ভুল প্যারেন্টিং : আপনার সন্তান কি প্যারেন্টিফিকেশন ট্রমায় ভুগছে?

published : ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

প্যারেন্টিফিকেশন ট্রমা কি? 

একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দায়িত্ব, কর্তব্য এবং মানসিক দায়িত্বভার যখন একটি শিশুকে বহন করতে দেয়া হয়, তখন অনেক ক্ষেত্রেই সেই শিশুটি হয়ে পড়ে ভারাক্রান্ত, আতঙ্কগ্রস্ত। শিশুর এই মানসিক অবস্থাকেই মনোবিশ্লেষকরা বলছেন ‘প্যারেন্টিফিকেশন ট্রমা’। 

প্যারেন্টিফিকেশন ট্রমার ধরন কয়টি তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা মুশকিল। কারণ একেক পরিবারের প্যারেন্টিং স্টাইল একেক ধরন। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন আবেগিক, ব্যবহারিক এবং আর্থিক প্যারেন্টিফিকেশনই প্রধান। 

আবেগিক প্যারেন্টিফিকেশনে একটি শিশু বা কিশোর বাবা-মা/অভিভাবকদের আবেগিক চাহিদা পূরণ করতে চায়। ব্যবহারিক প্যারেন্টিফিকেশনে বয়সের তুলনায় বেশি দৈনন্দিন কাজকর্মে সহায়তা করতে চায়। আর আর্থিক প্যারেন্টিফিকেশনে সে চায় পরিবারের আর্থিক দায়িত্ব মেটাতে। 

কীভাবে বুঝবেন আপনার সন্তান এই ট্রমায় আক্রান্ত? 

যদি দেখেন আপনার সন্তান সমবয়সীদের তুলনায় বেশি দায়িত্ব নেয়ার তাড়না অনুভব করছে এবং নিজেই নিজের ও পরিবারের অভিভাবক হয়ে উঠছে তখনই সচেতন হোন। কারণ থেরাপিস্টদের মতে, এই অবস্থা থেকেই পরবর্তীতে সৃষ্টি হতে পারে প্যারেন্টিফিকেশন ট্রমা! শিশুসুলভ আবেগকে প্রাপ্ত বয়স্কদের আবেগের সাথে মিলাতে সে হিমশিম খাচ্ছে, যা সে হয়ত বুঝতে দিচ্ছে না।  

সমীক্ষায় দেখা গেছে, অ্যাংজাইটি ও ডিপ্রেশনের ফলে সবকিছুতেই বিরক্তি, ঘুমের সমস্যা বা খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন দেখা দেয়া, হাসি বা কান্না, কষ্ট বা খুশি হবার মতো স্বাভাবিক আবেগ খুব সহজে প্রকাশ করতে না পারা, পরিবারের পূর্ণ বয়স্কের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেয়া, আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি, নিজ অভিভাবকদের প্রতি অভিযোগ এবং নিজেকে তাদের কাছে বন্দী মনে করা ইত্যাদি প্যারেন্টিফিকেশন ট্রমার চিহ্নিত লক্ষণ।

সন্তানের মধ্যে এই লক্ষণগুলো দেখলে করণীয় 

দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক সময় সম্পর্কে বোঝা বাড়িয়ে দেয়। তাই অল্প বয়সে পিতামাতার ভূমিকা পালন করা, একজন পরিণত প্রফেশনাল মানুষকেও ঘুণ পোকার মতো কাটতে পারে। কারণ এই ট্রমায় ভুক্তভোগিরা কখনো বলতে পারে না, আমার বাবা-মা বা অভিভাবক মানসিকভাবে অপরিণত! 

এই ট্রমা থেকে আপনার সন্তানকে বাঁচাতে হবে আপনাকেই। তাই পালন করুন কিছু করণীয়ঃ  

১. শিশুকালে সন্তানকে শিশুই থাকতে দিন  

শিশুকে পরিবারের অংশ করতে তাকে একটু একটু করে সংসারের কাজে অভ্যস্ত করা জরুরি। তবে তা যেন হয় তার বয়সের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। গৃহস্থালির কাজে অবদান রাখা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ; তবে প্রাপ্তবয়স্কদের দায়িত্ব বা মানসিক সমস্যার বোঝা তাদের বহন করতে দেয়া মোটেই উচিৎ নয়।

শিশুর সাথে তার বয়স উপযোগী কথা বলুন; তার সাথে ব্যক্তিগত, আর্থিক বা দাম্পত্য সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা এড়িয়ে চলুন। 

২. শৈশবকে লালন করার সুযোগ দিন 

শিশুদের খেলাধুলা ও মেলামেশা করা এবং তাদের নিজস্ব জগৎ তৈরি করার জন্যে সময় প্রয়োজন। এজন্যে তাকে উৎসাহী করা, কৌতূহল বাড়ানো, সৃজনশীলতা এবং শিক্ষণীয় কাজের সুযোগ করে দিন। 

বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করা, সাইকেল চালানো, মাঠে দৌড়ানো এবং শখের কাজগুলো নিয়মিত করার ব্যাপারে উৎসাহ দিন। খেলার মাঠ যেহেতু কমে যাচ্ছে, বিকল্প হিসেবে তাকে যোগব্যায়ামে উদ্বুদ্ধ করুন। সাথে নিজেও করুন। 

৩. সন্তানের আবেগিক ভরসাস্থল হোন 

বাবা-মা হিসেবে সন্তানের আবেগকে আপনার সম্মান করা উচিৎ। সে যেন আপনার কাছে নিরাপদ বোধ করে এবং যে-কোনোকিছু শেয়ার করতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখুন। সে যা-ই বলুক, তার আবেগের গোপনীয়তা রক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিন। 

খেলার মাঠ বা স্কুল-কলেজ থেকে ফিরলে সময় নিয়ে সন্তানকে জিজ্ঞাসা করুন, সে কেমন অনুভব করছে; আজ সারাটি দিন কেমন কাটলো।  

৪. বাসায় একটি সাপোর্ট সিস্টেম তৈরি করুন 

আপনি যদি একা পরিবারের দায়িত্ব পালন এবং পরিচালনা করতে হিমশিম খেয়ে থাকেন সেক্ষেত্রে শিশুর ওপর নির্ভরশীল না হয়ে সহযোগিতার জন্যে পরিবারের অন্যান্য প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যের সহযোগিতা নিন।  

যদি আর্থিক কষ্টের মধ্য দিয়ে যান তাহলে সন্তানকে মানসিক চাপে না ফেলে উপযুক্ত কারো পরামর্শ নিয়ে সমাধানের পথে এগোন।

৫. সন্তানের রোল মডেল হোন 

সচেতন বা অবচেতনভাবে সন্তানের রোল মডেল তার মা-বাবা। টাকা দিয়ে সন্তান মানুষ করা যায় না। শিশুর হাতে যদি বড় মানুষের জীবনী বা চিরায়ত গল্পের বই তুলে না দিয়ে দামী স্মার্টফোন আর ভিডিও গেমস তুলে দেন, সন্তানকে সময় না দিয়ে নিজে টিভি সিরিয়াল বা ইউটিউবে ডুবে থাকেন তাহলে কয়েক বছর পরে ‘সন্তান কেন কথা শোনে না’, ‘পড়ালেখা না করে সারাক্ষণ স্মার্টফোনে কেন বুঁদ হয়ে থাকে’- এ জাতীয় আফসোস করতে থাকবেন। 

তাই সন্তানের জন্যে নিজেকে তৈরি করুন। কথায় আছে, সন্তানের জন্যে মরতে পারে সবাই, কিন্তু বাঁচার মতো বাঁচতে পারে কজন! 

সন্তানকে শুদ্ধাচার শিক্ষা দিতে শুক্রবারে নিয়মিত সাদাকায়নে নিয়ে আসুন। জোর করে নয়, উদ্বুদ্ধ করে। সৎসঙ্ঘের সেবামূলক কার্যক্রমে সন্তান যেন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করতে আগ্রহী হয় সেজন্যে তাকে উদ্বুদ্ধ করুন।

আপনি সন্তানের আস্থার জায়গা হোন। আপনাকে সে যদি বিশ্বাস করতে পারে, আপনি যদি তার রোল মডেল হতে পারেন তাহলেই সে খুব সুন্দরভাবে বেড়ে উঠবে।