গেমিং ডিজ-অর্ডার : আপনার সন্তান নিরাপদ তো?

মেধাবী এক কিশোরের গল্প...

৯ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী তৈমুর ইসলাম (ছদ্মনাম)। ৫ম ও ৮ম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি এবং জেএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ-প্লাস পেয়েছিল। করোনাকালে ক্লাস-পরীক্ষা না থাকায় সময় কাটাতে ভিডিও গেমের দিকে ঝোঁকে। কিছুদিনের মধ্যে আসক্ত হয়ে পড়ে পাবজি গেমে। দিনের বেশিরভাগ সময় কাটাতো গেম খেলে। পরবর্তীতে একটি কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। হ্যাং-আউট, বখাটেপনা, মাদক সেবন চলে নিয়মিত। নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বাবা-মা বাধ্য হয়ে তাকে কিশোর সংশোধনাগারে পাঠায়।  

তৈমুরের মতো অবস্থা এখন অনেক ছেলেমেয়েরই। ভিডিও গেম নামক বিষবৃক্ষ করোনাকালে তার ডালপালা আরো বিস্তৃত করে হানা দিয়েছে শিশু-কিশোর-তরুণদের মনোজগতে। পরিণামে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের লেখা-পড়া ও মেধার বিকাশ, সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা।

তরুণদের আগ্রাসী করে তুলছে সহিংস গেমস

করোনাকালে তরুণ প্রজন্ম সবচেয়ে বেশি যে কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার একটি হলো ভিডিও গেম আসক্তি।

অনলাইন ক্লাসের সুবাদে হাতে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট পাওয়ায় অনেক শিক্ষার্থীই পাবজি বা ফ্রি ফায়ারের মতো সহিংস ইন্টারনেট গেমে আসক্ত হয়ে পড়েছে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, এসব গেম তাদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তাদের আগ্রাসী করে তুলছে। তাদের মধ্যে সৃষ্টি করছে অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা, সহিংসতা ও অপরাধ প্রবণতা।

২০১৯ সালের ১৫ই মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে ঢুকে গুলি করে হত্যাযজ্ঞ চালানো এবং সেই দৃশ্য ফেসবুক লাইভে প্রদর্শনের আইডিয়াটিকে অনেকেই বলছে পাবজি দ্বারা অনুপ্রাণিত।

এ-বিষয়ে আরো পড়ুন-

ভুল বিনোদন॥ ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ পরিণতি

গেমের খরচ যোগাতে কেউ কেউ পা বাড়াচ্ছে অপরাধ জগতে

অনলাইন গেম বেশ খরুচে। স্মার্টফোন ও মোবাইল ডাটার দাম তো আছেই, সাথে কিছু কিছু গেমের একেকটি চরিত্র কিনতে চার-পাঁচশ’ টাকা লাগে। ফ্রি ফায়ারে ভার্চুয়াল অস্ত্র কিনতে লাগে দুইশ’ থেকে ৪ হাজার টাকা।

অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা এই বিপুল পরিমাণ অর্থ জোগাড় করতে পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি করছে। টাকা না পেয়ে কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ছে চুরি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধমূলক কাজে।

বেশ ক’বছর যাবত যে ‘কিশোর গ্যাং কালচার’ দেশের সমাজবিদ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিতদের মাথাব্যাথার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তার অন্যতম কারণও কিন্তু অনলাইন গেম।

একটানা গেমিং সৃষ্টি করছে শারীরিক ও মানসিক নানান জটিলতা

দীর্ঘসময় গেমিংয়ে হাত ও কনুইয়ের পেশী ও পেশীবন্ধনীতে (tendon) ব্যথা ও প্রদাহ সৃষ্টি হয়, যা চলতে থাকলে একটা সময় দুর্বলতা ও অসাড়তাসহ স্থায়ী জখম হতে পারে। ব্যথা হতে পারে কাঁধ, ঘাড় ও পিঠেও। গেমাররা কারপেল টানেল সিন্ড্রোমেও বেশি ভোগেন, যার ফলে কব্জিতে ব্যথা ও অসাড়তা দেখা দেয়।  

চোখ জ্বালাপোড়াসহ দৃষ্টিজনিত সমস্যাগুলোও গেমারদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। একটানা অনেকক্ষণ স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকার কারণে অনেকেই আক্রান্ত হয় কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোমে, যার কারণে দৃষ্টি আচ্ছন্ন ও ঘোলা হয়ে আসা, ডাবল ভিশন, চোখ শুকিয়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দেয়।

লম্বা সময় দৈহিকভাবে নিষ্ক্রিয় থাকায় গেমারদের মধ্যে আরো যে-সব স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছে তার মধ্যে আছে মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব, উদ্বেগ-উৎকন্ঠা, বিষন্নতা ইত্যাদি। টিনেজারদের মধ্যে আশংকাজনক হারে মেদস্থূলতা বেড়ে যাওয়ার কারণও এই শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা। আর নিয়মিত রাত জেগে খেলার দরুন গেমারদের বড় একটি অংশ ভুগছে অনিদ্রা ও ঘুমের ব্যাঘাতে।

এ-বিষয়ে আরো পড়ুন-

নিয়মিত রাত্রি জাগরণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে

দেশে মেদস্থূলতার হার বাড়ছে! সচেতন হোন এখনই

সচল থাকুন ॥ সুস্থ থাকুন গতিশীলতাই সুখ, তাতেই সুস্বাস্থ্য   

দীর্ঘক্ষণ গেমিংয়ের কারণে খিঁচুনি এবং তা থেকে হেমারেজ বা রক্তক্ষরণের ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে। সম্প্রতি ভারতের পন্ডিচেরীতে ১৬ বছরের এক কিশোর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মারা যায়, যার কারণ ছিল টানা ৪ ঘণ্টা গেমিং। 

আত্মহত্যার নেপথ্যে গেম আসক্তি

কয়েক বছর আগে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলে দিয়েছিল অনলাইন গেম ‘ব্লু হোয়েল’। এতে অংশগ্রহণকারীদের প্রতিদিন একটি করে চ্যালেঞ্জ দেয়া হতো, যার সর্বশেষটি ছিল আত্মহত্যা। একটি রিপোর্টে ব্লু হোয়েলে অংশ নেয়া অন্তত ১৩০ গেমার আত্মহত্যা করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে গেম চ্যালেঞ্জ নয়, ইদানিং গেমারদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন কারণে- আসক্তি!

দেশে কেবল গত মে মাসেই ভিডিও গেমকে কেন্দ্র করে আত্মহত্যা করেছে অন্তত ৬ জন, যাদের বয়স ১২ থেকে ১৮। কেউ বাবা-মা গেম খেলতে দেয় নি বলে, কেউ গেম খেলতে মোবাইল চেয়ে না পেয়ে, কেউ মা ডাটাপ্যাক কেনার টাকা না দেয়ায়, আবার কেউ গেম খেলা নিয়ে বাবা-মায়ের বকাঝকায় অভিমান করে। 

আসলে এই সংবাদগুলো নেহায়েত দুর্ঘটনা নয়, বরং ভয়াবহ আশংকার কথা জানান দিচ্ছে। সামান্য গেম খেলাকে জীবনের চেয়েও বড় মনে করছে কেন এই ছেলেমেয়েগুলো? কারণ গেমিং কেবল বিনোদন নয়, পরিণত হয়েছে আসক্তিতে, যা ঘটাচ্ছে মনোবিকার। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর নাম দিয়েছে ‘গেমিং ডিজ-অর্ডার’

আসলে গেমিং আসক্তি গেমারদের মধ্যে মাদকাসক্তির মতোই অদম্য তাড়না সৃষ্টি করে। মাদক খারাপ বোঝার পরও এতে আসক্তরা যেমন মাদক সেবন ছাড়তে পারে না, তেমনি গেমিং খারাপ জানার পরও অনেকেই এ-থেকে সহজে বেরিয়ে আসতে পারে না। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গেমিং আসক্তিকে মানসিক রোগ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, এবং ২০১৮ সালে International Classification of Diseases-এর একাদশ সংস্করণে (ICD-11) ‘গেমিং ডিজ-অর্ডার’ নামে তালিকাভুক্ত করেছে।

কীভাবে বুঝবেন আপনার সন্তান গেমিং ডিজ-অর্ডারে ভুগছে?

গেমারের মধ্যে যে ৩টি বৈশিষ্ট থাকলে সে গেমিং ডিজ-অর্ডারে ভুগছে বলে WHO উল্লেখ করেছে তা হলো-  

১. গেমিং-এর ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা,

২. গেমিংকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া। অর্থাৎ, অন্যান্য আগ্রহের বিষয় ও প্রাত্যহিক কাজকর্মের চেয়ে অগ্রাধিকার থাকে গেম খেলা, এবং

৩. নেতিবাচক প্রভাব বা পরিণাম সত্ত্বেও গেমিং অব্যহত রাখা বা আরো বাড়িয়ে দেয়া।   

এই বৈশিষ্ট্যগুলোর ছিঁটেফোটাও যদি আপনি সন্তানের মধ্যে দেখে থাকেন তাহলে অবিলম্বে তাকে নিবৃত্ত করুন।

গেমিং আসক্তিমুক্তিতে অভিভাবক হিসেবে আপনার করণীয়

গেমিং ডিজ-অর্ডারকে আর দশটা মানসিক অসুস্থতার মতো গ্রহণ করুন। সন্তানকে দোষারোপ, বকাঝকা বা মারধর করবেন না। কারণ এই মুহূর্তে তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই। আর নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আবেগপ্রবণ বিধায় চাপ দিলে ঘটতে পারে অঘটন।

ভালো হয় যদি গেমিংয়ের দুষ্টচক্রে পড়ার আগেই তাকে নিবৃত্ত করেন। এ-জন্যে অনলাইন ক্লাসের বাইরের সময়টাতে তাকে ভালো কাজে সম্পৃক্ত করুন। তা হতে পারে বই পড়া, বাগান করা বা অন্য কোনো সৃজনশীল কাজ।

আর যদি ইতোমধ্যেই গেমিংয়ে আসক্ত হয়ে থাকে তাহলে আপনার কাজ হবে বিচক্ষণতার সাথে পদক্ষেপ নেয়া। জোর করে ডিভাইজ কেড়ে নিলে বা একাউন্ট ডিলিট করাতে গেলে হতে পারে হিতে বিপরীত। তাছাড়া হাতের জিনিসটি কেড়ে নিতে হলে তাকে তো অন্য কিছু হাতে ধরিয়ে দিতে হবে!

সন্তানকে নিয়ে সপরিবারে ঘুরতে যান, তাকে গুণগত সময় দিন। দাবা লুডু ক্যারাম ইত্যাদি ঘরোয়া খেলা শিখিয়ে দিন এবং সম্ভব হলে আপনিও তার সাথে খেলায় অংশ নিন। তবে সবচেয়ে ভালো হয় যদি বন্ধুদের সাথে মাঠের খেলায় সে অংশ নেয়।

সেই সাথে তাকে সাদাকায়নে নিয়ে আসুন। সৃষ্টির সেবামূলক কাজগুলোতে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করুন। সঙ্ঘের ইতিবাচক আবহে থাকলে সে নিজেই তৎপর থাকবে অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর কাজ থেকে বিরত থাকতে।

আরো পড়ুন-

খুলছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : অভিভাবক ও শিক্ষক হিসেবে আপনার করণীয় কী?

যে ৮টি কারণে শিক্ষার্থীদের মেডিটেশন করা দরকার

বাবা-মা আমাকে বোঝে না