আর্লি প্যারেন্টিং

এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের শিক্ষা...

এক মহল্লায় দুজন প্রতিবেশী থাকতেন পাশাপাশি বাড়িতে। এদের একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক এবং অন্যজন একটা এনজিওতে চাকরি করেন।

একদিন দুজনই তাদের বাগানে বীজ রোপণ করলেন। বীজ থেকে গাছ হলো।

অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রতিদিনই গাছগুলোতে স্বল্প পরিমাণে পানি দিতেন। মাঝেসাঝে গাছগুলোর দেখভাল করতেন।

এদিকে চাকুরীজীবীর প্রযুক্তির দিকে আগ্রহ অনেক বেশি। তিনি তার গাছে বিভিন্ন রকম প্রযুক্তির ব্যবহার করতে লাগলেন এবং সকাল-বিকাল পানি দিতে লাগলেন।

চাকুরীজীবীর গাছ বেশ সতেজ সজীব প্রাণোচ্ছল। কিন্তু শিক্ষকের গাছগুলো শুকিয়ে একেবারেই মরা মরা ভাব!

একদিন মধ্য রাত থেকে সকাল পর্যন্ত তুমুল ঝড় হলো। অনেক বিদ্যুৎ চমকালো।

পরদিন সকালে দুজনই দেখল তাদের বাগানের অবস্থা লণ্ডভন্ড। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার! চাকুরীজীবীর সব গাছের শিকড়সহ উপড়ে পড়ে আছে। কিন্তু শিক্ষকের বাগানের একটা গাছও মরে নি বরং বেশ ঝরঝরে দেখাচ্ছে।

চাকুরীজীবীতো অবাক! এত পরিশ্রমের ফল কী হলো? সবইতো ভেস্তে গেল। এদিকে শিক্ষক তেমন কিছুই করেন নি। কিন্তু তার গাছ!

চাকুরীজীবী তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞেস করলেন, স্যার! আমরা একসাথে গাছ লাগালাম। ঝড়ে আমার গাছগুলো শিকড়সহ বেরিয়ে এলো কিন্তু আপনার গাছগুলো এখনো জীবিত। এটা কীভাবে সম্ভব?

অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হাসলেন এবং বললেন, তুমি তোমার গাছগুলোর এত যত্ন নিয়েছ এবং এত পানি দিয়েছ যে, তাদের নিজেদের কোনো কাজই করতে হয় নি। তাদের কাজটা তুমি সহজ করে দিয়েছ।

আর আমি স্বল্প পানি দিয়েছি যাতে শিকড়গুলো আরো পানির সন্ধান করে। এজন্যেই শিকড়গুলো মাটির গভীরে পৌঁছেছে এবং গাছের অবস্থানকে মজবুত করেছে। এজন্যে ঝড় গাছের কোনো ক্ষতি করতে পারে নি।

একটা বীজের মতো শিশুরাও আসলে অনাবাদী। তাকে আবাদ করতে হয় একজন দক্ষ চাষির মতো। একজন দক্ষ চাষি যেমন পারেন সোনার ফসল ফলাতে তেমনি প্যারেন্টিংয়ে দক্ষ মা-বাবাও পারেন সোনার সন্তান গড়ে তুলতে।

গর্ভাবস্থা থেকে শুরু করে পাঁচ বছর পর্যন্ত শিশুদের বিশেষ যত্ন নেয়া প্রয়োজন এবং যে-কোনো প্রতিকূলতা অতিক্রম করার জন্যে যে ট্রেনিং সেটিও দেয়া প্রয়োজন এই পাঁচ বছরের মধ্যেই। প্রশ্ন করবেন, এত ছোট বাচ্চা ট্রেনিং দেবো কীভাবে? খুব সহজ।

শুরু করবেন যেভাবে...

আমরা অনেক সময় মনে করি, আগে শিশুটি ভূমিষ্ঠ হোক তারপর তার লালন পালন নিয়ে ভাবে যাবে! কিন্তু মায়ের গর্ভে শিশুটির যখন ১২ সপ্তাহ তখন থেকেই সে শুনতে পায় সবকিছু। তাই তখন থেকেই শিশুর যত্ন নিতে হয়। অর্থাৎ ভ্রুণ থেকেই তার যত্নের প্রয়োজন।

ছোট্ট সোনামণি আসছে জেনে মা/বাবা/অভিভাবক হিসেবে আপনি কতটা খুশি সেটি তাকে বলুন। শিশুর নিরাপত্তা বাড়াতে এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

গর্ভাবস্থায় মোবাইলের ব্যবহার নিয়ে একটি গবেষণা তথ্য

ব্রিটেনের নরওয়েজিয়ান ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথের গবেষকদের গবেষণা বলছে, যে-সব মহিলারা গর্ভাবস্থায় মোবাইল ব্যবহার করেছেন, তাদের সন্তানদের কথা বলার সমস্যা মোবাইল ফোন আদৌ না ব্যবহার করা মায়েদের সন্তানদের থেকে ২৭ শতাংশ কম।

ব্যাকরণ সংক্রান্ত সমস্যা কম ১৪ শতাংশ ও তিন বছর বয়সের মধ্যে কথা না ফোটার সমস্যা কম ৩১ শতাংশ।
এছাড়া মোবাইল ব্যবহারকারীদের সন্তানদের লো মোটর স্কিল বা হাত পা নাড়ার ক্ষেত্রে সমস্যা ১৮ শতাংশ কম অন্য মায়েদের সন্তানদের থেকে।

তাই মোবাইল ফোনে কথা বলা বা অন্যান্য কাজ করুন পরিমিতি বজায় রেখে।

সন্তান জন্মের পর...

শিশুরা মায়ের চেহারা চেনার আগেই তার স্তনের গন্ধের সঙ্গে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে অন্যান্য জিনিসেও তারা মায়ের স্তনের গন্ধ খোঁজে।

তাই শিশুকে ছ’মাস পর্যন্ত বুকের শাল দুধ খাওয়ান। এতে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়বে।

জন্মের পরপরই একটি শিশু প্রথম তার মা-কে চিনতে শুরু করে। জন্মের দুই মাসের মধ্যে সে শনাক্ত করতে পারে তার বাবাকেও! মা-বাবার কণ্ঠ, চেহারা, গন্ধ তার মধ্যে নিরাপত্তাবোধ তৈরি করে।

অনেক ক্ষেত্রে বাবা মনে করেন, শিশুর যত্নের জন্যে মা কাছে থাকাই যথেষ্ট! তার আর কী করার আছে? কিন্তু শিশুটি বাবাকেও চেনা শুরু করেছে। তাই শিশু লালনে বাবার অংশগ্রহণও গুরুত্বপূর্ণ।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে যে শিশুটি তার বাবার শরীরের স্পর্শ পায় সে শিশুটির সাথে বাবার বন্ধন হয় দৃঢ়।

একটি চার্টের সাহায্যে আমরা দেখি শিশুর বেড়ে ওঠার সাথে সাথে তার কী কী চাহিদা হতে পারে...

ছয় মাস পরিচিত চেহারা দেখে হেসে ওঠে।
নয় মাস প্রথম কৌতূহলের অনুভূতি জাগে। মাঝে মাঝে উদ্বেগও দেখা যায়।
এক বছর অনুভূতি জাগে, চারপাশ ঘুরে দেখার ইচ্ছে জাগে। সাধারণ নির্দেশনাগুলো বুঝতে শেখে।
দ্বিতীয় বছর শব্দ ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়।
তৃতীয় বছর ভাব বিনিময় ও প্রশ্ন করতে শেখে।
চতুর্থ বছর আত্মনির্ভরশীল হতে চেষ্টা করে।
পঞ্চম বছর চাওয়া পাওয়া তুলে ধরতে শেখে।

কীভাবে শিশুর মানসিক চাহিদা পূরণ করবেন?

• প্রতিদিন তাকে জড়িয়ে ধরে বলুন, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’।

• শিশুর উঁ অ্যাঁ শব্দ বা জড়িয়ে যাওয়া কথা মন দিয়ে শুনুন। বাধা দেবেন না।

• বাসার বাইরে থাকলে ফোন দিয়ে কথা বলুন।

• শিশুর সাথে ভালবাসা দিয়ে দিন শুরু করুন। এবং খুশিমনে রাতে ঘুমুতে যান।

শিশুর সাথে আত্মিক আবেগিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে মা-বাবা/অভিভাবক হিসেবে করণীয় :

• ছেলে-মেয়েতে বৈষম্য না করে সমান দৃষ্টিতে দেখুন। ছেলে আপনার হলে মেয়েও আপনার।

• জন্মের পরপরই শিশুর যত্নে মা-বাবা দুজনই অংশ নিন।

• শিশুর বয়স যখন দু’সপ্তাহ তখন থেকেই তাকে দিন ও রাতের পার্থক্য বোঝাতে শুরু করুন।

• শিশু জন্মের পর থেকে তিন বছর পর্যন্ত ৮৮-৯৮ শতাংশ শব্দ ব্যবহার করে যা শুনে শুনে শেখা। তাই শিশু বুঝুক বা না বুঝুক তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলুন। যত বেশি কথা বলবেন তত বাড়বে তার শব্দভাণ্ডার এবং এই কথোপকথনে বাড়বে তার বুদ্ধিমত্তা ও বই পড়ার সামর্থ্য।

সৌলের হ্যানইয়াং ইউনিভার্সিটির ড. জিউন চোই এর নেতৃত্বে এক গবেষণায় দেখা গেছে, জন্মের পর প্রথম কয়েক মাসে শিশুরা যে ভাষা শোনে সেই ভাষাটা তাদের মস্তিষ্ক থেকে হারায় না।

• শিশুর সাথে হাসুন, ছড়া বলুন, গান গেয়ে শোনান। তাতে শিশু কণ্ঠস্বর শনাক্ত করতে শিখবে। পাশাপাশি শিশুর শ্রবণেন্দ্রিয়ের যোগাযোগ কৌশল উন্নত হবে।

২০০১ সালে এক পরীক্ষায় সাত থেকে নয় মাস বয়সী ৭৩টি শিশুকে টেলিফোনের ডায়াল বা টিভির শব্দের মতো হালকা শব্দ শোনানো হয়। পরে সেই শব্দের সঙ্গে কম্পিউটারনির্ভর আরো কয়েকটি শব্দ (এক হাজার হার্টজ পর্যন্ত) করা হয়।

গবেষকেরা দেখতে পান, শিশুরা ঐ হালকা শব্দ শুনতে পায় আবার পরে কয়েকটি শব্দের মধ্যে থেকে সেই শব্দ আলাদাভাবে টের পায়।

• শিশুকে তেল বা লোশন মালিশ করে দিন। হাত পায়ের ব্যায়াম করান। এতে তার স্পর্শের অনুভূতি সজাগ হবে।

• খেলনা দেয়া বা পছন্দের ড্রেস দেয়াই মা-বাবার দায়িত্ব নয়। তাকে গুণগত সময় দিন।

• যখন সে একটু বড় হবে তখন তার নিজের কাজগুলো করতে উৎসাহ দিন। যেমন, দাঁত মাজা, নিজের কাপড় নিজে পরা। অতিরিক্ত যত্ন নিতে গিয়ে তার সব কাজ নিজে করে দেয়া যাবে না। এতে করে সে পরনির্ভরশীল হয়ে উঠবে।

• শিশুকে কখনো ভয় দেখানো বা নিজেকে ভীতিকর চরিত্ররূপে উপস্থাপন করা উচিৎ নয়। অনেক সময় মায়েরা ‘ঐ যে বাবা আসছে তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও’ এমন কথা বলে খাওয়ান। বাবাকে নিয়ে এমন ইমেজ তৈরি করা থেকে বিরত থাকুন।

• বাইরে থেকে এসে নিজের রুমে না গিয়ে তার নাম ধরে ডাক দিন, কথা বলুন। এতে তার আত্মমর্যাদা বাড়বে, বন্ধন হবে দৃঢ়।

• শিশু কোথাও পড়ে গিয়ে আঘাত পেলে সে জায়গাকে পাল্টা আঘাত করতে বলবেন না। এতে সে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠবে।

• শারীরিক অবয়ব, খারাপ রেজাল্ট, দুষ্টুমিসহ কোনো ধরনের প্রসঙ্গ তুলে শিশুকে খোঁটা দেবেন না। তার সম্ভাবনার কথা বলে তাকে উৎসাহিত করে তুলুন। আপনার উৎসাহ তাকে সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে।

• কোনোকিছু চাওয়ার সাথে সাথে তাকে তা দেয়ার অভ্যাস পরিহার করুন। অন্যায় আবদার পূরণ করা থেকে বিরত থাকুন।

• কাঁদলে কখনো ধমকাবেন না। মনে রাখুন, শিশু আপনার ভালবাসা যেমন বুঝতে পারে তেমনি বিরক্তিও বুঝতে পারে। এই বিরক্তি বুঝতে পারলে সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি হতে পারে।

• প্রতিটি শিশুরই প্রতিভা আছে। আপনার সন্তানের প্রতিভা খুঁজে বের করুন এবং প্রতিভা বিকাশে ভূমিকা রাখুন।

• খেয়াল রাখুন, সন্তান যেন আপনার কাছে যে-কোনো কিছু বলতে সংকোচ না করে। সন্তান যদি কোনো গোপন কথা বলে সেটা যতই হাস্যকর বা অবান্তর হোক কাউকে শেয়ার করা থেকে বিরতথাকুন।

• কে বেশি ভালবাসে, বাবা নাকি মা?- এ ধরনের প্রশ্ন করে শিশুমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবেন না।

• আদর ও শাসনের সমন্বয়ে তাকে বিকশিত হবার সুযোগ দিন।

• শৈশব থেকেই সন্তানকে বলুন, তোমাকে ভালো মানুষ হতে হবে। মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে।

এই পৃথিবী নিয়ে একটি শিশুর কৌতূহল অসীম। তাদের কোমল হৃদয় যা দেখে তাই বিশ্বাস করে। যেভাবে শেখে সেভাবেই কল্পনা সাজায়। ছোটবেলার স্মৃতিগুলোই তার সমস্ত জীবনকে প্রভাবিত করে। আপনি তাকে শিশুকালে যা শেখাবেন তাই সে বয়ে বেড়াবে সারাজীবন।

তাই সন্তানকে ইতিবাচক আচরণ ও সঠিক জীবনদৃষ্টি শিক্ষা দিতে হবে। জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ ও তা অর্জনের জন্যে কাজ করতে উৎসাহিত করতে হবে।

মনে রাখতে হবে, সন্তানকে একজন আত্মবিশ্বাসী ও সফল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব মা-বাবা/অভিভাবক হিসেবে আমাদেরকেই নিতে হবে। যাতে সে তার মেধা ও যোগ্যতাকে পরিপূর্ণরূপে বিকশিত করে একটি সভ্য সমাজ ও জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।