published : ২২ জুলাই ২০২২
একটি হিসাবে বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ, যাদের মধ্যে ৮০ ভাগের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ, কিশোর ও তরুণ। স্বভাবগতভাবে এই বয়সের ছেলেমেয়েরা একটু বেশিই কৌতূহলী হয়ে থাকে। আর বাড়তি কৌতূহলই কখনো কখনো তাদের টেনে নেয় নেশার জগতে।
আহসানিয়া মিশন পরিচালিত একটি জরিপে অংশ নেয়া মাদকাসক্তদের মধ্যে ৪২ শতাংশ-ই স্রেফ কৌতূহল থেকে প্রথম মাদক গ্রহণ করেছে বলেছে জানিয়েছে।
মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র 'মুক্তি'র ড. আলী আসকর কুরায়েশি বলেন, “কিশোর বয়সে বা শৈশবে নতুন কিছু নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে চাওয়ার মধ্যে দিয়ে অনেক সময় এর (নেশা) শুরু। মাদকদ্রব্য একটি নিষিদ্ধ দ্রব্য; আর নিষিদ্ধ দ্রব্যের প্রতি আকর্ষণ কিশোর বয়সে একটু বেশিই থাকে।”
‘ওরা (বন্ধু বা কাছের মানুষ) নেশা করে কী মজা পায়, দেখি না একটু!’,
‘জীবনে সবকিছুই একবার ‘টেস্ট’ করা উচিৎ!’,
‘একবার চেখে দেখি; এই প্রথম এই শেষ!’
এরকম অজস্র বাহানায় প্রথম দফায় নেশাদ্রব্য সেবন করে বিশেষত অল্প বয়সীরা। প্রথমবারে মজা পাক বা না পাক, আবারো মাদক গ্রহণের তাড়না তৈরি হয় ভেতর থেকে, যা অগ্রাহ্য করা সম্ভব হয় না বেশিরভাগের পক্ষেই। পরিণতিতে নেশার চোরাবালি তাদের টেনে নেয় অন্ধকার গহ্বরে।
আসলে চোরাবালিতে পা জেনেবুঝে রাখুন বা না বুঝে, আপনি তলিয়ে যাবেনই। মাদকাসক্তির ক্ষেত্রে কথাটি শতভাগ প্রযোজ্য।
বিজয় সিমহা। পেশায় একটি সংবাদমাধ্যমের এক্সিকিউটিভ এডিটর। ছোটবেলা থেকে সে এতটাই মেধাবী ও করিৎকর্মা যে তার বন্ধুদের মায়েরা তাকে দেখিয়ে ছেলেদের বলত “বিজয়ের মত হ!”
বিজয়ের বয়স তখন ১৩/১৪। একদিন এক বন্ধু বললো, তার বাবা কাবার্ডে একটা বোতল রেখেছে। চল একটু চেখে দেখি! বিজয়ের বেশ কৌতূহল হলো। প্রথম চুমুকে কেমন যেন সুখ সুখ অনুভূতি!
কলেজে ওঠার পর আরেক বন্ধু ‘ড্রিংকস’ অফার করলে মুহূর্তেই ছোটবেলার অনুভূতি তাকে ট্রিগার করে। এরপর থেকে মাসে একবার, তারপর প্রতি শনিবার। এভাবে মাদক হয়ে গেল তার রোজকার জীবনের অঙ্গ।
লেখাপড়া শেষে চাকুরিতে ঢুকলো বিজয়। কিন্তু ততদিনে তার জীবন ওলট-পালট হয়ে গেছে। পেশাজীবনে কাজের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আসক্তির মাত্রা। একটা পর্যায়ে চাকুরি চলে গেল। পরিবার-পরিজন এমনকি বাবা-মায়ের সাথে দূরত্ব তৈরি হলো।
নেশার টাকা জোগাতে ধার-কর্জ করতে শুরু করলো বন্ধু-আত্মীয়, এমনকি বাড়ির কাজের বুয়ার কাছ থেকেও। ফলে পরিচিতজনেরা তার থেকে দূরে সরে গেল। একটা পর্যায়ে ঘর ছেড়ে রাস্তায় নামতে হলো তাকে। তবে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হলেও বন্ধ হয় নি নেশা!
দেহমনের সুস্থতা বিসর্জনের পাশাপাশি অর্থনাশ, চাকুরি থেকে বরখাস্ত, আপনজনদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ, সম্মাননাশ- সবই বিজয়ের হয়েছে স্রেফ নেশার কারণে।
মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র থেকে ফেরার পর জীবনের ট্রাজিক ইতিহাস এভাবেই বর্ণনা করেন বিজয় সিমহা। অবশ্য এটা শুধু এক বিজয়ের কাহিনী নয়, এটা প্রায় সকল মাদকাসক্তের জীবনগাঁথা।
সিগারেট, ভেপিং, মাদক- এই ক্ষতিকর বস্তুগুলোকে কারো কারো কাছে বেশ আকর্ষণীয় মনে হয়। কারণ নাটক-সিনেমায় উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মানুষদের মদ্যপান করতে দেখানো হয় খুব স্বাভাবিকভাবে। আর নায়কের ঠোঁটে সিগারেট যেন হিরোইজমের ট্রেডমার্ক! ফলে একটু উচ্চাভিলাষী তরুণেরা অবচেতনে তাদেরকেই অনুকরণ করতে শুরু করে।
আবার উচ্চশিক্ষার্থে বাড়ির বাইরে এসে নিজেকে বাঁধনছাড়া মনে করে অনেক তরুণ। স্বাধীন জীবনের শুরুতেই নতুন অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে গিয়ে নেশাকে প্রশ্রয় দিয়ে ফেলে। সম্প্রতি দেশের একটি খ্যাতনামা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাদকদ্রব্য এলএসডি সেবনের পর বেসামাল হয়ে নিজেই নিজেকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যার পর বিষয়টি আলোচনায় আসে।
আসলে মাদক তাৎক্ষনিক মৃত্যু না ঘটালেও মরণ ঘটায় সম্ভাবনাময় জীবনের। যার খেসারত দিতে হয় জীবনভর।
মাদকাসক্ত, বিশেষত যারা অল্প বয়সে মাদকে জড়িয়েছে, তাদের বেশিরভাগই আসক্ত হয় বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে। কখনো কৌতূহলী হয়ে, কখনো ‘পিয়ার প্রেশারে’ নেশার জগতে পা বাড়ায় কেউ কেউ।
বন্ধুত্ব অবশ্যই ভালো, যদি একে কল্যাণকর কাজে লাগানো হয়। প্রকৃতই যে বন্ধু সে সবসময় বন্ধুর জন্যে ভালোটাই করে। যে নেশার দিকে ডাকে সে আর যাই হোক বন্ধু হতে পারে না।
তাই বন্ধুত্ব রক্ষা করতে গিয়ে ক্ষতিকর কোনো কাজে বা অভ্যাসে জড়াবেন না। মনে রাখবেন, আপনার জীবনের দায়িত্ব শুধুই আপনার। নিজেকে বিকশিত করতে হবে আপনার নিজেকেই। অসৎসঙ্গে পড়ে যদি আপনি নিজেকে গড়তে ব্যর্থ হন তাহলে তার ফল আপনাকেই ভোগ করতে হবে। যাদের পাল্লায় পড়ে আপনি বিগড়েছেন, নিশ্চিত থাকুন বিপদের দিনে আপনি পাশে পাবেন না তাদের কাউকেই।
থার্টি ফার্স্ট নাইট, জন্মদিন, বিবাহোত্তর সংবর্ধনা ইত্যাদি উপলক্ষে বন্ধুদের নিয়ে মাদক গ্রহণের প্রবণতা এখন অনেকের মধ্যেই দেখা যায়। অনেক সময় অভিভাবকেরা বিষয়টি জেনেও প্রতিক্রিয়া দেখান না। ভাবখানা এমন- প্রতিদিন তো আর খাচ্ছে না; বছরের দুয়েকটা দিন এক-আধটু ‘ড্রিংক’ করলে কী আর হয়!
আসলে সামান্য একটি ছিদ্র-ই পারে বিশাল একটি জাহাজকে ডুবিয়ে দিতে। তেমনি ক্ষতিকর কাজে আপনার এক-আধটু ছাড় সূত্রপাত ঘটাতে পারে বড় কোনো বিপর্যয়ের। তাই 'বিশেষভাবে উদযাপনের' বাহানায় ড্রাগস নিয়ে নিজেই নিজের সর্বনাশ করবেন না।