তরতাজা অনুভূতি নিয়ে দিনের কাজ শুরু করুন

আমরা সবাই সকালে একটা ঝরঝরে প্রাণবন্ত অনুভূতি নিয়ে জেগে উঠতে চাই। আমরা চাই তরতাজা অনুভূতি নিয়ে দিনের কাজ শুরু করতে। কিন্তু আমাদের মধ্যে ক'জন তা পারেন? বেশির ভাগই সকালে নিজে নিজে ঘুম থেকে উঠতে পারে না। ঘুম ভাঙলেও রাজ্যের ক্লান্তি ও অবসাদ বিছানা ত্যাগের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তারা ঘুম থেকে উঠেন নেহায়েত বাধ্য হয়ে, দুনিয়ার ক্লান্তি ও বিরক্তি সহকারে। সকালে ঘুম থেকে জাগার পর যদি আবার ঘুমিয়ে পড়তে পারেন তাহলেই যেন তারা বেঁচে যান। কিন্তু বাস্তব প্রয়োজনে তাদের জেগে থাকতে হয়। আর পরিপূর্ণ জাগ্রত অবস্থায় আসতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। অনেক সময় অনেকের ঘণ্টাখানেক সময় লেগে যায়।

ঘুম থেকে জাগার সমস্যা শুধু আমাদের দেশেই সীমিত নয়, এই সমস্যা সার্বজনীন। আমেরিকার নিদ্রা বিশেষজ্ঞ ডা. জেরল্ড ম্যাক্সম্যান তার বই 'এ গুড নাইটস স্লিপ'-এ লিখেছেন: ঘুম থেকে জাগার সমস্যা একটি সাধারণ অসুখ। ছয়শত আমেরিকানের উপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে যে, তাদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশেরও কম সংখ্যক লোক সকালবেলা তরতাজা অনুভূতি নিয়ে ঘুম থকে উঠতে পারেন। শতকরা সতেরো ভাগ স্বীকার করেছেন যে, ঘুম ভাঙার পরে পুরোপুরি সজাগ বা সচেতন হতে তাদের এক ঘণ্টা বা তার চেয়েও বেশি সময় লাগে। অনেকে পূর্ণ সজাগ হতে এর চেয়েও বেশি সময় নেন।

একটা সময় ছিল যখন আমাদের দেশের মানুষ খুব ভোরে উঠত। প্রবাদ ছিল: 'ফজরের হাওয়া লাখ টাকার দাওয়া'। ফজরের বাতাস যে স্বাস্থ্যের জন্যে অত্যন্ত উপকারী এ ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত না থাকলেও নগর জীবনে ভোরে না উঠাটাই একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। এর অবশ্য কারণও আছে। আগের মানুষ রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যেত আর সকালে উঠতও তাড়াতাড়ি। আর এখন কোনো কাজ না থাকলেও আড্ডা, সামাজিকতা বা টিভি দেখা শেষ করে ঘুমোতে ঘুমোতে মধ্যরাত অতিক্রান্ত হয়ে যায়। তার ওপর অনেকের রয়েছে অনিদ্রা রোগ। বিছানায় শুয়ে শুয়ে নানান টেনশন, সমস্যা চিন্তা করতে করতে ঘুম আসতে চায় না। গভীর নিদ্রা না হওয়ায় সকালে ঘুম ভাঙলেও বিছানা ছেড়ে উঠাটা রীতিমত ঝামেলা বলে মনে হয়। যারা বেশি চা কফি পান করেন বা মদ পান করেন বা ঘুমের ওষুধ খান তাদের ঘুম থেকে জেগে উঠার সমস্যা আরও তীব্র। তাই বলা যেতে পারে, আধুনিক নগর জীবনে তরতাজা অনুভূতি নিয়ে আপনা-আপনি জেগে উঠা একটা বিরল বিষয়।

তবে আপনি যদি একটু সচেতন প্রচেষ্টা চালান তাহলে তরতাজা অনুভূতি নিয়ে দিনের কাজ শুরু করাটা কোনো সমস্যাই নয়। এইজন্যে আপনি নিম্নোক্ত কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে পারেন:

১. বিকালের চা কফি পরিহার করুন। সাধারণত ক্যাফেইনের উত্তেজক প্রভাব তুঙ্গে পৌঁছায় ২ থেকে ৪ ঘণ্টার মধ্যে। কখনো কখনো ক্যাফেইনের প্রভাব অব্যাহত থাকে ৭ ঘণ্টা পর্যন্ত। এবং কারো কারো মধ্যে এই প্রভাব ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত বহাল থাকে। তাই চা কফি বা অন্য যে-কোনো ভাবে ক্যাফেইন গ্রহণ করা থেকে ঘুমাতে যাওয়ার ৬ ঘণ্টা আগে থেকেই বিরত থাকা উচিত।

২. নিকোটিনের প্রভাব সরাসরি পড়ে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমের ওপর। নিকোটিন স্নায়ুকে উত্তেজিত অবস্থায় রাখে। তাই ধূমপান বর্জন গভীর নিদ্রা ও তরতাজা অনুভূতি নিয়ে জেগে ওঠার জন্যে একটি প্রধান পদক্ষেপ হতে পারে। দেখা গেছে, ধূমপায়ীরা ধূমপান ত্যাগের মাত্র তিনদিনের মধ্যে চমৎকার ঘুমোতে শুরু করেন।

৩. ঘুমের জন্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর হচ্ছে মদ বা মাদক দ্রব্য। মাত্র এক পেগ অ্যালকোহলই ঘুমের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তর ‘স্বপ্ন স্তর'কে নষ্ট করে দেয় এবং গভীরতর স্তর 'ডেল্টা নিদ্রা' কে নস্যাৎ করে। তাই বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঘুমানোর আগে অ্যালকোহল পান করা প্রাথমিকভাবে ঘুমের সহায়ক হলেও এটি নিদ্রাভ্যাসের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিসাধন করে। তাই গভীর নিদ্রা ও তরতাজা অনুভূতি নিয়ে জেগে ওঠার জন্যে অ্যালকোহল পুরোপুরি বর্জনীয়।

৪. ঘুমানো ও জেগে ওঠার একটা রুটিন তৈরি করে নিন। অর্থাৎ প্রতিদিন একই সময় ঘুমোতে যান এবং একই সময়ে জেগে উঠুন।

৫. প্রতিদিন নিয়মিত ব্যায়াম করুন। নিয়মিত ব্যায়াম ও কায়িক শ্রম ঘুমের গভীর স্তর ডেল্টা নিদ্রার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ব্যায়াম এবং হাঁটা সবসময়ই উপকারী। তবে রাতের ঘুমের জন্যে রাতের খাবারের আগে বা পরে আধাঘণ্টা হাঁটা খুবই উপকারী।

৬. রাতের খাবারটা হালকা হওয়া ঘুমের জন্যে অত্যন্ত উপকারী। রাতে ভুরিভোজন গভীর নিদ্রার পথে সবসময় অন্তরায় হিসাবে কাজ করে। তাই রাতে এক গ্লাস দুধ বা এক কাপ দই, একটা রুটি বা একটু সবজি খাওয়া উত্তম। এ ধরনের হালকা খাবার ঘুমের জন্যে সহায়ক।

৭. ঘুমোতে যাওয়ার আগে বিছানায় শুয়ে শিথিলায়ন গভীর নিদ্রার জন্যে অত্যন্ত উপকারী। কয়েকবার নাক দিয়ে লম্বা দম নিয়ে মুখ দিয়ে ছাড়ুন। শরীরটাকে শিথিল করে নিন। দেখবেন সহজেই ঘুমিয়ে পড়ছেন। এজন্যে আপনি কোয়ান্টাম মেথড প্রক্রিয়ায় রাতে বিছানায় শুয়ে শিথিলায়ন করতে পারেন।

৮. সকালে ঘুম ভাঙলে চট করে উঠে পড়ুন। আলস্য ত্যাগ করে রাস্তায় হাঁটতে নেমে পড়ুন। ভোরের হাওয়া আপনার সমস্ত অবসাদ ও ক্লান্তি মুহূর্তে দূর করে দেয়।

৯. ঘুম ভাঙার সাথে সাথে আপনি শিথিলায়ন করে আপনার আলস্যকে দূর করতে পারেন। বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে নাক দিয়ে লম্বা দম নিয়ে মুখ দিয়ে ছাড়ুন। কয়েকবার এইভাবে দম নিয়ে দম ছাড়ুন। অনুভব করুন আপনার শরীর প্রাকৃতিক প্রাণে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।  মনে মনে অটোসাজেশন দিন : আমার দেহমন প্রকৃতির প্রাণ প্রবাহে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে, আমার শরীর তরতাজা ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে, আমি এখন পূর্ণ উদ্যম নিয়ে দিনের কাজ শুরু করব। তারপর চোখ মেলে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসুন এবং খালি হাতে কয়েকটি হালকা ব্যায়াম করুন। দেখবেন আপনি চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন।

১০. সকালে নাস্তা রাজার মতো করে করুন। পাশ্চাত্য ধরনের টোস্ট বিস্কুট আর চা দিয়ে নাস্তা করার ফ্যাশন বাদ দিন। অত্যন্ত পুষ্টি সমৃদ্ধ ও উচ্চ প্রোটিনযুক্ত নাস্তা সারা সকাল আপনাকে প্রাণবন্ত ও কর্মক্ষম রাখবে, আপনার মধ্যে এক ধরনের পরিতৃপ্তি সৃষ্টি করবে। তাই সকালের নাস্তায় ডিম, মাখন, দুধ, পনির, মাছ, গোস্ত অর্থৎ প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবারের প্রাচুর্য থাকা উচিত।

সকালে তরতাজা অনুভূতি নিয়ে ঘুম থেকে উঠা ও কাজ শুরু করার জন্যে উপরের প্রক্রিয়াগুলো বহুল পরীক্ষিত। আর সকালে আপনি বেগমান ও প্রাণবন্ত হতে পারলে দিনের কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারবেন সহজেই।