আসুন, আমরা মাতৃভাষার যত্ন নেই, ভাষায় শুদ্ধাচার অনুশীলন করি

published : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১

আমরা সেই গর্বিত জাতি যারা মাতৃভাষার জন্যে প্রাণ দিয়েছি। আমাদেরকে অনুসরণ করে আজ সারা বিশ্বে ২১শে ফেব্রুয়ারি পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসবে।

ভাষার বিজয় আমরা এনেছি ঠিকই, ভাষাকে আমরা ভালবাসি নিঃসন্দেহে, কিন্তু ভাষার যত্ন কি আমরা করছি?

একটি গাছ যেমন ভালবাসা ও যত্ন পেলে তরতাজা হয়ে বেড়ে ওঠে, তার শাখা প্রশাখা দ্গিন্তজুড়ে বিস্তৃত হয়, তাতে বেশি বেশি ফুল-ফল ধরে। তেমন ভাষাও একটি গাছের মতন। যখন একটি ভাষাকে ভালবাসায় লালন করা হয়, তার যত্ন নেয়া হয়, তখন সে ভাষা আরও সমৃদ্ধ হয়, আরও সুন্দর হয়। সে ভাষা থেকে নিঃসৃত বাণী, বাক্য, গল্প, কবিতা জয় করে বিশ্ববাসীর হৃদয়কে।

কিন্তু ভাষার যত্ন কীভাবে নেয়?

তা কি শুধু বক্তৃতার মঞ্চে, বইয়ের পাতায় আর খবরের কাগজে?

না। তা নয়।

ভাষার যত্নের প্রয়োজন শুদ্ধাচার

একটি ভাষা আসলে সময়ের সাথে বেড়ে উঠে সে ভাষীদের মুখের প্রতিটি কথা প্রতিটি বাক্যের উপর ভর করে।

দৈনন্দিন জীবনে আমরা আমাদের ভাষাটাকে কীভাবে ভাষাকে ব্যবহার করছে, তার উপর নির্ভর করে যে সময়ের সাথে আমাদের ভাষার উপর ইতিবাচক পরিবর্তন পড়বে নাকি নেতিবাচক।

তাই ভাষার যত্নে প্রয়োজন শুদ্ধাচার।

আমাদের প্রতিদিনের জীবনে নানানভাবে ভাষাকে ব্যবহার করি আমরা। কিন্তু সময়ের সাথে বিভিন্নভাবে আমাদের ভাষাতে কিছু অশুদ্ধতা - কিছু অশুদ্ধ উচ্চারণ, শব্দ ও ঢঙ - মিশে যায় যা শ্রুতিকটু এবং ভাষার জন্যে ক্ষতিকর। ভাষার যত্নে এই অশুদ্ধতাগুলোর ব্যাপারে আমাদের সচেতন হতে হবে। একই সাথে আমরা কোথায় কখন কীভাবে আমাদের ভাষাকে ব্যবহার করছি, এই সচেতনতাও আমাদের ভাষার যত্নে প্রয়োজন।

তবে আসুন, এই ভাষার মাসে দৈনন্দিন জীবনে আমাদের মাতৃভাষার শুদ্ধাচার অনুশীলন করতে আমরা সচেষ্ট হই।

নিজের সাথে

আপনি নিজের সাথে যা বলবেন তা বাইরে যাবে না। তা কেবল আপনার মধ্যেই থাকবে। আপনি নিজেকে যত ভালো বলবেন, ভালো শোনাবেন - তত আপনি ভালো থাকবেন।

তাই শুদ্ধ ভাষা ও ভালো কথার চর্চা নিজের সঙ্গে প্রথমে গড়ে তুলুন। আপনার শুদ্ধতা প্রকাশ পাবে আপনার ব্যক্তিত্বে।

১। সকালে ঘুম ভাঙতেই বলুন, প্রভু তোমাকে ধন্যবাদ একটি সুন্দর দিনের জন্যে।

২। দিনের শুরুতেই নিজেকে অটোসাজেশন দিন -
কথোপকথনে শুদ্ধ ভাষা ব্যবহার সম্পর্ককে সুন্দর রাখে। পারস্পরিক সম্পর্কের সু-অনুরণন সৃষ্টি হয়। আমি সবসময় শুদ্ধ ভাষা ব্যবহার করবো।

৩। ফোনে বা ইন্টারনেটে কিছু লিখতে হলে শব্দের মাঝে স্পেসসহ সঠিক বানানে সম্পূর্ণ ইংরেজিতে বা মাতৃভাষায় লিখুন। ‘বাংলিশ' অর্থাৎ বাংলা ভাষাকে ইংরেজি অক্ষরে লেখা থেকে বিরত থাকুন।

পরিবারের সাথে

এই ভুলটা আমরা অনেকেই করে থাকি, যে বাইরের মানুষের সাথে সুন্দর করে কথা বলি আর ঘরে ফিরে বিরক্তি ভাব নিয়ে বা খেয়ালিপনা করে কোনোরকমে একটা বলে যাই। ভাবি, যে নিজের মানুষই তো।

অথচ পরিবারের সদস্যদের সাথে কথোপকথনের প্রভাব আমাদের জীবনে সবচাইতে বেশি। তাই যদি আমরা একটু খেয়াল করি, কী বলছি কীভাবে বলছি তার ব্যাপারে সচেতন হই এবং শুদ্ধাচার অনুসরণ করি, তাহলে আমাদের পারিবারিক সম্পর্কগুলো হতে পারে আরও গভীর আরও সুন্দর ও শুদ্ধ।

১। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সম্ভব হলে মা-বাবা, স্বামী/ স্ত্রী এবং অন্য সদস্যদের বলে বের হোন। বাসায় ফিরে আগে সবার খোঁজখবর নিন।

২। বাসায় প্রবেশের সময় বেল বাজানো/ কড়া নাড়ার আগে মনে মনে তিন বার বলুন-‘বাসায় যাচ্ছি শান্তির জন্যে। আমি শান্ত থাকব।’

৩। ঘরে ফিরে আগে মা-বাবার সাথে কুশল বিনিময় করুন। তাদের সাথে গল্প করুন, সারাদিন কী কী উল্লেখযোগ্য ও মজার ঘটনা হলো তা বলুন এবং তাদের কাছ থেকেও শুনুন।

৪। স্বামী বা স্ত্রীকে প্রতিদিন অন্তত একবার বলুন ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’।

৫। স্বামী/ স্ত্রীর সাথে কখনো বিরক্তি নিয়ে বা নিস্পৃহ ভঙ্গিতে কথা বলবেন না, আদেশের সুরে কিছু করতে বলবেন না, তুলনা করবেন না এবং একে অপরকে আক্রমণ করে কথা বলবেন না।

৬। পরিবারের কারও সীমাবদ্ধতা অন্যদের বলে বেড়াবেন না

৭। কখনো কারো রান্নার নিন্দা বা সমালোচনা করবেন না।

শিশুদের সাথে

আমাদের মুখের কথাটুকু আমাদের শিশুদের মননে এবং জীবনে অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। তাই আমরা যেন এমন কিছু না বলি যা তাদেরকে ভুল শেখাবে বা ক্ষতি করবে। এবং সবসময় শুদ্ধ উচ্চারণে শুদ্ধ বাংলা শিশুদের সাথে বলি। তাহলে ভাষায় শুদ্ধতার চর্চা গেঁথে যাবে তাদের সাথে আজীবন।

১। শৈশব থেকেই সন্তানকে বলুন, তোমাকে ভালো মানুষ হতে হবে। মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে।

২। কে বেশি ভালবাসে, বাবা নাকি মা?-এ ধরনের প্রশ্ন করে শিশুমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবেন না।

৩। শিশুদের সামনে আপনি কোনো ভুল করে ফেললে অকপটে দুঃখ প্রকাশ করুন। এতে আপনার প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ ও আস্থা বাড়বে।

৪। ভয় দেখিয়ে শিশুদের খাওয়াবেন না, ঘুম পাড়াবেন না। ভূত-প্রেতের কথা বলবেন না, কাউকে ভীতিকর হিসেবে উপস্থাপন করবেন না।

৫। দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও বীরত্বগাথা সম্পর্কে শিশুকে ধারণা দিন। সে যে এক মহান জাতির উত্তরসূরি-এ প্রত্যয় তার মনে গেঁথে দিন।

সামাজিক পরিমন্ডলে

একটি সমাজে ভাষার কী রূপ প্রচলিত হিসেবে গণ্য হচ্ছে, তা নির্ভর করে প্রতিটি ব্যক্তির উপর। তাই আমরা যারা অগ্রগামী, আমারা যদি সমাজে ভাষার শুদ্ধাচার অনুসরণ করি, তাহলে তা ছড়িয়ে পড়বে সমাজে অন্যান্যদের মাঝে। ভাষায় শুদ্ধাচার অনুসরণই তখন হয়ে উঠবে আমাদের সমাজের নিত্যদিনের অভ্যাস।

১। ধীরে, স্পষ্টভাবে, শুদ্ধ ভাষায় এবং পরিমিত স্বরে কথা বলুন।

২। কারো সাথে দেখা হলে আগে সালাম দিন। আন্তরিক হাসিতে শুভেচ্ছা ও কুশল বিনিময় করুন।

সালাম শুনেও স্পষ্ট উত্তর না দেয়া বা মাথা দোলানো থেকে বিরত থাকুন

৩। সম্বোধনে ‘তুই’ ব্যবহার করা থেকে পারতপক্ষে বিরত থাকুন। আপনার চেয়ে বয়সে বড় মনে হলে নামের সাথে চাচা/ খালা/ ভাই/ আপা সম্বোধন করুন।

৪। নামের বিকৃত উচ্চারণে তাকে ডাকবেন না। আত্মীয়-পরিজনদের নামের সাথে তার নাম মিলে গেলেও নাম বদলে দেবেন না।

৫। কারো কাছ থেকে যখন কিছু নিতে চাইবেন, ‘প্লিজ’ বা ‘অনুগ্রহ করে’ বলুন। নেয়ার পর ধন্যবাদ দিন।

কেউ ধন্যবাদ বললে জবাবে ‘ওয়েলকাম’ না বলে ‘শুকরিয়া/প্রভুকে ধন্যবাদ’ বলুন। এতে স্রষ্টা খুশি হবেন। ভালো কাজ করার সামর্থ্য আপনার আরো বাড়বে।

৬। ব্যক্তিগত আলাপে বা জনসমক্ষে কাউকে ‘মোটা হয়ে গেছেন/শুকিয়ে গেছেন', ‘বাচ্চা নেন না কেন/ আরেকটা বাচ্চা নিয়ে নেন', ‘বিয়ে না করে কতদিন/আপনার নাকি আগে একবার বিয়ে হয়েছিল'-এ জাতীয় একান্ত ব্যক্তিগত প্রশ্ন ও মন্তব্য করা।

৭। বুঝতে বা শুনতে অসুবিধা হলে ‘হুঁ/ অ্যাঁ/কী' জাতীয় শব্দ না করে বলুন : জ্বী/দুঃখিত/দয়া করে আবার বলুন।

৮। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে সঙ্গত কারণ ছাড়া নীরব থাকবেন না। এতে তাকে অবজ্ঞা করা হয়। কিছু না বললেও স্মিত হাসুন।

ভাষার যত্নে এড়িয়ে চলুন

স্মার্ট, ডিজুস, ট্রেন্ড - ইত্যাদির অজুহাতে আমাদের ভাষায় কিছু অশুদ্ধতা বর্তমানে প্রচলিত আছে। এই অশুদ্ধতাগুলোকে হটিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আমাদেরই কাঁধে। তাই আমরা যেন এই অশুদ্ধ চর্চাগুলোকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলি -

১। কথায় কথায় জোশ, মাইরি, wow, awesome, cause, likeফাটাফাটি অথবা বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে কোনো শব্দ ব্যবহার করা।

২। কাউকে সরাসরি বেইমান/কাফের/মুনাফেক/মুরতাদ বলা।

৩। কেউ ভালো কথা বললে ‘এত ভালোমানুষি দেখাতে হবে না'-জাতীয় মন্তব্য করা।

৪। চেহারা, গায়ের রং, গড়ন নিয়ে মন্তব্য করে কাউকে অস্বস্তিতে ফেলা।

৫। বাক্যের আগে বা পিছে গালি/অপ্রীতিকর শব্দ যোগ করা।

৬। ইংরেজিতে অশালীন শব্দ বলাকে স্মার্টনেস ভাবা।

৭। কথায় কথায় ‘হায় আল্লাহ/ও মাই গড/হায় ভগবান' বলা।

৮। কারো আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে কৌতুক/বিদ্রূপ করা।

আসলে ভাষা যত শুদ্ধ ও সুন্দর হয় আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কগুলো তত গভীর তত মমতাময় হয়। পৃথিবীর সকল মনীষীরা সুভাষী ছিলেন। সকল ধর্মে সুন্দর ভাষায় কথা বলার বিষয়ে জোর দেয়া হয়েছে।

২৯ বছর আগে কোয়ান্টাম যাত্রা শুরু করেছিল বাংলার মাটিতে বাংলা ভাষাতে। শুরু থেকেই কোয়ান্টাম জোর দিয়েছে ভাষায় শুদ্ধতা চর্চার উপর। বাংলা ভাষাকে কোয়ান্টাম কিছু বাক্য উপহার দিয়েছে যা এখন বাংলাভাষীদের মুখে মুখে, যেমন - রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন, নিজের কাজ সবচেয়ে ভালোভাবে করাই প্রকৃত দেশপ্রেম, সুস্থ দেহ প্রশান্ত মন কর্মব্যস্ত সুখী জীবন ইত্যাদি।

২০২১ সাল কোয়ান্টামের জন্যে শুদ্ধাচারের বছর। এবং এই শুদ্ধাচার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাই আসুন, আমরা মাতৃভাষায় শুদ্ধাচার চর্চা করি এবং আমাদের প্রাণের ভাষা, ত্যাগের ভাষার যত্ন নেই।