ননীর পুতুল নয়, সন্তান হোক লৌহ মানব

সে আপনার সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে প্রিয়। সে আপনার আনন্দ আর গর্বের অন্যতম কারণ। সে আপনার সন্তান। আর এই সন্তান জীবনে কতটা সফল হবে, তার মধ্যে কতটা ভালো মন্দের সঞ্চার হবে সেটা কিন্তু নির্ভর করছে তার বাবা মায়ের লালন পালনের উপরে।

আসলে সব বাবা-মা চান তার সন্তানকে সেরা উপায়ে গড়ে তুলতে। কিন্তু কখনো কখনো এক্ষেত্রে কিছু ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সব সন্তানই সেরা হয়ে উঠে না। এর একটি হচ্ছে সন্তানকে কষ্টসহিষ্ণু ও পরিশ্রমী করে গড়ে না তোলা। তাকে স্বনির্ভর ও শারীরিক শ্রমে অভ্যস্ত হতে না দেয়া।

অধিকাংশ বাবা মায়ের প্রবণতা হচ্ছে, ননীর পুতুলের মতো সন্তানকে আগলে রাখা। অতিরিক্ত আরাম আয়েশের মধ্য দিয়ে তাকে বড় করে তোলা। কিন্তু এতে যে তার সন্তান ফার্মের মুরগীরুপী মানুষে পরিণত হচ্ছে অর্থাৎ তার পরিপূর্ণ শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধা দিচ্ছে। এটা যেন বাবা মায়েরা জানলেও মানতে চান না।

তারা চান ছেলেমেয়েকে সারাক্ষণ লেখাপড়ার জগতে আটকে রাখতে। আর এর ফলে আজকালকার ছেলেমেয়েরা বেড়ে উঠছে বাস্তবজ্ঞানবর্জিত জীবন-জগৎ সম্পর্কে অনভিজ্ঞ একটা আবহে। যারা পরিশ্রম করতে জানে না। যারা সেই পরিতৃপ্তি সম্বন্ধে জানতে পারে না, যা কঠোর পরিশ্রম থেকে আসে। যারা সেই আত্মবিশ্বাস সর্ম্পকে জানতে পারে না, যা একজন মানুষ সমস্যা মোকাবিলা ও সমাধানের মধ্য দিয়ে অর্জন করে। যারা সেই শারীরিক শ্রম করতে অভ্যস্ত হয় না, যার ফলে সে আত্মনির্ভরশীল হয়ে গড়ে উঠবে। তাই এটা কিন্তু একজন বাবা মায়ের প্রকৃত দায়িত্ব তার অল্পবয়সী সন্তানকে এমন কাজের সুযোগ করে দেয়া, যা তাকে কষ্টসহিষ্ণু ও পরিশ্রমী করবে। ফলে তার মধ্যে গড়ে উঠবে এমন গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি, যা তার সারা জীবনের জন্যে সুফল নিয়ে আসবে। তাকে পরিচিত করবে ননীর পুতুল নয় বরং লৌহ মানুষ হিসেবে।

আপনার সন্তানকে তাই ছোটবেলা থেকেই পরিশ্রমে অভ্যস্ত করে তুলুন। একটু একটু করে দায়িত্ব দিয়ে তাকে স্বাবলম্বী করে তুলুন। তার কাজ যতটা সম্ভব তাকেই করতে উদ্বুদ্ধ করুন। কীভাবে? সেটা কিন্তু খুব সহজ । আসলে মা-বাবা যা বলেন সেটা নয়, মা-বাবা যা করেন সন্তান তাই শেখে। যেমন, সন্তান যদি ছোটবেলা থেকে দেখে যে ঘর গুছিয়ে রাখা হয়, সে-ও জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে শিখবে। যদি দেখে ঘরে জুতোটাকে এইভাবে রাখা হয়, সে-ও তাই রাখবে। কিন্তু সে যদি দেখে বাবা হয়ে আপনি ঘরে ঢুকে জুতো একটা এইদিকে ছুঁড়ে মারলেন, আরেকটা ঐদিকে কিংবা শার্ট খুলে বিছানায় দলা পাকিয়ে রাখলেন, সে-ও তাই করবে। তাই শুরুতইে আপনি তার রোল মডেল হতে চেষ্টা করুন।

অল্প বয়সে বাচ্চারা ঘরের কাজ করার মত সমর্থ্য না হলেও তাদের কিন্তু এ ব্যাপারে উৎসাহের কমতি থাকে না। এজন্যে তারা কিন্তু সুযোগ পেলেই মা-বাবার কাছে ঘুর ঘুর করতে থাকে তাদের কাজে হাত বাড়িয়ে দেবার আশায়। তাই সন্তানকে আপনার ছোট্ট সহকর্মী হবার সুযোগ দিন। গল্প ও খেলাচ্ছলে তাকে উদ্বুদ্ধ করুন। তাকে বয়স অনুযায়ী কাজ দিন। তার ছোট ছোট কাজগুলো যে পরিবারের জন্যে কতটা গুরুত্ব বহন করে সেটা তাকে অনুভব করতে দিন।

আসলে এই কাজটা কিন্তু তার কাছে একটা টিকেটের মতো, যে টিকেট দিয়ে সে প্রবেশ করে বেড়ে উঠার জগতে। যেখানে সে দায়িত্ব নিতে শেখে, কর্মদক্ষতার কৌশল শেখে এবং নিজের ও অন্যের প্রতি যত্নশীল হতে শেখে। পরিশেষে যোগ্যতা প্রমাণের মাধ্যমে সামনে এগুনোর সাহস অর্জন করে। আর ছোটবেলা এজন্যে উৎকৃষ্ট সময়।

আপনার সন্তানের বয়সের সাথে সংশ্লিষ্ট কাজগুলো যেমন হতে পারে-

বয়স (২-৩)

  • খেলনা ও বই যথাস্থানে গুছিয়ে রাখা

বয়স (৪-৫)

  • খাবার পরিবেশনের জন্যে ডাইনিং টেবিল প্রস্তুত করা
  • ভেজা কাপড়গুলো শুকানো হলে বাইরে থেকে ঘরের ভেতরে নিয়ে আসা
  • ঘরের টুকটাক বাজারে তার সহযোগিতা নেয়া, হালকা জিনিস বহন করতে দেয়া
  • কাপড় ভাজ করে রাখা
  • ঘরে ছড়ানো ছিটানো ময়লাগুলো বিনে ফেলা
  • রান্নার সময় যেমন শাকসবজি ফল খোসা ছাড়ানোর সময় সাহায্য নেয়া (সাবধানতা অবলম্বন করে)

বয়স (৬-৮)

  • বিছানা গুছিয়ে রাখা
  • মশারি খাটানো
  • গাছ লাগানো, গাছে পানি দেয়া
  • ঘর ঝাড় দেয়া
  • ফার্নিচার মুছে রাখা
  • নিজের পড়ার টেবিল, স্কুল ব্যাগ, খেলনা গুছিয়ে রাখা

তাই সন্তানকে নিয়ে আজই কাজ শুরু করুন। কিছু দিন পর এই ছোট মানুষটির কর্মশক্তির স্ফূরণ দেখে প্রথম অবাক হবেন আপনিই।