মেডিটেশন ও সুস্থ জীবনচর্চা ॥ জিনগত পরিবর্তনের সূচনা করে

জিনবিজ্ঞানে আশার আলো

আপনার জেনেটিক কোডে যে তথ্য দেয়া আছে, বছরের পর বছর ধরে আপনি ঠিক তেমনই থাকবেন-এমনটি ভাবা কিংবা অবধারিতভাবে মেনে নেয়ার দিন বোধহয় শেষ হতে চললো জিনবিজ্ঞানীরা সম্প্রতি জেনেটিক কোড, জিনের কর্মপদ্ধতি এবং মানুষের আচরণের ওপর জিনের প্রভাব নিয়ে সুদীর্ঘ গবেষণার পর এমন ধারণাই আমাদের দিচ্ছেন

ডারউইন-এর তত্ত্ব অনুসারে, বিবর্তন ঘটতে বা মানুষের জেনেটিক কোডে কোনো পরিবর্তন আসতে কয়েক প্রজন্ম সময় লাগে কখনো কখনো তা কয়েক লক্ষ বছর পর্যন্ত কিন্তু উচ্চতর জিনবিজ্ঞানের (এপিজেনেটিক্স) দীর্ঘ গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোনো শক্তিশালী পারিপার্শ্বিক নিয়ামকের মাধ্যমে জিনকে এমনভাবে প্রভাবিত করা যায় যে, মাত্র এক প্রজন্মেই জিনগত পরিবর্তন সম্ভব তাই উচ্চতর জিনবিজ্ঞানকে ডারউইন মতবাদের বিরুদ্ধে মনে করা হচ্ছে একটি ট্রাম্প কার্ড জিনবিজ্ঞানীদের ভাষায়, জিন নিয়ে গবেষণা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হলো এপিজেনেটিক্স বা উচ্চতর জিনবিজ্ঞান

১৯৮০ সাল থেকে শুরু করে গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে উচ্চতর জিনবিজ্ঞান বিষয়টি ক্রমশ বিকশিত হচ্ছে এটি হলো জেনেটিক কোড অক্ষুণ্ন রেখেই জিনের কার্যকারিতা পরিবর্তনের একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এ পদ্ধতিতে জিনের চেয়ে সূক্ষ্মতর অস্তিত্ব এপিজেনোম (যা নিয়ে এই উচ্চতর জিনবিজ্ঞান বা এপিজেনেটিক্স) জিনকে প্রভাবিত করে, নিয়ন্ত্রণ করে জিনের কাজ অর্থাৎ জিন (Gene) প্রভাবিত হয় এপিজেনোম-এর (Epigenome)মাধ্যমে। আর এপিজেনোম প্রভাবিত হয় আমাদের খাদ্যাভ্যাস,মানসিক অবস্থার ধরন ও গর্ভকালীন পুষ্টি দ্বারা-বলছেন গবেষকরা এ থেকে বিজ্ঞানীদের ধারণা হলো, জিন হলো হার্ডওয়্যার আর এপিজেনোম হচ্ছে সফটওয়্যারঅর্থাৎ এপিজেনোম-এর মাধ্যমে জিনকে প্রভাবিত করে যেভাবে ইচ্ছে কাজ করানো সম্ভব আবার এই এপিজেনোম প্রভাবিত হয় মূলত জীবনযাপনের ধরন ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ দ্বারা গবেষকদের মতে, এই পরিবর্তন স্থায়ী

এপিজেনোম ॥ খুলছে রহস্যের জট

মানব শরীরে কোষ বিভাজনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি (১টি থেকে ২টি, ২টি থেকে ৪টি, ...) এপিজেনোমের নির্দেশ অনুসারেই পরিচালিত হয় আর দেহকোষগুলো কীভাবে কাজ করবে তা-ও নির্ধারণ করে দেয় সেই কোষের এপিজেনোম। শরীরে মোট ২১০ ধরনের কোষ রয়েছে জিনবিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত মোটে দু-ধরনের কোষের এপিজেনোমের মানচিত্র আবিষ্কারে সমর্থ হয়েছেন প্রচলিত জিনবিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় এমন রহস্যময় বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো বিজ্ঞানীরা এখন ব্যাখ্যা করছেন উচ্চতর জিনবিজ্ঞানের মাধ্যমে যেমন যমজদের মধ্যে একজন সুস্থ থাকলে অন্যজন কেন মানসিক রোগ কিংবা এজমায় আক্রান্ত হয় এছাড়াও অটিজম কেন মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের বেশি হয় কিংবা খাদ্যাভ্যাস কীভাবে দীর্ঘায়ুকে প্রভাবিত করে

উচ্চতর জিনবিজ্ঞানের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা যে উল্লেখযোগ্য তথ্যগুলো পেয়েছেন, সেগুলো হলো-গর্ভাবস্থায় মায়ের টেনশন শিশুর পরিণত বয়সে এজমার কারণ হতে পারে গর্ভাবস্থায় মায়ের যেকোনো আচরণগত প্রভাব কেবল সন্তান গর্ভে থাকা পর্যন্তই নয়,পরিণত বয়সেও বাচ্চার ওপর এর প্রভাব রয়েছে গর্ভকালীন সময়ে মায়ের পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাব পরবর্তীতে বাচ্চার হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় আমাদের পছন্দ-অপছন্দ ও চিন্তার গতিপ্রকৃতি প্রভাবিত করে আমাদের স্মৃতিকে অতিভোজনে অভ্যস্ত যারা, তাদের পরবর্তী দুই প্রজন্মের আয়ু কমে যেতে পারে আশঙ্কাজনকহারে-গড়ে কমপক্ষে ছয় বছর, কখনো কখনো তা ৩২ বছর পর্যন্ত হতে পারে

মেডিটেশন ও সুস্থ জীবনচর্চা ॥ আপনার জিন-এ ঘটাবে ইতিবাচক পরিবর্তন

মেডিটেশনে সৃষ্ট গভীর শিথিলায়ন আমাদের মনোদৈহিক অস্তিত্বের অতলান্তে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করে সদ্য প্রকাশিত (সেপ্টেম্বর ২০১৩) একটি গবেষণা-প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও স্পেনের একদল মনোবিজ্ঞানী বলেছেন, মেডিটেশনে মানসিক স্থিরতা ও প্রশান্তি অর্জনের পাশাপাশি আমাদের জিনগত অভিব্যক্তিতে-ও ঘটে কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন

তাদের মতে, মেডিটেশন মানসিক উত্তেজনা বৃদ্ধির জন্যে দায়ী জিনগুলোকে স্তিমিত করে রাখতে পারে এ গবেষণা-কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেন বার্সেলোনা-র ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিকেল রিসার্চ-এর গবেষক ড. পার্লা ক্যালিমান তিনি বলেন, মেডিটেশনের প্রভাবে কয়েকটি নির্দিষ্ট জিন-এ আমরা কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি এ ধরনের পরিবর্তনের লক্ষ্যে আগে মানসিক উত্তেজনা প্রশমনকারী ওষুধ ব্যবহার করা হতো কিন্তু আমরা এখন আশা করছি, মেডিটেশনের মাধ্যমেই এর দীর্ঘস্থায়ী সমাধান সম্ভব

এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেট্স হাসপাতালে পরিচালিত একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার পর জিনবিজ্ঞানীরা বলছেন, দিনের পর দিন ক্রমাগত স্ট্রেসের ফলে মানুষের জিন-এ কিছু অযাচিত প্রতিক্রিয়া ঘটে, মেডিটেশন ও শিথিলায়ন দেহ-মনকে স্ট্রেসমুক্ত করার পাশাপাশি সেই জিনগত ক্ষতিটি-ও পূরণ করতে সক্ষম বিজ্ঞানীরা মনোদৈহিক এ পরিবর্তনকে অভিহিত করেছেন রিলাক্সেশন রেসপন্স নামে

এ গবেষণাটির ফলাফল নিয়ে বিজ্ঞানীদের মন্তব্য হলো, জিনবিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারার সমন্বয়ে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা যাতে দেখা যায়, যারা নিয়মিত শিথিলায়ন করেন ও সুস্থ জীবন-অভ্যাস চর্চা করেন তাদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের হার কম আর যারা উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খান তাদের ক্ষেত্রেও ওষুধের পরিমাণ ধীরে ধীরে কমতে থাকে গবেষকদের মতে, জিনের ওপর শিথিলায়নের প্রভাব এতটাই যে, যারা মেডিটেশনের মাধ্যমে দেহ-মনে টেনশনমুক্ত শিথিল অবস্থা সৃষ্টি করেন তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমশ উজ্জীবিত ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাই জিনবিজ্ঞানীরা এখন একে ক্যান্সার-জয়ের অন্যতম উপায় হিসেবেও ভাবতে শুরু করেছেন

আবার ক্ষতিকর জীবনধারা যেমন : ধূমপান, অতিভোজন ইত্যাদি এপিজেনোমকে প্রভাবিত করে, যা মেদস্থূলতার জন্যে দায়ী জিনগুলোকে উস্কে দেয় ও দীর্ঘায়ু সৃষ্টিকারী জিনগুলোকে করে তোলে দুর্বলআর অন্যদিকে এপিজেনোম-এর মাধ্যমে জিনকে প্রভাবিত করে ক্যান্সার, সিজোফ্রেনিয়া, অটিজম, আলঝেইমার্স, ডায়াবেটিসসহ অনেক দুরারোগ্য রোগ প্রতিরোধ সম্ভব বলে বিজ্ঞানীরা গবেষণায় প্রমাণ পেয়েছেন

২০০৯-এর ফেব্রেুয়ারিতে জার্নাল অব নিউরোসায়েন্স-এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়, উচ্চতর জিনবিজ্ঞানের মাধ্যমে মস্তিষ্কের মতো জটিল অঙ্গকেও প্রভাবিত করা যায় ইতিবাচক পরিবেশ, ব্যায়াম, বাড়তি মনোযোগ (মেডিটেশন) ও সচেতনতার মাধ্যমে এটি সম্ভব একে কাজে লাগিয়ে স্মৃতিদৌর্বল্যে আক্রান্ত মানুষকেও করে তোলা যাবে প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী। বিষয়গুলো জানার পর বিজ্ঞানীমহল এখন রীতিমতো শিহরিত (Nervously Excited) বোধ করছেন।

তথ্যসূত্র : টাইম ম্যাগাজিন (৬ জুন ২০১০)

রিডার্স ডাইজেস্ট (জানুয়ারি ২০১০)

হাফিংটন পোস্ট (১২ সেপ্টেম্বর ২০১৩)