ভুল বিনোদন॥ ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ পরিণতি

শহর কিংবা মফস্বল যেখানেই হোক, শিশুদের কাছে ভিডিও গেমস, কম্পিউটার গেমস এসব অত্যন্ত আনন্দের এক পরিচিত জগৎ। সাথে টিভি তো আছে ঘরে ঘরেই। অনেক ব্যস্ত মা-বাবা-অভিভাবক আছেন, যারা তাদের সন্তানদের সময় দিতে না পারার ক্ষতিটুকু পুষিয়ে দিতে, কখনো-বা সন্তানের মন রাখতে, মান রাখতে কিংবা ভুলিয়ে রাখার চেষ্টায় নির্বিচারে টিভি দেখা আর গেমস নিয়ে সময় কাটানোর অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে দেন। কিন্তু শিশু-মনস্তত্ববিদরা এ নিয়ে আমাদের জানাচ্ছেন ভয়াবহ সব তথ্য।

ভিডিও গেমস ॥ সহিংসতার দীক্ষা?

জার্মানির বিশেষজ্ঞরা সম্প্রতি এক গবেষণায় বলেন, আমাদের মস্তিষ্কের যে অংশটি আবেগ-অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে, নিয়মিত ভিডিও গেমস খেলার ফলে শিশু-মস্তিষ্কের সে অংশটি প্রায় অসাড় আর অবসন্ন হয়ে পড়ে। শুধু তা-ই নয়, শারীরিক-মানসিক উত্তেজনার সাথে সংশ্লিষ্ট পিঠের অংশটি হয়ে ওঠে অত্যধিক সক্রিয়, যার প্রভাব অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর চেয়েও মারাত্মক দুঃসংবাদ এসেছে রাশিয়া থেকে। বছর কয়েক আগে ১২ বছর বয়সী কয়েকজন বালক ক্রমাগত উত্তেজনাকর ভিডিও গেমস খেলার কারণে স্ট্রোক বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যায়।

চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এ-ও বলেছেন, ভিডিও গেমস প্রায়শই শিশুদের কল্পনা ও বাস্তবতার পার্থক্য-রেখাটি ভুলিয়ে দেয়। ভারতের বিশিষ্ট শিশু-মনস্তত্ত্ববিদ হেমাঙ্গি দাভালে বলেন, এসব গেমস শিশুরা নিয়মিতভাবে খেলার ফলে এর সহিংসতাকেই একসময় স্বাভাবিক বাস্তবতা বলে ধরে নেয়। ফলে প্রাত্যহিক জীবনে কখনো কখনো তার এসব প্রয়োগ করার ইচ্ছা জাগে। তখন নিজেকে গেমসের অংশ বলে মনে করে হিংস্র শারীরিক সক্ষমতা ও সহিংসতাকে অনুকরণ করতে চায়। তারা আরো জানাচ্ছেন, ভিডিও গেমস শিশুর অফুরান মনোদৈহিক শক্তি ক্ষয় করে ফেলে। শেষপর্যন্ত তাকে করে তোলে অবসাদগ্রস্ত। ভারতের আরেকজন শিশু-বিশেষজ্ঞ নির্মলা রাও বলেন, এ ধরনের খেলা শিশুদের মস্তিষ্কের ওপর চাপ বাড়ায় এবং উদ্ধত হয়ে ওঠাসহ নানারকম সমস্যা তৈরি করে।

গেমস নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনে আমরা প্রভাবিত হচ্ছি। অবিদ্যার কারণে কেউ কেউ আবার এটাও ভেবে বসি যে, ভিডিও গেমস শিশুদের বুদ্ধিদীপ্ত করে তোলে। আর এ ভয়াবহ অজ্ঞানতার অসহায় শিকার হয় আমাদের কোমলমতি শিশুরা।

টিভি সিরিয়াল দেখে বিগড়ে যাচ্ছে আগামী প্রজন্ম!

বছর কয়েক আগে ভারতে বেশ হৈ চৈ শুরু হয় সেদেশের দুটো টিভি অনুষ্ঠান নিয়ে। ‘বিগ বস ফোর’ আর ‘রাখি কা ইনসাফ’। বড়দের অনুষ্ঠান বলে এ দুটো গভীর রাতে সম্প্রচার করার জন্যে সুপারিশ করেছিলো কেন্দ্রীয় সরকার। কারণ, সে দেশের জাতীয় পর্যায়ের একটি সমীক্ষা অনুসারে, সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত ১০টার মধ্যে যে টিভি সিরিয়াল ও অনুষ্ঠান দেখানো হয় তাতে বিগড়ে যাচ্ছে ছয় থেকে ১৭ বছরের ছেলে-মেয়েরা। এই মতামতকে আবার সমর্থন দিয়েছে দেশটির প্রায় ৯০ শতাংশ অভিভাবক। তারা বলছেন, যত দিন যাচ্ছে ততই শালীনতা হারাচ্ছে এ জাতীয় অনুষ্ঠান আর সিরিয়ালগুলোর সংলাপ এবং ছবি। এদিকে ভারতীয় মনস্তত্ত্ববিদরা জানাচ্ছেন, টিভি দেখার প্রভাবে ক্রমশ হিংস্র হয়ে পড়ছে কমবয়সী ছেলে-মেয়েরা। মা-বাবার সাথে কোনো ধরনের খারাপ ব্যবহার করতেও পিছপা হচ্ছে না তারা এবং এসব ঘটছে এই অনুষ্ঠানগুলোর দৌলতেই।

এখানেই শেষ নয়। বলা হচ্ছে, ছয় বছরের কম বয়সী বাচ্চারা এখন তিন থেকে চার ঘণ্টা টিভি দেখে। বাদ যায় না ইচ্ছেমতো ডিভিডি দেখা-ও। শুধু এটুকু হলেও কথা ছিলো, কিন্তু গোল বেঁধেছে অন্য জায়গাতে। মা-বাবারা বলছেন, টিভি দেখার সময় বিজ্ঞাপনগুলো খুঁটে খুঁটে দেখে ওরা। তারপর একগুঁয়ে বায়না-বিজ্ঞাপনে দেখানো খাবারগুলো কিনে দিতে হবে। আর অস্বাস্থ্যকর ওসব খাবারগুলোতে এভাবেই আসক্ত হয়ে পড়ছে বাচ্চারা।

সমীক্ষায় আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে। সেটি হলো, বাচ্চারা কার্টুন দেখেই বেশি সময় কাটায়। কিন্তু ওসব কার্টুনেই মজার ছলে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে হিংসাত্মক ঘটনা। এ ওকে মারছে, সে এসে আবার পাল্টা মার দিচ্ছে ইত্যাদি। এতে তাৎক্ষণিক মজা আছে বটে, কিন্তু দূরপ্রসারী ফল হতে পারে ধ্বংসাত্মক আর ভয়াবহ।

শিশু-বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুর দুরন্ত প্রাণময় শৈশবকে এসব ভুল আর ক্ষতিকর বিনোদনের আগ্রাসন থেকে সচেতনভাবে রক্ষা করা, বাঁচিয়ে রাখা এখন আমাদের সবার জরুরি নৈতিক দায়িত্ব।

তথ্যসূত্র : হাফিংটন পোস্ট (১০ অক্টোবর, ২০১৩)

           নিউজ ম্যাক্স ডটকম (২৭ আগস্ট, ২০১৩)

           কিডস হেলথ

           সায়েন্স ওয়ার্ল্ড (আগস্ট ২০০৫)