেরই সহজতম এবং ফলপ্রসূ রূপায়ন।

বিশেষ করে কোয়ান্টাম ব্যায়ামের কয়েকটি আসন এখন বিশেষভাবে করতে পারেন-গোমুখাসন, ভুজঙ্গাসন, উষ্ট্রাসন, মৎস্যাসন, হলাসন, পবন মুক্তাসন, শশাঙ্গাসন

ব্যায়ামগুলো ইয়োগা সাইটে আছে, মা-জী নাহার আল বোখারীর লেখা কোয়ান্টাম ব্যায়াম বইতে আছে। কোয়ান্টাম ইয়োগা অ্যাপেও আছে।

তাছাড়া শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকার আরো একটি উপায় হলো এসময় বাসায় নিজের কাজগুলো নিজেই করা।

গৃহকর্মীকে ছুটি দিয়ে দেয়ায় মহিলাদের কাজ যেহেতু এখন বেশ বেড়ে গেছে, পুরুষরা তাই চেষ্টা করতে পারেন-বাড়িতে মা-বোন বা স্ত্রীকে সাহায্য করতে পারেন। এতে পরিজনদের সাথে যেমন হৃদ্যতা বাড়বে। তেমনি আপনার একটিভ থাকার সুযোগও হবে।

স্ট্রেস এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা

বিজ্ঞানীরা বলেন- ক্রনিক স্ট্রেস বা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়।

কারণ দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ফলে কর্টিসল নামের এক ধরনের স্ট্রেস হরমোন নির্গত হয় শরীর থেকে। আর এই স্ট্রেস হরমোন দেহের টি-সেলকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

টি-সেল হচ্ছে সেসব সেল যা দেহে কোনো ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস আঘাত হানলে তার সতর্কতা ব্রেনে পাঠায়।

এছাড়া কর্টিসল এন্টিবডি ‘আইজিএ’-র নিঃসরণও কমিয়ে দেয়। আইজিএ হচ্ছে সেই এন্টিবডি যা পাকস্থলী ও ফুসফুসের গায়ে অবস্থান করে কোনো ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাস যদি দেহকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয় তো তার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

ভয়-দুশ্চিন্তা-টেনশন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়

দুশ্চিন্তা, আতঙ্ক, ভয় কীভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে তার একটি গবেষণা করেছিল ডব্লিউএইচও। মেডিকেল প্রথম বর্ষের ৪৯ জন ছাত্রছাত্রীকে তারা বেছে নেন।

পরীক্ষার একমাস আগে (যখন পরীক্ষা নিয়ে তাদের উদ্বেগ-টেনশন কিছুটা কম) তাদের দেহ থেকে রক্তের স্যাম্পল নিয়ে দেখা যায় তাতে টি-সেলের পরিমাণ এবং সক্রিয়তা বেশ ভালো।

কিন্তু তাদেরকেই যখন প্রথম বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষার সময় স্যাম্পল নেয়া হলো, দেখা গেল টি-সেলের পরিমাণ এবং সক্রিয়তা দুটোই কম।

এ থেকেই বিজ্ঞানীরা মনে করছেন- মানুষ যখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকে, তখন তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।

সমাধান মেডিটেশন

তাহলে সমাধান কী? আসলে দুশ্চিন্তা-ভয়-আতঙ্ক- এর উৎস কিন্তু আপনার মন। দেখবেন, একই ঘটনা কাউকে আতঙ্কগ্রস্ত করছে। আবার কারো ওপর কোনো প্রভাবই ফেলছে না। তিনি আছেন একদম স্বাভাবিক অবস্থায়।

পার্থক্যটা হচ্ছে আপনি কত ভালোভাবে মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন। আপনার মন কতটা স্থির ও প্রশান্ত তার ওপর।

এজন্যেই প্রয়োজন মেডিটেশন। দিনে দুবার আধঘণ্টা করে মেডিটেশন আপনাকে অনেক প্রশান্ত ও স্থির করবে।

তাছাড়া সারাক্ষণ বাসায় থাকতে থাকতে যে একটা আবদ্ধ-অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, দূর হবে সেটাও।

সকালে করুন পরিবারের সাথে একাত্মতার এক চমৎকার মেডিটেশন – আমার পরিবার

আর সন্ধ্যায় করুন প্রার্থনার মেডিটেশন

তবে কোয়ান্টাম সাইটের মেডিটেশন পেজ থেকে আপনি আপনার পছন্দমতো অন্য মেডিটেশনও বেছে নিতে পারেন।

অন্যান্য

হাত ধোয়ার কথা তো বলাই বাহুল্য। কোভিড-১৯ প্রতিরোধের এখন পর্যন্ত এটাই একমাত্র কার্যকর প্রমাণিত করণীয়। ভাইরাসটি রয়েছে এমন জায়গায় হাত পড়লে তার মাধ্যমে এটা ছড়ায়। আর হাত তো আপনি সারাক্ষণই এখানে সেখানে লাগাচ্ছেন। কিন্তু নিয়মিতভাবে ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধুলে এটা পরিষ্কার হয়ে যায়।

এছাড়া হাত-পা এবং শরীরের অন্যান্য জায়গার ত্বক যেন খুব শুষ্ক-রূক্ষ না হয়ে যায়, সেদিকে খেয়াল রাখবেন। কারণ শুষ্ক-রূক্ষ ত্বকে সহজেই জীবাণু আকৃষ্ট হয়। এজন্যে নারকেল তেল ব্যবহার করতে পারেন।

আর প্রচুর পানি খেতে হবে।

শরীরের সাথে সাথে আপনার গলাটাকে ভেজা রাখাটা জরুরি। এজন্যে একটা কাজ করতে পারেন- সকালে এবং রাতে যখন দাঁত ব্রাশ করেন, তখন কয়েকবার পানি দিয়ে (যদি হালকা গরম পানি হয় তাহলে আরো ভালো) গার্গল করে নিতে পারেন। গবেষণায় দেখা গেছে- এতে জীবাণুর সংক্রমণের সম্ভাবনা কমে যায়।

এ সম্পর্কে আরো জানতে:

[ভিডিও] : করোনা আতঙ্ক ; করোনাভাইরাস ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা

[অডিওসহ গুরুজীর বক্তব্য] : করোনাভাইরাস

[আরো আর্টিকেল] : করোনাতে করণীয়

[গুরুজীর চিঠি] : করোনাভাইরাস সচেতনতায় করণীয়

[মেডিটেশন] : করোনাভাইরাস প্রতিরোধে