অনলাইনে শিশুর ছবি শেয়ারিং বিপজ্জনক যে পাঁচটি কারণে

published : ২৪ মার্চ ২০২২

একটা সময় শিশু সন্তানদের নিয়ে স্টুডিওতে ছবি তুলে বাঁধাই করে রাখার চল ছিল অনেক পরিবারে। কিন্তু এখন স্মার্টফোনের বদৌলতে ছবি তোলা যায় যখন-তখন। ফলশ্রুতিতে সন্তানের প্রতিদিনকার ছবি তুলে তা অনলাইনে শেয়ার করা পরিণত হয়েছে মহামারিতে।

সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, একেকজন বাবা-মা প্রতিবছর অনলাইনে তাদের শিশু সন্তানের গড়ে দুইশ’ ছবি পোস্ট করেন। সেই হিসেবে পঞ্চম জন্মদিনে পৌঁছার আগেই একটি শিশুর হাজারখানেক ছবি অনলাইনে পোস্ট হয়ে যায়।

সোশ্যাল মিডিয়ায় শিশুসন্তানের ছবি পোস্ট করার বাতিক আছে হয়তো আপনারও। কিন্তু এই আপাতঃ নিরীহ কাজটির মাধ্যমে আপনি যে তাকে চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছেন তা কি আপনি জানেন?

১. সাইবার অপরাধের ঝুঁকি

জাতিসঙ্ঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ-এর মতে, শিশুরা অনলাইনে যত সময় কাটাচ্ছে ততো বাড়ছে বিভিন্ন সাইবার অপরাধে তাদের শিকার হবার ঝুঁকি।

আপনার শিশুর তথ্য ও ছবি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেক আইডি খুলে ফেলতে পারে যে-কেউই। ভবিষ্যতে সেই অ্যাকাউন্ট পরিচালনাকারীর অপরাধমূলক কাজকর্মের জন্য দায়ী হতে পারে আপনার সন্তান।

এমনকি শিশু পর্নোগ্রাফি সাইটে আপনার অজান্তেই যুক্ত হয়ে যেতে পারে আপনার ছোট্ট সোনামণির ছবি।

হাফিংটন পোস্ট-এর তথ্যমতে, পিডোফিলিয়া বা শিশু পর্ন সাইটগুলোতে প্রদর্শিত ৫০ ভাগ শিশুর ছবিই সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট থেকে নেওয়া হয়।

২. শিশু অপহরণ

শিশুসন্তান কোথায় যায়, কোন রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করে, কিংবা কোন স্কুলে পড়ে- অর্থাৎ যাবতীয় তথ্য শেয়ার করেন কেউ কেউ। শিশু অপহরণকারীরা কিন্তু এই সুযোগের সন্ধানেই থাকে। আপনার আর্থিক অবস্থা মোটামুটি হলে আপনার সন্তান পরিণত হতে পারে তাদের নিশানায়।

বাবা-মায়ের ক্ষণিক দেরির সুযোগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে সংগৃহীত ছবি দেখিয়ে কেউ শিশুকে স্কুল থেকে নিয়ে চলে গেছে- এমনটা ঘটেছে বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই।

৩. ব্ল্যাকমেইলিং বা প্রতারণা

সোশ্যাল মিডিয়াতে জন্মদিনের শুভেচ্ছাবার্তায় ছবিসহ বাচ্চাদের নাম, বয়স, জন্মতারিখ, বাড়ির ঠিকানা, বাবা-মায়ের নাম ইত্যাদি ব্যক্তিগত নানা তথ্য শেয়ার করেন অনেকেই। এই কাজটির মাধ্যমে বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক নিরাপত্তা হুমকিতে ফেলে দিচ্ছেন।

জালিয়াতি চক্রের টার্গেটে পরিণত হতে পারে শিশুটি। সে বড় হয়ে যাওয়ার পর কেউ তাকে তার ছোটবেলার ছবি দেখিয়ে নিজেকে আপনজন পরিচয় দিয়ে হাতিয়ে নিতে পারে গোপনীয় নানা তথ্য। এতে ঘটতে পারে ব্ল্যাকমেইলিং বা প্রতারণার ঘটনা।

৪. আজকের ছবি হতে পারে আগামীর অস্বস্তির কারণ

অবুঝ শিশুর মজার কার্যকলাপ বা বোকা আচরণের ছবি বা ভিডিও হয়তো হাসতে হাসতেই শেয়ার করলেন আপনি। কিন্তু ভবিষ্যতে এই ছবি বা ভিডিওটিই হয়তো তাকে করবে বিরক্ত-বিব্রত-বিপর্যস্ত।

ধরুন, আপনি আপনার ছোট্ট শিশুটির জন্মদিনের পোষাকের একটি ছবি ফেসবুকে আপ করলেন। পরিণত বয়সে এই ছবিটি তার জন্যে চরম অস্বস্তির কারণ হতে পারে, বিশেষত তা যদি হয় মেয়ে শিশুর। সাইবার বুলিং বা কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা তো আছেই।

আশঙ্কার ব্যাপার হলো, অনলাইনে ছবি একবার পোস্ট হয়ে গেলে পরবর্তীতে সেটি রিমুভ করলেও এর ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট রয়েই যাবে!

বিভিন্ন উপলক্ষে গুগল ফটোস, ফেসবুকেরা স্বতঃপ্রণোদিত হয় পুরনো ছবি দেখায়। আপনিই ভেবে দেখুন, আপনার শিশুটির কিশোরী বা তরুণী বয়সে তার ছোট্টবেলার নগ্ন ছবি যখন অন্যের ওয়ালে ভেসে উঠবে এবং সেখানে কেউ ছবিটা নিয়ে অসংবেদনশীল মন্তব্য করবে তখন তার কেমন লাগবে? স্বস্তিদায়ক নয় নিশ্চয়ই!

৫. ভার্চুয়াল আসক্তি

আপনি ঘন ঘন অনলাইনে বা সোশ্যাল সাইটে সন্তানের ছবি বা ভিডিও শেয়ার করেন মানে হলো আপনি ভার্চুয়াল জগতে বুঁদ হয়ে আছেন! আপনাকে দেখে দেখে আপনার শিশুটিও পরিচালিত হতে পারে ভার্চুয়াল আসক্তির দিকে।

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা এখন উদ্বেগ প্রকাশ করছেন শিশুদের ভার্চুয়াল আসক্তি নিয়ে।

বাচ্চাকাচ্চারা সারাদিন স্মার্টফোন-কম্পিউটার-গেমিং কনসোল নিয়ে পড়ে থাকে, পড়ালেখায় মন নেই, মেধার বিকাশ থমকে যাচ্ছে- এমন অভিযোগ হয়তো আপনারও। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই শিশুটি আসক্ত হয়েছে আসলে আপনারই হাত ধরে, ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম-টুইটারে আপনার মুহূর্মূহু ছবি পোস্টের খোরাক জোগাতে গিয়ে। এ-ব্যাপারে তাই সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।