published : ৪ নভেম্বর ২০২৪
সন্তান বাবা-মায়ের কথা শুনতে চায় না– এটি বর্তমানে দেশ-কাল-পাত্র নির্বিশেষে প্যারেন্টিং-এর অন্যতম চ্যালেঞ্জ। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল এসোসিয়েশন, ইউকের ন্যাশনাল সোসাইটি ফর দ্য প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েলটি টু চিল্ড্রেন, অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ফ্যামিলি স্টাডিজ, কানাডিয়ান পেডিয়াট্রিক সোসাইটি কর্তৃক পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, অন্তত ৫০ ভাগ অভিভাবক সন্তানের কথা না শোনার প্রবণতা নিয়ে ব্যাপক উদ্বিগ্ন।
বাংলাদেশেও এই পরিস্থিতি খুব একটা ভিন্ন নয়। কিন্তু সন্তান কথা শোনে না- দোষটা কি শুধুই সন্তানের? নাকি এর পেছনে বাবা-মায়েরও ভূমিকা আছে?
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ চাইল্ড হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট এর গবেষণামতে, বাবা-মায়ের তরফে সন্তানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং স্পষ্ট যোগাযোগ খুব গুরত্বপূর্ণ। এর ব্যত্যয় ঘটলে সন্তান ‘কনফিউজড’ বা বিভ্রান্ত হয়ে যায়, যার অন্যতম বহিঃপ্রকাশ বাবা-মায়ের কথা না শোনা।
কোনো কোনো পরিবারে মনে করা হয় বাবা-মা অভিভাবক, তাই তারা বেশি অভিজ্ঞ ও জ্ঞানী; অতএব সন্তানের কাজ হচ্ছে বিনা প্রশ্নে তাদের কথা শুনে যাওয়া। অভিভাবকের কোন দায় নেই ছেলেমেয়ের কথা শোনার। এমন পরিবারের সন্তান একটু বড় হলে আর বাবা মায়ের কথা শুনতে চায় না- এটা হয়ত আপনিও খেয়াল করেছেন।
আবার অনেক সময় দেখা যায় পরিবারের অভিভাবকেরা অতিমাত্রায় কর্তৃত্বপরায়ণ; পরিবারের ছোটদের হরদম ‘ছোট’ করতে থাকেন। কোন ধরনের ব্যাখ্যা না দিয়ে নিয়ম কিংবা প্রত্যাশা পরিবর্তন করেন। এমন পরিবারে ছেলেমেয়েদের বিভ্রান্ত এবং হতাশ বোধ করা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। কারণ তারা বুঝতে পারে না যে তাদের কাছ থেকে কি প্রত্যাশা করা হচ্ছে বা কেন তাদের কিছু আচরণ হঠাৎ করে অগ্রহণযোগ্য হয়ে গেল বাবা-মায়ের কাছে। সন্তানের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব তার মধ্যে অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দেয়।
সন্তান পরিচালনায় ধারাবাহিকতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হতে পারে কোনো নিয়ম বা পারিবারিক কায়দা-কানুন।
ধরা যাক, একটি পরিবারে নিয়ম হলো রাত ১০ টার পর বাচ্চারা কোনো ধরনের ডিভাইস ব্যবহার করবে না; এর ব্যতিক্রম হলে তাদেরকে পরবর্তী এক সপ্তাহ স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। কিন্তু এই নিয়মটি কঠিনভাবে একদিন পালন করা হলো তো আরেকদিন খেয়ালই করা হলো না। এখানেই বাধে বিপত্তি। বাবা-মা আসলে সন্তানের কাছে কী চাচ্ছেন– এ নিয়ে সৃষ্টি হয় বিভ্রান্তি। ফলে তারা মনে করতে থাকে অভিভাবকদের বেঁধে দেয়া নিয়মকে সিরিয়াসভাবে নেয়ার প্রয়োজন নেই!
কখনো কখনো অভিভাবক মুখে বলেন যে ভালো আছেন; কিন্তু তাদের কথায়, আচরণে ভিন্নরূপ প্রকাশ পায়। হতে পারে সেটা উত্তেজিত ভঙ্গি কিংবা রাগত স্বরে কথা। তখন একটি শিশুমনে পিতামাতার প্রকৃত মানসিক অবস্থা সম্পর্কে অনিশ্চিত ধারণা সৃষ্টি হয়।
আবার অনেক সময় স্পষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই বাবা-মায়ের মেজাজ আচমকা বদলে যায়। যেমন- হয়ত খুব স্নেহশীল মুডে ছিলেন, মুহূর্তে রেগে গেলেন। বাচ্চারা এর অর্থ বুঝতে পারে না। যা বাবা-মায়ের সাথে মানসিক সংযোগে বাঁধা দেয়।
আরো আশংকার ব্যাপার হলো পরবর্তীতে বাচ্চাদের নিজস্ব অনুভূতি বুঝতেও অসুবিধা হতে পারে।
বাবা-মাকে সন্তানের সামনে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ করা জরুরি।
বাবা-মা উপদেশ দিচ্ছেন কথা শুনতে, অথচ নিজেরাই শুনছেন না। সত্যি বলার পরামর্শ দিয়ে নিজেরাই মিথ্যা বলছেন। সন্তানকে রাত ১১টার পর ডিভাইজ ব্যবহার করতে নিষেধ করে নিজেরা ঠিকই ব্যবহার করছেন। পারিবারিক নিয়ম মানার কঠোর আদেশ দিচ্ছেন, কিন্তু নিজেরা মানছেন না। বলছেন সবাইকে সম্মান করতে, অথচ ছেলেমেয়েকে কোন সম্মান দিচ্ছেন না। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতে পরামর্শ দিয়ে নিজেরাই জাংক ফুড খাচ্ছেন।
এসব ক্ষেত্রে শিশু সততার গুরুত্ব সম্পর্কে পরষ্পরবিরোধী তথ্য পায়, যা নৈতিক মূল্যবোধ এবং উপযুক্ত আচরণ সম্পর্কে বিভ্রান্তির কারণ হয়।
সর্বোপরি পিতামাতার অসঙ্গতিপূর্ণ, পরস্পরবিরোধী, অপ্রত্যাশিত আবেগী আচরণ বাচ্চাদের বিভ্রান্ত করতে পারে। স্পষ্ট, সামঞ্জস্যপূর্ণ নিয়ম বাচ্চাদেরকে বুঝিয়ে বলার পাশাপাশি সেটি নিজেদেরকে মেনে দেখাতে হবে। তবেই বাচ্চাদের জন্য একটি মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ সহায়ক স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত হবে। তাদের আচরণও হবে সহজ, সুন্দর, স্বাভাবিক।