published : ১৯ অক্টোবর ২০২৪
ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন ট্রমা আর সাধারণ মনের বেদনা এক না। এটা এমন একটা অনুভূতি যা অসহ্য কষ্টদায়ক। যার উৎস নির্যাতন-সহিংসতা, প্রিয়জন হারানো বা বিচ্ছেদ, দুর্ঘটনা, বুলিং-র্যাগিং, দুর্যোগ। যা একজন মানুষ বয়ে চলেন দিনের পর দিন।
ট্রমার ফলে যেসব শারীরিক-মানসিক প্রতিক্রিয়া হয় সেগুলোর মধ্যে অত্যন্ত তীব্র হলো পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিস-অর্ডার, সংক্ষেপে PTSD।
নাম থেকেই বুঝতে পারছেন এটা এমন এক ধরণের মানসিক জটিলতা যা কোনো ট্রমা বা ভয়ানক ঘটনার পরে উদ্ভব হয়।
ভয়ানক ঘটনায় কেউ ভয় পাবে এটাই স্বাভাবিক।
আমাদের শরীরে ‘ফাইট-অর-ফ্লাইট রেসপন্স নামে একটি প্রক্রিয়া আছে- বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে প্রতি-আক্রমণ অথবা পলায়ন- বিপদ মোকাবেলার এই প্রক্রিয়া প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আমরা আমাদের ডিএনএ-তে বয়ে চলেছি। ভয়ের ঘটনায় তাৎক্ষণিক ভয় পাওয়া এই প্রতিক্রিয়ারই অংশ।
এমনকি ঘটনাটি ঘটার পর কিছুকাল রয়ে যেতে পারে ভয়ের আবেশ। কিন্তু দিনের পর দিন যদি সেই ঘটনার কথা মনে ঘুরেফিরে আসতে থাকে; সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যদি ঘুমের মধ্যে, এমনকি জাগ্রত অবস্থাতেও আঁতকে আঁতকে উঠতে থাকে বা প্রায়শই ঘটনার ফ্ল্যাশব্যাক হতে থাকে তাহলে তা আর স্বাভাবিক থাকে না।
এই অস্বাভাবিক বা জটিল মানসিক অবস্থার নামই পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিস-অর্ডার।
যে-কোনো বয়সের যে-কেউই আক্রান্ত হতে পারে। বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায় যুদ্ধফেরত সৈনিকদের, যারা খুব সামনে থেকে রক্তপাত, জখম, মৃত্যু, বর্বরতা প্রত্যক্ষ করেছে।
এছাড়াও, দৈহিক বা যৌন নিগৃহ-নিপীড়নের শিকার মানুষ, মারাত্মক দুর্ঘটনা বা দুর্যোগ, খুন-জখমের মতো সিরিয়াস ঘটনার মধ্য দিয়ে যাওয়ারাও আক্রান্ত হতে পারে PTSD-তে।
নিজে আক্রান্ত না হওয়ার পরও শুধু প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার কারণে, এমনকি এ-ধরণের সংবাদ জানার ফলেও সৃষ্টি হতে পারে পিটিএসডি, যেটা আমরা বর্তমানে দেখতে পাচ্ছি আশেপাশের অনেকের মধ্যে।
ঘটনাটা হয়ত ঘটে গেছে অনেকদিন আগে, কিন্তু প্রায়শই মনে হয় ঘটনাটা এখনই ঘটছে- ট্রমা ও PTSD আক্রান্তদের ‘কমন’ অনুভূতি এটি। এছাড়াও যেসব লক্ষণ দেখা যায়-
শিশুদের মানসিক ট্রমার পরিণতি একটু দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। এতে তাদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, আবেগিক ভারসাম্য হতে পারে বিঘ্নিত।
লক্ষণগুলো ঘটনা ঘটার ৩ মাসের মধ্যে ঘটতে পারে, আবার বহু বছর পরও ঘটতে পারে যখন তার সাথে বা তার সামনে সমরূপ ঘটনা আবার ঘটে বা ঘটনার কথা শোনে।
১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ দৈনিক ইত্তেফাকের একটি রিপোর্টে বলা হয়, দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে গত ১৬ই জুলাই থেকে দেশে ঘটে যাওয়া সহিংসতা প্রত্যক্ষ করেছে সব বয়সের মানুষ।
হঠাৎ এত লাশ, রক্তের বন্যা! কিশোর-তরুণদের চোখ হারানো, হাত-পা হারানো। গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ, টিয়ার শেলের ধোঁয়া। বড় বড় ধারালো অস্ত্র দেখেছে কোমলমতি শিশুরাও।
এক শিক্ষার্থী বলেন, “এত বীভৎস দৃশ্য এর আগে দেখি নি। খেতে বসলেই রক্ত দেখি। ঘুমাতে গেলেই মায়েদের কান্না শুনি। হাসপাতালের আর্তনাদ শুনি। রাতে ঘুমের মধ্যে এসব নিয়ে দুঃস্বপ্নও দেখছি।”
একজন সংবাদকর্মী বলেন, “খবরের সন্ধানে সারাক্ষণই এসব সহিংসতার খোঁজ রাখতে হয়। এখন নিজের অজান্তেই মিছিলের শব্দ শুনতে পাই। শব্দ শুনলেই মনে হয় আবার কি কোথাও গুলি বা সাউন্ড গ্রেনেড পড়ছে!”
ট্রমাগ্রস্ত ব্যক্তির এখন পরিবার পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষকদের মেন্টাল সাপোর্ট প্রয়োজন। সেই সাথে প্রয়োজন খাপ খাইয়ে নেয়ার মানসিক শক্তি অর্জন। আর একাজে দারুণ কার্যকর হলো মেডিটেশন।
বলতে পারেন, বসে বসে মেডিটেশন করলেই কি ট্রমা কেটে যাবে?
জ্বি যাবে! কথার কথা না, এই দাবির পেছনে আছে গবেষণালব্ধ ফলাফল।
সাইকিয়াট্রিস্ট Dr. John L. Rigg ২০০৮ সালে আইজেনহাওয়ার আর্মি মেডিকেল সেন্টারে কাজ শুরুর অল্প সময়ের মধ্যেই অনুধাবন করেন, PTSD রোগীদের ক্ষেত্রে এন্ট্রি-ডিপ্রেসেন্ট এবং এন্টি-অ্যাংজাইটি ড্রাগ তেমন কার্যকর না। তার উদ্যোগে ২০১২ সালে আইজেনহাওয়ারের চিকিৎসা প্রক্রিয়ার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় মেডিটেশন।
প্রথমটায় PTSD আক্রান্ত সৈনিকেরা সংশয়ে ভুগলেও কিছুদিন মেডিটেশন করার পর তারা জানায় যে এখন তারা আগের চেয়ে কম খিটখিটে বোধ করছে, ঘুম ভালো হচ্ছে এবং আন্তব্যক্তিক সম্পর্কও উন্নত হয়েছে।
গবেষণাটি পরিচালিত হয় সামরিক বাহিনীর ৭৪ সক্রিয় সদস্যের ওপর যারা PTSD-তে ভুগছিল এবং এজন্যে চিকিৎসা নিচ্ছিল। তাদের অর্ধেককে শুধু সাইকিয়াট্রিক ওষুধ দেয়া হয়। বাকি অর্ধেককে ওষুধের পাশাপাশি ২০ মিনিট করে দিনে দুবার করানো হয় মেডিটেশন।
১ মাস পর দেখা গেল যারা ওষুধের পাশাপাশি মেডিটেশন করেছে তাদের প্রায় ৮৪ ভাগই ওষুধ কমাতে, অনেকে বাদও দিতে পেরেছেন।
অন্যদিকে, যারা মেডিটেশন করেন নি তাদের মধ্যে বড় কোনো পরিবর্তন আসে নি। বরং প্রায় ৪১ ভাগের ওষুধের ডোজ আরো বাড়াতে হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়মিত মেডিটেশন ব্রেইনের প্যারাসিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেমের এমন একটি কর্মপ্রক্রিয়াকে তৎপর করে তোলে যা স্ট্রেস হরমোন যেমন কর্টিসোল, অ্যাড্রেনালিন ইত্যাদির নিঃস্বরণ কমায়। ভয় এবং স্ট্রেসের জন্যে দায়ী এই হরমোনগুলো।
অন্যদিকে, ‘ফাইট-অর-ফ্লাইট’ রেসপন্সকে উদ্দীপ্তকারী সিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেমকে শান্ত করে মেডিটেশন।
আসলে ট্রমা সবসময় মনোজগতে ঝড় তুলে মন ও ব্রেনকে এলোমেলো করে দেয়। আর মেডিটেশন অগোছালো ব্রেন এবং মনকে রিটিউনড, মানে গোছালো সুবিন্যস্ত ও শক্তিশালী করে।
আতঙ্কমুক্ত থেকে সময়কে কাজে লাগাতে পেরেছি
তাই যাদের মধ্যেই ট্রমা ও PTSD কাজ করছে, তাদেরকে মেডিটেশনে উদ্বুদ্ধ করুন; নিয়ে আসুন সাদাকায়নে। নিয়মিত মেডিটেশন এবং কোয়ান্টামের ইতিবাচক মানুষদের সান্নিধ্য তাকে ধীরে ধীরে মুক্ত করবে সকল ধরণের ট্রমা ও পিটিএসডি থেকে।
তবে ট্রমামুক্তির পথে সবচেয়ে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ হলো চারদিনের কোয়ান্টাম মেথড কোর্সে অংশগ্রহণ। কেউ চারদিন টানা ৪০ ঘন্টার এই কোর্সে অংশ নিলে নিঃসন্দেহে তার মন ও ব্রেন হবে প্রশান্ত ও গোছালো, তিনি ফিরে আসবেন ট্রমামুক্ত সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে।