published : ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
কখনো কি ভেবে দেখেছেন- আপনার মন আর আবেগের ওপর আপনার চরিত্রের কোনো প্রভাব আছে কিনা? বা থাকলেও তা কতটুকু? শুনুন বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন-
‘অবশ্যই আছে এবং তা আমরা সচরাচর যতটা ভাবি তার চেয়েও অনেক বেশি।’ ২০০৪ সালে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মানবীয় আবেগের সাথে সততা ও চারিত্রিক দৃঢ়তার রয়েছে এক সুনিবিড় যোগাযোগ।
অনেক সময় এমন হয় যে, কোনো একটি কাজ শুরু করতে গিয়ে এর প্রয়োজনীয়তা কিংবা এর ভালো-মন্দ পরিণতি চিন্তার আগে আমরা হয়তো ভাবি, কাজটি আমাকে কী কী সুবিধা দেবে বা আমি এতে কতটুকু লাভবান হবো? কখনো কখনো তা আমাদের বিবেকের ওপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দিয়ে হলেও। কিন্তু এমন শত নিগ্রহ-অত্যাচারে বিবেককে দমিয়ে রাখলেও আপনি কখনোই এভাবে বেশিদিন চালিয়ে যেতে পারবেন না।
আসলে নৈতিকতা-মূল্যবোধ মানুষের জীবনের এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যে, এটা ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেখা দেয় নানামুখী প্রতিক্রিয়া। যার পরিণতি হতে পারে বিদঘুটে অস্বস্তি থেকে শুরু করে পাপবোধ অস্থিরতা দুশ্চিন্তা অশান্তি। যদিও অধিকাংশ মানুষই স্বীকার করতে চান না -এসব ভোগান্তির কারণ হচ্ছে তাদেরই অনৈতিক, অবিবেচনাপ্রসূত, দুর্নীতিপরায়ণ ও প্রতারণাপূর্ণ আচরণের ফলাফল।
কিন্তু সত্য এটাই। কারণ জীবনের সবকিছুর মধ্যেই রয়েছে পারস্পরিক যোগসূত্র। তাই নৈতিক ভারসাম্যহীনতা শারীরিক অসুস্থতার পাশাপাশি মানসিক অশান্তি ও অসুস্থতার সৃষ্টি করে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, একজন মানুষের সার্বিক সুস্থতার জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো তার চারিত্রিক দৃঢ়তা, সততা এবং সমুন্নত নৈতিক চেতনা।
মানসিক যে-কোনো অসুস্থতা সারাতেও ইদানীং এ ইতিবাচক শক্তিগুলোর সফল প্রয়োগ ঘটানো হচ্ছে নানাভাবে। আর এ-ক্ষেত্রে বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও মনের শক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে যথাযথ নৈতিক শিক্ষাকেই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
চরিত্রের সংজ্ঞা কী? একজন মানুষের ব্যক্তিত্বই কি তার চরিত্র? সাধারণভাবে তেমনটাই মনে করা হলেও বিষয়টা কিন্তু আসলে তা নয়। ইংরেজি ‘পারসোনালিটি’ শব্দটি এসেছে ‘পারসোনা’ থেকে যার শাব্দিক অর্থ ‘মুখোশ’। যা আপনি বলেন বা বিশ্বাস করেন তা নয়; মূলত চরিত্র হচ্ছে তা-ই, যা আপনি করেন অর্থাৎ যে আচরণগুলোতে আপনি নিত্য-অভ্যস্ত।
দৈনন্দিন জীবনে আমরা যা করি, সোজা কথায়, আমাদের অন্তর্গত সত্তার প্রকৃত ধরনটিই আসলে আমাদের চরিত্র। আর ভালো ও উন্নত চরিত্রের অন্যতম প্রধান শর্তটাই হলো ভালো কাজ-যত কঠিন আর ঝুঁকিপূর্ণই তা হোক না কেন। আর আপনি নিজে যে আচরণ অন্যের কাছে প্রত্যাশা করেন না, তা অন্যের সাথে করাটা কখনোই সৎ-চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ নয়।
প্রাচ্যের হাজার বছরের নৈতিক-ঐতিহ্য ও শিক্ষার সাথে সুর মিলিয়ে তাই এ-কালের মনোবিদরাও বলছেন, যদি অন্যের কাছ থেকে ভালো আচরণ প্রত্যাশা করেন তবে আপনিও তা-ই করুন। এতে আপনার একটা অনুপম চারিত্রিক দৃঢ়তা গড়ে ওঠার সাথে সাথে পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডলেও আপনি পরিচিত হয়ে উঠবেন একজন সত্যিকারের ভালো মানুষ হিসেবে। ফলে আপনার চারপাশের পরিবেশও আপনার জন্যে ক্রমশ হতে থাকবে সুখকর, আনন্দময় এবং নিশ্চিতভাবেই কর্মোপযোগী।
অতএব আপনার সামাজিক প্রভাব বা প্রতিপত্তি যা-ই হোক না কেন, শুধু সদাচরণের পথ ধরেই সবার দৃষ্টিতে হয়ে উঠতে পারেন একজন ব্যতিক্রমী মানুষ; শ্রদ্ধাস্পদ তো বটেই। আপনার এই নৈতিকতাসম্পন্ন মূল্যবোধ অন্যদেরও প্রভাবিত করবে নিঃসন্দেহে।
গবেষকরা বলছেন, চরিত্র-শিক্ষার শুরু হওয়া উচিত শৈশব থেকেই। আর এ দায়িত্ব মা-বাবার একার নয়। মা-বাবা, আত্মীয়-পরিজন, শিক্ষক এমনকি স্কুলের কর্মচারী অর্থাৎ শিশু যাদেরই সংস্পর্শে আসবে সকলের কিছু না কিছু ভূমিকা রয়েছে শিশুর চরিত্র গঠনে।
তবে এ শিক্ষার ক্ষেত্রে ‘যা বলছি তা-ই করো’ পদ্ধতিটি পুরনো একটি পদ্ধতি। ভীতিকর এ পন্থায় শিশুর আচার-আচরণে কিছু ক্ষণস্থায়ী পরিবর্তন হয়তো হয়ে থাকে কিন্তু তা কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কারণ এটি তার মনোজগতকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে খুব সামান্যই। তাই নির্দ্বিধায় আপনি এ পদ্ধতিটি বাদ দিতে পারেন। কারণ এর চেয়ে ঢের ভালো পদ্ধতি আছে আপনার সন্তানকে সচ্চরিত্র করে গড়ে তোলার।
আপনি তাকে কী বলছেন সেটা নয়, বরং আপনার সন্তান প্রতিনিয়ত লক্ষ করে আপনি কী করছেন। আপনার অজান্তেই তার ক্ষুদে চোখ, কান, মনস্তত্ত্ব দিয়ে সে নীরবে প্রত্যক্ষ করছে আপনার সমস্ত আচরণ ও কথাবার্তা। আপনাকে অনুসরণীয় মনে করে বলেই সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এমনটা করে থাকে। তার প্রতি আপনার উৎসাহ, সহনশীলতা, কথোপকথন সবকিছুই তাকে দারুণ প্রভাবিত করে।
ব্যাপারখানা অনেকটা এমন যে, শিশুকে চরিত্র শেখানো যায় না, সে নিজেই তা শিখে নেয়। তাই সন্তানের দৃষ্টিতে যদি অনুকরণীয় হতে চান, তবে তাকে যা করতে বলছেন নিজেও তা-ই করুন। তাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে শেখান ক্ষমা আর সমমর্মিতার মতো মহত্তম গুণগুলো। এতে তার অন্তর্গত সত্তা ক্রমশ বিকশিত ও আলোকিত হয়ে উঠবে।
এ-ছাড়াও গল্প বলার ছলে শিশুকে কোনোকিছু শেখানোটা বেশ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে শিশু-মনোবিজ্ঞানীদের অনুসন্ধানে। প্রতিদিন না হোক, সপ্তাহে অন্তত যে-কদিন যখনই সময় পান আপনার শিশুসন্তানটিকে সময় দিন। আমাদের নৈতিক সংস্কৃতির আবহে রচিত চিরন্তন গল্প, ঘটনা, উপাখ্যানগুলো তাকে শোনান। এর মর্মকথাটা তাকে বুঝিয়ে বলুন। গল্পগুলোর অন্তর্নিহিত নৈতিক শিক্ষা তাকে পরিশ্রমী, বাস্তববাদী ও চরিত্রবান হতে অনুপ্রাণিত করবে। আর এভাবেই তার সাথে গড়ে উঠবে আপনার এক চমৎকার বোঝাপড়ার সম্পর্ক। গল্পের শেষে তার কাছ থেকে এ বিষয়ে মতামত জানতে চান। জিজ্ঞেস করুন, সে কী বুঝল কিংবা গল্পের কোন অংশটি তার সবচেয়ে ভালো লেগেছে এবং কেন? এতে আপনিও তাকে সহজেই বুঝতে পারবেন।
প্রযুক্তির আগ্রাসন আর শত কাজের ব্যস্ততায় শিশুর চরিত্র গঠনে বর্তমানে আমরা প্রায় নিষ্ক্রিয় ভূমিকাই পালন করেছি। কিন্তু যেসব মা-বাবা সচেতনভাবে এ লক্ষ্যে সন্তানদের সময় দিচ্ছেন তারা নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমান ও সফল। এ উদ্যোগ একদিকে যেমন তাদের সন্তানদের মাঝে সমমর্মিতা, সহানুভূতি ও সামাজিক দায়িত্ববোধের জন্ম দিচ্ছে তেমনি এর ফলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সুস্থ, সৎ ও আত্মনির্ভরশীল নাগরিক সৃষ্টির মাধ্যমে উপকৃত হবে দেশ ও সমাজ।